ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

আজ ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী দিবস

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:৩২:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ এপ্রিল ২০২২
  • / ২৯ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদক:
আজ ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী দিবস আজ। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে এই রক্তাক্ত পথ ধরে। সন্দেহ নেই, ভৌগোলিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা যেকোনো ঘটনায় স্থান ও কালের অবস্থানগত ভূমিকা থাকে। তবে এই সাথে জনপদের নীল বিদ্রোহের ঐহিত্যগত বৈপ্লবিক ধারা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াকু মনোভাব যা স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গে আপামর জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা লগ্নে চুয়াডাঙ্গার অবদান নানা কারণে অনন্য। ৭ মার্চ থেকেই এখানকার মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে এবং ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ জেলাসহ বিশাল অঞ্চল রাখে শত্রুমুক্ত। এখান থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে ২৯-৩০ মার্চ পরিচালিত হয় সফল ঐতিহাসিক ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’। চালু করা হয় সামরিক প্রশিক্ষণ, রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম, ডাক যোগাযোগ, রেডক্রস সোসাইটি কার্যক্রম, রেলওয়ে ও টেলিফোন লাইনের সাহায্যে বহির্বিশ্বের সাথে ট্রাংকল সংযোগ ইত্যাদি। এমতাবস্থায় ৩১ মার্চ বহুপথ ঘুরে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঢাকা থেকে তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গাতে এসে পৌঁছান। তাঁরা রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে গোপনে বৈঠক করেন। তিনি এখানকার চলমান কার্যক্রমে অভিভূত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সকল কাজ চুয়াডাঙ্গা কেন্দ্রিক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জীবননগর থানার চ্যাংখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। চুয়াডাঙ্গার পক্ষে এত দ্রুত প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব হয়েছিল। ১০ এপ্রিল শপথ গ্রহণ হবে চুয়াডাঙ্গায় সেটা ঘোষণাও করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তা জনিত কারণে পরে তা মুজিবনগরে স্থান্তারিত হলেও বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হবে চুয়াডাঙ্গা। কারণ তৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী এটা জেনেছিল এবং অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণের আগে এটা ঘোষণাও দিয়েছিল। তারপরেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর স্বীকৃতি মেলেনি চুয়াডাঙ্গাবাসীর কপালে।
এবিষয়ে দৈনিক সময়ের সমীকরণ’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ১৯৭১ সালের চুয়াডাঙ্গা রাজনৈতিক জেলা (মহকুমা, মহকুমাকে রাজনৈতিক জেলা ধরা হতো) ছাত্রলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মালিক ও চুয়াডাঙ্গা প্রথম রাজধানী বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব হাবিবি জহির রায়হানের।
কেন চুয়াডাঙ্গা অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মালিক বলেন- মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগার তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা বেশ কিছু কৌশলগত কারণে প্রথম রাজধানীর জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছিল। ১. রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী অভিযান চালিয়ে ২৯ মার্চ কুষ্টিয়া থেকে পাক-বাহিনীর ক্ষুদ্র ক্যাম্পটির পতন ঘটিয়েছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ২. ভারত সীমান্ত চুয়াডাঙ্গা শহরের দূরত্ব মাত্র ১০ মাইল। দর্র্শনা দিয়ে স্থলপথে বা টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা থেকে কলকাতাসহ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সহজ ছিল। এশিয়ার বৃহত্তর কেরু এন্ড কোম্পানি ও শ্রমিক-কৃষক নেতৃত্ব এবং দর্শনার রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুবই সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। ৩. চুয়াডাঙ্গাতেই প্রথম রাষ্ট্রের মনোগ্রাম, রেডক্রস সোসাইটি, ডাক বিভাগ চালু করা সম্ভব হয়েছিল, সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রভৃতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে চালু এখানেই শুরু করেছিল। জেলা পরিষদ ডাকবাংলা, শ্রীমন্ত টাউন হল, ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন হল, সদ্য নির্মাণাধীন সদর হাসপাতালের বিল্ডিং, মতিলাল আগরওয়ালার বাড়ি, পোস্ট অফিসের বিল্ডিং প্রভৃতি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, সংসদ অধিবেশন ও মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠান ও দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ৪. স্থলপথে চুয়াডাঙ্গা দখলে ব্যর্থ হয়ে আকাশ পথে ৩-৭ এপ্রিল পর্যন্ত, ১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার পর ১২ এপ্রিল থেকে পাক-বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গার ওপর লাগাতার বোমাবর্ষণ করেছে। পরিশেষে ১৫ এপ্রিল স্থলপথে চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশের লক্ষ্যে পাক-বাহিনী সরোজগঞ্জ ও ডিঙ্গেদহ বাজারে নির্বিচারে গুলি ও অগ্নিসংযোগ করে একই দিনে হাটের ওপর এক-দেড়শ লোককে হত্যা করে। এসবই চুয়াডাঙ্গার মানুষের বীরত্বপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরে অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদার দাবিদার করে তোলে।
এমন কোনো প্রামাণিক দলিলপত্রাদি আছে কি না? প্রশ্নের জবাবে চুয়াডাঙ্গা প্রথম রাজধানী বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাবিবি জহির রায়হান বলেন- একাত্তরে চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার পক্ষে অনেক প্রামাণিক দলিল রয়েছে, তবু এ নিয়ে অনেকে বিতর্ক করতে পছন্দ করেন। কেন করেন, কী কারণে করেন, আমরা জানি না। তবে এর অবসানের লক্ষ্যে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স তুলে ধরছি এবং সবাইকে সেই সব রেফারেন্সগুলো যাচাই করে বিতর্ক অবসানের সহায়তাকরণে আহ্বান জানাচ্ছি। যেমন- ১. তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)-এ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার পর্ব। ২. গতিধারা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরের ইতিহাস গ্রন্থে তাজউদ্দিন আহমেদ-এর ১০ এপ্রিলের একটি বার্তায় উল্লেখিত। যা ঐদিন কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ৩. সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, কুষ্টিয়া-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গার ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ৪. মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক ও কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : মেহেরপুর জেলা’ এবং মেহেরপুরের ইতিহাস গবেষক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ‘মেহেরপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে চুয়াডাঙ্গার কথা বলা আছে। ৫. ১৪ এপ্রিল নয়াদিল্লী থেকে ইউপিআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়- ঞযব ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ, নৎড়ধফপধংঃ নু ঃযব ৎবনবষ ঋৎবব ইবহমধষ জধফরড় ধহফ সড়হরঃড়ৎবফ যবৎব ংধরফ ঃযব পধঢ়রঃধষ ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয (ইধহমধষর ঘধঃরড়হ) এড়াবৎহসবহঃ ড়িঁষফ নব ঈযঁধফধহমধ ধ ংসধষষ ঃড়হি ১০ সরষবং ভৎড়স ঃযব নড়ৎফবৎ রিঃয ওহফরধ.
এদিকে, চুয়াডাঙ্গা প্রথম রাজধানী বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ দাবি জানিয়েছে- ১.১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার ‘চুয়াডাঙ্গা অস্থায়ী রাজধানী’ ঘোষণা করা হয়েছিল, তা মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, এখানকার প্রাণের দাবি যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গতিশীল করবে। অবিলম্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। ২. চুয়াডাঙ্গা থেকে পরিচালিত কুষ্টিয়ার যুদ্ধে পাক-বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেনা কর্মকর্তাসহ প্রায় ২ শতাধিক সৈনিক নিহত হয়। স্থলপথে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয়ে পাক-বিমান বাহিনী আকাশ পথে ৩-৭ এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার ফলে ১২ এপ্রিল থেকে লাগাতার বোমাবর্ষণ করে এবং পরিশেষে ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা প্রবেশকালে সরোজগঞ্জ ও ডিঙ্গেদহ বাজারে পাক-বাহিনী নির্বিচারে গুলি ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে গণহত্যা চালায় এতে প্রায় শতাধিক মানুষ জীবন হারায়। সেই সব স্থানের শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করছি। ৩. চুয়াডাঙ্গার যেসব স্থান ও ভবনকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করেছিল সেই স্থান ও ভবনগুলো এখন অবশিষ্ট আছে তা স্মৃতিচিহ্ন বা ঐতিহাসিক নিদর্শন স্বরূপ সংরক্ষণ করা জরুরি। বিশেষ করে মতিলাল আগারওয়ালা দ্বিতল বাড়ি, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন হল প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরসহ ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছি। ৪. ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা শহর দখলের পর সারা জেলার সমস্ত শহর-হাট-বাজার-গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করেছে। সারা দেশের ন্যায় এ জেলায়ও অসংখ্য বধ্যভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা অবিলম্বে চিহ্নিত করে যতদূর সম্ভব শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিচিহ্ন বা বধ্যভূমি স্মারক মানচিত্র নির্মাণ করার দাবি করছি। ইতঃমধ্যে অনেককিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এখনই যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা হয়, তবে যে টুকু আছে তা চিরতরে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে।
গত বছর দৈনিক সময়ের সমীকরণের অনলাইন টকশোতে সর্বজন অধ্যাপক আবদুল মোহিত, ইতিহাস গবেষক রাজীব আহমেদ ও সহযোগী অধ্যাপক মুন্সী আবু সাইফসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শ্রীমন্ত টাউন হল, পোস্ট অফিসের পুরাতন বিল্ডিং না ভাঙার পক্ষে তাদের মতামত প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিল। সেসময় তাদের দাবি ছিল যদি শ্রীমন্ত টাউন হল, পোস্ট অফিসের পুরাতন বিল্ডিং ভাঙা হয়, তবে স্মৃতি সংরক্ষণে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। দুঃখের বিষয় দুটি বিল্ডিংই ভাঙা হয়েছে। কিন্তু আজ অবদি স্মৃতি সংরক্ষণে বিকল্প উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
এদিকে, আজ ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর দাবি চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাসান চত্বরে সকাল ১০টায় সুন্দরম মিডিয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। সুন্দরম মিডিয়ার পক্ষ থেকে আসাদুজ্জামান শিমুল সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

আজ ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী দিবস

আপলোড টাইম : ০৪:৩২:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ এপ্রিল ২০২২

সমীকরণ প্রতিবেদক:
আজ ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী দিবস আজ। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে এই রক্তাক্ত পথ ধরে। সন্দেহ নেই, ভৌগোলিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা যেকোনো ঘটনায় স্থান ও কালের অবস্থানগত ভূমিকা থাকে। তবে এই সাথে জনপদের নীল বিদ্রোহের ঐহিত্যগত বৈপ্লবিক ধারা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াকু মনোভাব যা স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গে আপামর জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা লগ্নে চুয়াডাঙ্গার অবদান নানা কারণে অনন্য। ৭ মার্চ থেকেই এখানকার মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে এবং ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ জেলাসহ বিশাল অঞ্চল রাখে শত্রুমুক্ত। এখান থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে ২৯-৩০ মার্চ পরিচালিত হয় সফল ঐতিহাসিক ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’। চালু করা হয় সামরিক প্রশিক্ষণ, রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম, ডাক যোগাযোগ, রেডক্রস সোসাইটি কার্যক্রম, রেলওয়ে ও টেলিফোন লাইনের সাহায্যে বহির্বিশ্বের সাথে ট্রাংকল সংযোগ ইত্যাদি। এমতাবস্থায় ৩১ মার্চ বহুপথ ঘুরে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঢাকা থেকে তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গাতে এসে পৌঁছান। তাঁরা রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে গোপনে বৈঠক করেন। তিনি এখানকার চলমান কার্যক্রমে অভিভূত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সকল কাজ চুয়াডাঙ্গা কেন্দ্রিক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জীবননগর থানার চ্যাংখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। চুয়াডাঙ্গার পক্ষে এত দ্রুত প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব হয়েছিল। ১০ এপ্রিল শপথ গ্রহণ হবে চুয়াডাঙ্গায় সেটা ঘোষণাও করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তা জনিত কারণে পরে তা মুজিবনগরে স্থান্তারিত হলেও বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হবে চুয়াডাঙ্গা। কারণ তৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী এটা জেনেছিল এবং অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণের আগে এটা ঘোষণাও দিয়েছিল। তারপরেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর স্বীকৃতি মেলেনি চুয়াডাঙ্গাবাসীর কপালে।
এবিষয়ে দৈনিক সময়ের সমীকরণ’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ১৯৭১ সালের চুয়াডাঙ্গা রাজনৈতিক জেলা (মহকুমা, মহকুমাকে রাজনৈতিক জেলা ধরা হতো) ছাত্রলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মালিক ও চুয়াডাঙ্গা প্রথম রাজধানী বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব হাবিবি জহির রায়হানের।
কেন চুয়াডাঙ্গা অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মালিক বলেন- মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগার তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা বেশ কিছু কৌশলগত কারণে প্রথম রাজধানীর জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছিল। ১. রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী অভিযান চালিয়ে ২৯ মার্চ কুষ্টিয়া থেকে পাক-বাহিনীর ক্ষুদ্র ক্যাম্পটির পতন ঘটিয়েছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ২. ভারত সীমান্ত চুয়াডাঙ্গা শহরের দূরত্ব মাত্র ১০ মাইল। দর্র্শনা দিয়ে স্থলপথে বা টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা থেকে কলকাতাসহ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সহজ ছিল। এশিয়ার বৃহত্তর কেরু এন্ড কোম্পানি ও শ্রমিক-কৃষক নেতৃত্ব এবং দর্শনার রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুবই সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। ৩. চুয়াডাঙ্গাতেই প্রথম রাষ্ট্রের মনোগ্রাম, রেডক্রস সোসাইটি, ডাক বিভাগ চালু করা সম্ভব হয়েছিল, সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রভৃতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে চালু এখানেই শুরু করেছিল। জেলা পরিষদ ডাকবাংলা, শ্রীমন্ত টাউন হল, ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন হল, সদ্য নির্মাণাধীন সদর হাসপাতালের বিল্ডিং, মতিলাল আগরওয়ালার বাড়ি, পোস্ট অফিসের বিল্ডিং প্রভৃতি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, সংসদ অধিবেশন ও মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠান ও দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ৪. স্থলপথে চুয়াডাঙ্গা দখলে ব্যর্থ হয়ে আকাশ পথে ৩-৭ এপ্রিল পর্যন্ত, ১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার পর ১২ এপ্রিল থেকে পাক-বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গার ওপর লাগাতার বোমাবর্ষণ করেছে। পরিশেষে ১৫ এপ্রিল স্থলপথে চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশের লক্ষ্যে পাক-বাহিনী সরোজগঞ্জ ও ডিঙ্গেদহ বাজারে নির্বিচারে গুলি ও অগ্নিসংযোগ করে একই দিনে হাটের ওপর এক-দেড়শ লোককে হত্যা করে। এসবই চুয়াডাঙ্গার মানুষের বীরত্বপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরে অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদার দাবিদার করে তোলে।
এমন কোনো প্রামাণিক দলিলপত্রাদি আছে কি না? প্রশ্নের জবাবে চুয়াডাঙ্গা প্রথম রাজধানী বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাবিবি জহির রায়হান বলেন- একাত্তরে চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার পক্ষে অনেক প্রামাণিক দলিল রয়েছে, তবু এ নিয়ে অনেকে বিতর্ক করতে পছন্দ করেন। কেন করেন, কী কারণে করেন, আমরা জানি না। তবে এর অবসানের লক্ষ্যে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স তুলে ধরছি এবং সবাইকে সেই সব রেফারেন্সগুলো যাচাই করে বিতর্ক অবসানের সহায়তাকরণে আহ্বান জানাচ্ছি। যেমন- ১. তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)-এ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার পর্ব। ২. গতিধারা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরের ইতিহাস গ্রন্থে তাজউদ্দিন আহমেদ-এর ১০ এপ্রিলের একটি বার্তায় উল্লেখিত। যা ঐদিন কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ৩. সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, কুষ্টিয়া-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গার ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ৪. মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক ও কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : মেহেরপুর জেলা’ এবং মেহেরপুরের ইতিহাস গবেষক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ‘মেহেরপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে চুয়াডাঙ্গার কথা বলা আছে। ৫. ১৪ এপ্রিল নয়াদিল্লী থেকে ইউপিআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়- ঞযব ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ, নৎড়ধফপধংঃ নু ঃযব ৎবনবষ ঋৎবব ইবহমধষ জধফরড় ধহফ সড়হরঃড়ৎবফ যবৎব ংধরফ ঃযব পধঢ়রঃধষ ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয (ইধহমধষর ঘধঃরড়হ) এড়াবৎহসবহঃ ড়িঁষফ নব ঈযঁধফধহমধ ধ ংসধষষ ঃড়হি ১০ সরষবং ভৎড়স ঃযব নড়ৎফবৎ রিঃয ওহফরধ.
এদিকে, চুয়াডাঙ্গা প্রথম রাজধানী বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ দাবি জানিয়েছে- ১.১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার ‘চুয়াডাঙ্গা অস্থায়ী রাজধানী’ ঘোষণা করা হয়েছিল, তা মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, এখানকার প্রাণের দাবি যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গতিশীল করবে। অবিলম্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। ২. চুয়াডাঙ্গা থেকে পরিচালিত কুষ্টিয়ার যুদ্ধে পাক-বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেনা কর্মকর্তাসহ প্রায় ২ শতাধিক সৈনিক নিহত হয়। স্থলপথে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয়ে পাক-বিমান বাহিনী আকাশ পথে ৩-৭ এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার ফলে ১২ এপ্রিল থেকে লাগাতার বোমাবর্ষণ করে এবং পরিশেষে ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা প্রবেশকালে সরোজগঞ্জ ও ডিঙ্গেদহ বাজারে পাক-বাহিনী নির্বিচারে গুলি ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে গণহত্যা চালায় এতে প্রায় শতাধিক মানুষ জীবন হারায়। সেই সব স্থানের শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করছি। ৩. চুয়াডাঙ্গার যেসব স্থান ও ভবনকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করেছিল সেই স্থান ও ভবনগুলো এখন অবশিষ্ট আছে তা স্মৃতিচিহ্ন বা ঐতিহাসিক নিদর্শন স্বরূপ সংরক্ষণ করা জরুরি। বিশেষ করে মতিলাল আগারওয়ালা দ্বিতল বাড়ি, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন হল প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরসহ ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছি। ৪. ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা শহর দখলের পর সারা জেলার সমস্ত শহর-হাট-বাজার-গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করেছে। সারা দেশের ন্যায় এ জেলায়ও অসংখ্য বধ্যভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা অবিলম্বে চিহ্নিত করে যতদূর সম্ভব শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিচিহ্ন বা বধ্যভূমি স্মারক মানচিত্র নির্মাণ করার দাবি করছি। ইতঃমধ্যে অনেককিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এখনই যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা হয়, তবে যে টুকু আছে তা চিরতরে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে।
গত বছর দৈনিক সময়ের সমীকরণের অনলাইন টকশোতে সর্বজন অধ্যাপক আবদুল মোহিত, ইতিহাস গবেষক রাজীব আহমেদ ও সহযোগী অধ্যাপক মুন্সী আবু সাইফসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শ্রীমন্ত টাউন হল, পোস্ট অফিসের পুরাতন বিল্ডিং না ভাঙার পক্ষে তাদের মতামত প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিল। সেসময় তাদের দাবি ছিল যদি শ্রীমন্ত টাউন হল, পোস্ট অফিসের পুরাতন বিল্ডিং ভাঙা হয়, তবে স্মৃতি সংরক্ষণে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। দুঃখের বিষয় দুটি বিল্ডিংই ভাঙা হয়েছে। কিন্তু আজ অবদি স্মৃতি সংরক্ষণে বিকল্প উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
এদিকে, আজ ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর দাবি চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাসান চত্বরে সকাল ১০টায় সুন্দরম মিডিয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। সুন্দরম মিডিয়ার পক্ষ থেকে আসাদুজ্জামান শিমুল সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।