ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার শুরু

শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩০:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৪ বার পড়া হয়েছে

কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলন দমাতে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে উসকানি প্রদান, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশদাতার ভূমিকা পালনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মূর্তজা মজুমদারের সভাপতিত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই পরোয়ানা জারির আদেশ দেওয়া হয়।

আদেশদানের আগে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন উপস্থাপন করেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এম তাজুল ইসলাম। জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় আসামিদের কার কী ভূমিকা, তা         নির্দিষ্ট করে তুলে ধরা হয়। প্রথমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি আদেশ দেওয়া হয়।

তবে তদন্ত ও গ্রেপ্তার আদেশ কার্যকরের স্বার্থে ওবায়দুল কাদের ব্যতীত দ্বিতীয় আবেদনে কারো নাম প্রকাশ করেননি চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, এই অপরাধীরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন, তাদের নামটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করছি না তদন্ত ও গ্রেপ্তার নিশ্চিতের স্বার্থে। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, একটা সরকার কীভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হলো, কীভাবে নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে মারল, তার প্রেক্ষাপটও ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছি। আদালতের কাছে আবেদন ছিল, এই অপরাধগুলো এত বিস্তৃত মাত্রায় সারা বাংলাদেশ জুড়ে সংঘটিত হয়েছে এবং এই অপরাধের যারা আসামি, তারা অসম্ভবরকম প্রভাবশালী। এদেরকে গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন। এদের ভয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শহিদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে ৪৬ জনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে।

জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে সরকার। তিন সদস্যের ঐ ট্রাইব্যুনালে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারকার্যের প্রথম দিন চিফ প্রসিকিউটর আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালে।

আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগসূমহ :

অভিযোগে বলা হয়েছে, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্দেশ রয়েছে। মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্বিঘ্নে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন তৎকালীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাবেক এমপি একই ধরনের অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেন। অধস্তনদের হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার তথ্য জানার পরও কোনো ধরনের বাধা প্রদান করেননি ৪৬ আসামি। এতে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখেন।

এছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলারা টকশো, কলাম লিখে ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সরকারকে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনে উৎসাহ ও সমর্থন দিয়েছেন। এপিবিএন, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। হেলিকপটার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে গ্রেনেড। এতে ঘরে থাকা শিশুরাও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ৫ আগস্ট কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা গণভবনের অভিমুখে লংমার্চ করে। লংমার্চের দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পালিয়ে যাওয়ার পরও ওই দিন গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জুলাই-আগস্ট মাসে অসংখ্য মানুষকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে গণহত্যার আলামত মুছে ফেলতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে দেওয়া হয়নি। অনেক নিহতের সুরতহাল ও পোস্টমর্টেম করা হয়নি। ঐ সরকারের আজ্ঞাবহ সাংবাদিকরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যাও সঠিকভাবে প্রচার করেনি। ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তখন ২৮৬টি মামলায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ লোককে আসামি করা হয়েছে।

এভাবে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে নির্মূলে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তনদের নিয়ন্ত্রণ না করে বলপূর্বক আক্রমণ, হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে উসকানি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্দেশ দান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)৪(১) ধারায় অপরাধ সংঘটন করেছেন। এসব আসামি ছাড়াও আরো অনেকের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে; যা তদন্তে উঠে আসবে।

এ পর্যায়ে শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। তখন চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘ওনার অবস্থান সম্পর্কে আমরা অবগত নই।’ এরপরই পরোয়ানা জারিরর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এসময় প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গাজী এমএইচ তামিম ও অ্যাডভোকেট বিএম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা :

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার তালিকায় আছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, আকম মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, দীপু মনি, সজীব ওয়াজেদ জয়, ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে শামস পরশ, জুনায়েদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিবির হারুন-অর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, র‌্যাবের জিয়াউল আহসান, এসবি মনিরুল ইসলাম, তারেক সিদ্দিকী, বিচারপাতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ড. জাফর ইকবাল প্রমুখ।

অভিযোগে বলা হয়েছে, বিচারপতি মানিক আন্দোলনরতদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেন। শহিদ আবু সাঈদকে সন্ত্রাসী বলেন। ড. জাফর ইকবাল তার লেখনীর মধ্যদিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে ঘৃণা ছড়িয়ে দেন। তিনি লেখেন, আন্দোলনরতদের এই দেশে থাকার অধিকার নেই। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই যথেষ্ট আন্দোলন দমাতে।’ আর কারফিউ ভঙ্গ করলে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ এ আরাফাত শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্ত বলে আখ্যা দেন। প্রতি মিনিটে গুলি ছুড়লে পাঁচ বছরেও বুলেট শেষ হবে না, এমন বক্তব্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি গুলি ছুড়তে উৎসাহিত করেছেন। আসাদুজ্জামান কামাল নানা বক্তব্যে গণহত্যা চালাতে বাহিনীকে নির্দেশ দেন। আনিসুল হক ও দীপু মনি আন্দোলনরতদের স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রেতাত্মা বলে অভিহিত করেন। আকম মোজাম্মেল হক বলেছেন, এরা দুষ্কৃতিকারী। জয় ও পলক ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে গণহত্যা চালানোর প্ররোচনা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ যেভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হলো :

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে হত্যা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত হয় পিলখানা হত্যাকাণ্ড। ৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যার শিকার হন। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা করে। এতে ৬১ জন মারা যায়, যা বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে। ২০১৪ সালে মধ্যরাতে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকার। এরপর পরবর্তী দুটি নির্বাচন একভাবে আয়োজন করে। গত দেড় দশকে র্যাবকে ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে অনেকে এই বাহিনীর হাতে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রয়োগ করা হয় আইসিটি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনকে। এভাবেই একটি সরকার দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার শুরু

শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ

আপলোড টাইম : ১০:৩০:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলন দমাতে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে উসকানি প্রদান, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশদাতার ভূমিকা পালনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মূর্তজা মজুমদারের সভাপতিত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই পরোয়ানা জারির আদেশ দেওয়া হয়।

আদেশদানের আগে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন উপস্থাপন করেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এম তাজুল ইসলাম। জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় আসামিদের কার কী ভূমিকা, তা         নির্দিষ্ট করে তুলে ধরা হয়। প্রথমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি আদেশ দেওয়া হয়।

তবে তদন্ত ও গ্রেপ্তার আদেশ কার্যকরের স্বার্থে ওবায়দুল কাদের ব্যতীত দ্বিতীয় আবেদনে কারো নাম প্রকাশ করেননি চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, এই অপরাধীরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন, তাদের নামটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করছি না তদন্ত ও গ্রেপ্তার নিশ্চিতের স্বার্থে। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, একটা সরকার কীভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হলো, কীভাবে নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে মারল, তার প্রেক্ষাপটও ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছি। আদালতের কাছে আবেদন ছিল, এই অপরাধগুলো এত বিস্তৃত মাত্রায় সারা বাংলাদেশ জুড়ে সংঘটিত হয়েছে এবং এই অপরাধের যারা আসামি, তারা অসম্ভবরকম প্রভাবশালী। এদেরকে গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন। এদের ভয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শহিদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে ৪৬ জনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে।

জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে সরকার। তিন সদস্যের ঐ ট্রাইব্যুনালে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারকার্যের প্রথম দিন চিফ প্রসিকিউটর আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালে।

আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগসূমহ :

অভিযোগে বলা হয়েছে, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্দেশ রয়েছে। মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্বিঘ্নে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন তৎকালীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাবেক এমপি একই ধরনের অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেন। অধস্তনদের হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার তথ্য জানার পরও কোনো ধরনের বাধা প্রদান করেননি ৪৬ আসামি। এতে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখেন।

এছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলারা টকশো, কলাম লিখে ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সরকারকে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনে উৎসাহ ও সমর্থন দিয়েছেন। এপিবিএন, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। হেলিকপটার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে গ্রেনেড। এতে ঘরে থাকা শিশুরাও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ৫ আগস্ট কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা গণভবনের অভিমুখে লংমার্চ করে। লংমার্চের দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পালিয়ে যাওয়ার পরও ওই দিন গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জুলাই-আগস্ট মাসে অসংখ্য মানুষকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে গণহত্যার আলামত মুছে ফেলতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে দেওয়া হয়নি। অনেক নিহতের সুরতহাল ও পোস্টমর্টেম করা হয়নি। ঐ সরকারের আজ্ঞাবহ সাংবাদিকরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যাও সঠিকভাবে প্রচার করেনি। ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তখন ২৮৬টি মামলায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ লোককে আসামি করা হয়েছে।

এভাবে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে নির্মূলে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তনদের নিয়ন্ত্রণ না করে বলপূর্বক আক্রমণ, হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে উসকানি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্দেশ দান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)৪(১) ধারায় অপরাধ সংঘটন করেছেন। এসব আসামি ছাড়াও আরো অনেকের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে; যা তদন্তে উঠে আসবে।

এ পর্যায়ে শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। তখন চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘ওনার অবস্থান সম্পর্কে আমরা অবগত নই।’ এরপরই পরোয়ানা জারিরর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এসময় প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গাজী এমএইচ তামিম ও অ্যাডভোকেট বিএম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা :

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার তালিকায় আছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, আকম মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, দীপু মনি, সজীব ওয়াজেদ জয়, ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে শামস পরশ, জুনায়েদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিবির হারুন-অর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, র‌্যাবের জিয়াউল আহসান, এসবি মনিরুল ইসলাম, তারেক সিদ্দিকী, বিচারপাতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ড. জাফর ইকবাল প্রমুখ।

অভিযোগে বলা হয়েছে, বিচারপতি মানিক আন্দোলনরতদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেন। শহিদ আবু সাঈদকে সন্ত্রাসী বলেন। ড. জাফর ইকবাল তার লেখনীর মধ্যদিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে ঘৃণা ছড়িয়ে দেন। তিনি লেখেন, আন্দোলনরতদের এই দেশে থাকার অধিকার নেই। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই যথেষ্ট আন্দোলন দমাতে।’ আর কারফিউ ভঙ্গ করলে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ এ আরাফাত শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্ত বলে আখ্যা দেন। প্রতি মিনিটে গুলি ছুড়লে পাঁচ বছরেও বুলেট শেষ হবে না, এমন বক্তব্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি গুলি ছুড়তে উৎসাহিত করেছেন। আসাদুজ্জামান কামাল নানা বক্তব্যে গণহত্যা চালাতে বাহিনীকে নির্দেশ দেন। আনিসুল হক ও দীপু মনি আন্দোলনরতদের স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রেতাত্মা বলে অভিহিত করেন। আকম মোজাম্মেল হক বলেছেন, এরা দুষ্কৃতিকারী। জয় ও পলক ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে গণহত্যা চালানোর প্ররোচনা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ যেভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হলো :

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে হত্যা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত হয় পিলখানা হত্যাকাণ্ড। ৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যার শিকার হন। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা করে। এতে ৬১ জন মারা যায়, যা বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে। ২০১৪ সালে মধ্যরাতে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকার। এরপর পরবর্তী দুটি নির্বাচন একভাবে আয়োজন করে। গত দেড় দশকে র্যাবকে ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষকে গুম করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে অনেকে এই বাহিনীর হাতে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রয়োগ করা হয় আইসিটি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনকে। এভাবেই একটি সরকার দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছে।