ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা, মানবিক বিপর্যয়

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২০:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৪
  • / ২৫ বার পড়া হয়েছে

ভারতের ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া ও গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুর্যোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান বন্যায় দেশের ৮ জেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন দু’জন। একজন ফেনীতে, আরেকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যাদুর্গত জেলা আটটি হলো- ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের জীবন রক্ষায় ও দুর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ত্রাণ হিসেবে খাদ্য এবং নগদ অর্থের সর্বাত্মক প্রস্তুতি আছে। দ্রুত পানি নামলে পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করব। সেনা, নৌ, কোস্টগার্ড ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে নিয়োজিত করা হয়েছে। সংস্কার আন্দোলনের ছাত্ররাও উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রশাসন চেষ্টা করছে, সরকার চেষ্টা করছে যাতে মানুষের জীবন, জান-মাল, গবাদিপশু রক্ষা করা যায়। এটা আকস্মিক একটা। ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড যেটা বলে। কেউ কেউ বলছে আমাদের ওপারে, ওখান থেকে পানি এসেছে। ভারতীয় অঞ্চল থেকেও পানি নেমে এসেছে। বন্যা যে রকম প্রাকৃতিকভাবে হয়, দ্রুতই হয়েছে। গতকাল সকাল ও বিকেল থেকে দ্রুত পানি এসেছে যে অনেক এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে সতর্কতা না দিয়ে বাঁধ খুলে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপেদেষ্টাসহ বিশিষ্টজনেরা। এছাড়া বাঁধ খুলে দেওয়ার খবরে ভারতের আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা।
ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে :
গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘উজানের পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে। আমরা আশা করব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারত বাংলাদেশের জনগণবিরোধী এ ধরনের নীতি থেকে সরে আসবে। ভারতের এই নীতি নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও জনগণ ক্ষুব্ধ।’
মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন:
গতকাল বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের বরাতে জানানো হয়েছে, বন্যাদুর্গত কয়েকটি উপজেলায় অপটিক্যাল ফাইবার ডেমেজ হওয়ার কারণে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে কয়েকটি জায়গায়। এসব এলাকায় জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। নেটওয়ার্ক একবারে বিচ্ছিন্ন হলে ১০টি ভিএসএটি প্রস্তুত আছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফ্রি করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে।
সচেতনভাবেই ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে :
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরাকে কখনোই আমলে নেয় না। এ জন্য সচেতনভাবেই ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত কখনোই ন্যায়নীতির নির্দেশ গ্রাহ্য করেনি। তিনি বলেন, ‘ভারতের ত্রিপুরাস্থ ধলাই জেলার গোমতী নদীর ওপর থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহে প্রতিবেশী দেশ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী পানি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের স্বার্থকে বিপন্ন করছে।’
গণঅধিকার পরিষদের মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচি:
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির ন্যায্য হিস্যার দাবি এবং ডাম্বুর বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে গণঅধিকার পরিষদ। এছাড়া দলটি মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচিও শুরু করেছে। রাজধানীর শাহজাদপুরে কনফিডেন্স সেন্টারের সামনে থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। এতে লেখা রয়েছে- রক্ত দিয়া বানাইছি ঘর দিল্লি দেখায় পানির ডর, দিল্লির দাদাগিরি মানি না ইত্যাদি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ভারতের আগ্রাসন নীতির প্রতিবাদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।
এদিকে, জামায়াতের উদ্বেগ দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। গত বুধবার পাঠানো ওই বিবৃতিতে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভারত সরকার এই বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষদের পানিতে ডুবিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত ৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভারত সরকারের এই অমানবিক কাজে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’
বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যার কথা সঠিক নয় : ভারত
অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশে এমন একটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বাস্তবে সঠিক নয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতে গোমতী নদীর সংলগ্ন এলাকায় গত কয়েকদিনে চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাঁধের ভাটি এলাকার পানির কারণে বাংলাদেশের বন্যা হয়েছে। ডুম্বুর বাঁধ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, বাংলাদেশের ১২০ কিলোমিটার উজানে। প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতার এই বাঁধের মাধ্যমে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলে। সেখান থেকে ত্রিপুরা হয়ে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে উজানে ১২০ কিলোমিটার নদীপথে তিনটি পানির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকার কথা বলা হয়েছে বিবৃতিতে। যার মধ্যে অমরপুর স্টেশন থেকে দ্বিপক্ষীয় প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশকে বন্যার হালনাগাদ তথ্য দেওয়া হয়। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার তথ্য ২১ আগস্ট বিকাল ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় বন্যার কারণে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় যোগাযোগে সমস্যা তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে জরুরি তথ্য আদান-প্রদানের জন্য অন্যান্য উপায় ব্যবহার করে যোগাযোগ চালু রাখার চেষ্টা করার কথাও বলেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিচ্ছিন্ন প্রায় ফেনী, মহাবিপদে সাড়ে তিন লাখ মানুষ:
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদের পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বন্যাকবলিতরা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি কেউ। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। এতে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রামবন্যা কবলিত। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় বানের পানি মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালও ছুঁয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা, মানবিক বিপর্যয়

আপলোড টাইম : ০৯:২০:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৪

ভারতের ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া ও গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুর্যোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান বন্যায় দেশের ৮ জেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন দু’জন। একজন ফেনীতে, আরেকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যাদুর্গত জেলা আটটি হলো- ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের জীবন রক্ষায় ও দুর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ত্রাণ হিসেবে খাদ্য এবং নগদ অর্থের সর্বাত্মক প্রস্তুতি আছে। দ্রুত পানি নামলে পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করব। সেনা, নৌ, কোস্টগার্ড ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে নিয়োজিত করা হয়েছে। সংস্কার আন্দোলনের ছাত্ররাও উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রশাসন চেষ্টা করছে, সরকার চেষ্টা করছে যাতে মানুষের জীবন, জান-মাল, গবাদিপশু রক্ষা করা যায়। এটা আকস্মিক একটা। ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড যেটা বলে। কেউ কেউ বলছে আমাদের ওপারে, ওখান থেকে পানি এসেছে। ভারতীয় অঞ্চল থেকেও পানি নেমে এসেছে। বন্যা যে রকম প্রাকৃতিকভাবে হয়, দ্রুতই হয়েছে। গতকাল সকাল ও বিকেল থেকে দ্রুত পানি এসেছে যে অনেক এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে সতর্কতা না দিয়ে বাঁধ খুলে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপেদেষ্টাসহ বিশিষ্টজনেরা। এছাড়া বাঁধ খুলে দেওয়ার খবরে ভারতের আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা।
ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে :
গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘উজানের পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে। আমরা আশা করব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারত বাংলাদেশের জনগণবিরোধী এ ধরনের নীতি থেকে সরে আসবে। ভারতের এই নীতি নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও জনগণ ক্ষুব্ধ।’
মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন:
গতকাল বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের বরাতে জানানো হয়েছে, বন্যাদুর্গত কয়েকটি উপজেলায় অপটিক্যাল ফাইবার ডেমেজ হওয়ার কারণে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে কয়েকটি জায়গায়। এসব এলাকায় জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। নেটওয়ার্ক একবারে বিচ্ছিন্ন হলে ১০টি ভিএসএটি প্রস্তুত আছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফ্রি করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে।
সচেতনভাবেই ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে :
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরাকে কখনোই আমলে নেয় না। এ জন্য সচেতনভাবেই ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত কখনোই ন্যায়নীতির নির্দেশ গ্রাহ্য করেনি। তিনি বলেন, ‘ভারতের ত্রিপুরাস্থ ধলাই জেলার গোমতী নদীর ওপর থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহে প্রতিবেশী দেশ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী পানি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের স্বার্থকে বিপন্ন করছে।’
গণঅধিকার পরিষদের মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচি:
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির ন্যায্য হিস্যার দাবি এবং ডাম্বুর বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে গণঅধিকার পরিষদ। এছাড়া দলটি মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচিও শুরু করেছে। রাজধানীর শাহজাদপুরে কনফিডেন্স সেন্টারের সামনে থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। এতে লেখা রয়েছে- রক্ত দিয়া বানাইছি ঘর দিল্লি দেখায় পানির ডর, দিল্লির দাদাগিরি মানি না ইত্যাদি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ভারতের আগ্রাসন নীতির প্রতিবাদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।
এদিকে, জামায়াতের উদ্বেগ দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। গত বুধবার পাঠানো ওই বিবৃতিতে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভারত সরকার এই বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষদের পানিতে ডুবিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত ৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভারত সরকারের এই অমানবিক কাজে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’
বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যার কথা সঠিক নয় : ভারত
অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশে এমন একটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বাস্তবে সঠিক নয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতে গোমতী নদীর সংলগ্ন এলাকায় গত কয়েকদিনে চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাঁধের ভাটি এলাকার পানির কারণে বাংলাদেশের বন্যা হয়েছে। ডুম্বুর বাঁধ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, বাংলাদেশের ১২০ কিলোমিটার উজানে। প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতার এই বাঁধের মাধ্যমে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলে। সেখান থেকে ত্রিপুরা হয়ে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে উজানে ১২০ কিলোমিটার নদীপথে তিনটি পানির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকার কথা বলা হয়েছে বিবৃতিতে। যার মধ্যে অমরপুর স্টেশন থেকে দ্বিপক্ষীয় প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশকে বন্যার হালনাগাদ তথ্য দেওয়া হয়। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার তথ্য ২১ আগস্ট বিকাল ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় বন্যার কারণে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় যোগাযোগে সমস্যা তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে জরুরি তথ্য আদান-প্রদানের জন্য অন্যান্য উপায় ব্যবহার করে যোগাযোগ চালু রাখার চেষ্টা করার কথাও বলেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিচ্ছিন্ন প্রায় ফেনী, মহাবিপদে সাড়ে তিন লাখ মানুষ:
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদের পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বন্যাকবলিতরা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি কেউ। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। এতে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রামবন্যা কবলিত। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় বানের পানি মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালও ছুঁয়েছে।