ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

হাসিনা সরকারের আমলে উন্নয়ন প্রকল্পে নয়ছয়

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৩:৩১:৫৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ২৩ বার পড়া হয়েছে

কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া একনেক সভায় ওঠানো যায় না। এ সুযোগ নিয়ে নিজ এলাকার জন্য বহু প্রকল্প পাস করিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীরা। একইভাবে শেখ পরিবারের সদস্যদের কারও নামে কোনো প্রকল্প নিলেই সেটার প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই ‘অটোপাস’ করানো হতো। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়-বিভাগগুলো প্রত্যেক প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) আকারে পাঠায়। ডিপিপি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব থাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের। প্রত্যেক সদস্যসচিব পদমর্যাদায় দায়িত্বরত। এসব সদস্য চাইলেই প্রকল্পের ডিপিপি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় সংশোধনের প্রস্তাব করতে পারেন অথবা পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে এগুলো বাদ দিতে পারেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া কোনো প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশনের একনেক সভায় ওঠানো যায় না। এ সুবিধা নিয়ে দায়িত্বকালীন একাধিক প্রকল্প অনুমোদন করিয়েছে নিয়েছেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও এম এ মান্নান। দেশব্যাপী কতিপয় জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেয় আইসিটি বিভাগ। প্রকল্পের ডিপিপিতে তখন কুমিল্লা জেলার নাম ছিল না। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শর্ত জুড়ে দেন কুমিল্লা জেলাকে প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলেই কেবল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হবে। পরে প্রকল্পের ডিপিপি পুনরায় সংশোধন করে কুমিল্লা জেলার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরেই প্রকল্পের অনুমোদন দেন সাবেক এ মন্ত্রী।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সব সময় প্রকল্পের মেরিট দেখে যাচাই-বাছাই করা দরকার। কারণ জনগণের টাকায় জনগণের কল্যাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। যে প্রকল্পে বেশি বেনিফট হবে সেই প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর সুনামগঞ্জে প্রকল্পের হিড়িক :
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুনামগঞ্জে ১০৮টি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ছিল। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান নিজ এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। নির্বাচনি এলাকায় রাস্তা-ঘাট-মসজিদ-মন্দির-মাদরাসার উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালের আসন বৃদ্ধি, দুই উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, দুই উপজেলা সড়কে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, অধিকাংশ এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন।
প্রকল্প নিলেই নিজ জেলার নাম দেখতেন মুস্তফা কামাল :
কুমিল্লা-১০ আসনের সদর দক্ষিণ, লালমাই, নাঙ্গলকোট এলাকা নিয়ে সাবেক পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্বাচনি এলাকা। এ এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শিল্পসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন তিনি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েরও হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। এছাড়া কুমিল্লা ইপিজেড ঘিরে অন্তত দুই লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে এবং গড়ে উঠছে পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণ।
শেখ পরিবার নাম থাকলেই প্রকল্প অনুমোদন :
প্রভাবশালীদের চাপে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এ প্রকল্পগুলো যাতে সহজে পাস করানো যায়, সে জন্য কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিল শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম। শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে সরকারি টাকায় ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছিল সদ্য পদত্যাগ করা আওয়ামী লীগ সরকার। যাতে ব্যয় হচ্ছে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ, বাকি ৪৪ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল বিনোদন কেন্দ্র, সাফারি পার্ক, দৃষ্টিনন্দন ভবন, নভোথিয়েটার, আইসিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠার নামে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ছেলে শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের নামে।
শেখ পরিবারের নামে ৫১ হাজার কোটির ৮২ প্রকল্প :
শেখ পরিবারের নামে ৫১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৮২ প্রকল্প নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিলে জনগণ উপকৃত হবে। অথচ এখানে প্রকল্পের মানদণ্ড বিচার না করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

হাসিনা সরকারের আমলে উন্নয়ন প্রকল্পে নয়ছয়

আপলোড টাইম : ০৩:৩১:৫৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া একনেক সভায় ওঠানো যায় না। এ সুযোগ নিয়ে নিজ এলাকার জন্য বহু প্রকল্প পাস করিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীরা। একইভাবে শেখ পরিবারের সদস্যদের কারও নামে কোনো প্রকল্প নিলেই সেটার প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই ‘অটোপাস’ করানো হতো। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়-বিভাগগুলো প্রত্যেক প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) আকারে পাঠায়। ডিপিপি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব থাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের। প্রত্যেক সদস্যসচিব পদমর্যাদায় দায়িত্বরত। এসব সদস্য চাইলেই প্রকল্পের ডিপিপি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় সংশোধনের প্রস্তাব করতে পারেন অথবা পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে এগুলো বাদ দিতে পারেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া কোনো প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশনের একনেক সভায় ওঠানো যায় না। এ সুবিধা নিয়ে দায়িত্বকালীন একাধিক প্রকল্প অনুমোদন করিয়েছে নিয়েছেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও এম এ মান্নান। দেশব্যাপী কতিপয় জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেয় আইসিটি বিভাগ। প্রকল্পের ডিপিপিতে তখন কুমিল্লা জেলার নাম ছিল না। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শর্ত জুড়ে দেন কুমিল্লা জেলাকে প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলেই কেবল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হবে। পরে প্রকল্পের ডিপিপি পুনরায় সংশোধন করে কুমিল্লা জেলার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরেই প্রকল্পের অনুমোদন দেন সাবেক এ মন্ত্রী।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সব সময় প্রকল্পের মেরিট দেখে যাচাই-বাছাই করা দরকার। কারণ জনগণের টাকায় জনগণের কল্যাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। যে প্রকল্পে বেশি বেনিফট হবে সেই প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর সুনামগঞ্জে প্রকল্পের হিড়িক :
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুনামগঞ্জে ১০৮টি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ছিল। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান নিজ এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। নির্বাচনি এলাকায় রাস্তা-ঘাট-মসজিদ-মন্দির-মাদরাসার উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালের আসন বৃদ্ধি, দুই উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, দুই উপজেলা সড়কে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, অধিকাংশ এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন।
প্রকল্প নিলেই নিজ জেলার নাম দেখতেন মুস্তফা কামাল :
কুমিল্লা-১০ আসনের সদর দক্ষিণ, লালমাই, নাঙ্গলকোট এলাকা নিয়ে সাবেক পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্বাচনি এলাকা। এ এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শিল্পসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন তিনি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েরও হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। এছাড়া কুমিল্লা ইপিজেড ঘিরে অন্তত দুই লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে এবং গড়ে উঠছে পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণ।
শেখ পরিবার নাম থাকলেই প্রকল্প অনুমোদন :
প্রভাবশালীদের চাপে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এ প্রকল্পগুলো যাতে সহজে পাস করানো যায়, সে জন্য কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিল শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম। শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে সরকারি টাকায় ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছিল সদ্য পদত্যাগ করা আওয়ামী লীগ সরকার। যাতে ব্যয় হচ্ছে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ, বাকি ৪৪ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল বিনোদন কেন্দ্র, সাফারি পার্ক, দৃষ্টিনন্দন ভবন, নভোথিয়েটার, আইসিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠার নামে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ছেলে শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের নামে।
শেখ পরিবারের নামে ৫১ হাজার কোটির ৮২ প্রকল্প :
শেখ পরিবারের নামে ৫১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৮২ প্রকল্প নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিলে জনগণ উপকৃত হবে। অথচ এখানে প্রকল্পের মানদণ্ড বিচার না করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।’