ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

পাহাড়ী জনপদে আতঙ্কের ঢেউ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৩০:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ এপ্রিল ২০২৪
  • / ১২৫ বার পড়া হয়েছে

সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’ সন্ত্রাসীদের ভয়ানক ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পার্বত্য অঞ্চলে। সংগঠনটির সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে সাড়াশি অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। কুকি চিন সন্ত্রাসীরা পাল্টা হামলা চালাতে পারে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে। কখন কোথায় কী ঘটনা ঘটে, সেই আতঙ্কে কাঁপছেন পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দারা। অতি জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। বাজার-ঘাটও প্রায় জনশূন্য। জেলা সদরেও লোকের আনাগোনা অনেকটাই কমেছে। জোরদার করা হয়েছে ব্যাংকসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানের থানচি বাজারে যৌথবাহিনী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। যে কোনো গোষ্ঠী বা দলের অপতৎপরতা দমনে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। পাশাপাশি বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এদিকে, অপহরণের দুদিন পর রুমার সোনালী ব্যাংক শাখার ম্যানেজার নিজামুদ্দিনকে গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। ম্যানেজারকে ছাড়তে কেএনএফের পক্ষ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ হোসেন।
যেভাবে উদ্ধার হলেন ব্যাংক ম্যানেজার :
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অস্ত্রধারীদের হাতে অপহরণের শিকার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। রুমায় উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে অস্ত্র ও টাকা লুট করে নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এসময় তারা ব্যাংকটির ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে ম্যানেজারকে উদ্ধারে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। মানববন্ধন করে উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। উৎকণ্ঠায় থাকা পরিবারের সদস্যরাও অক্ষত অবস্থায় নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করার আকুতি জানায়। তবে ম্যানেজারের হদিস মিলছিল না। এরইমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয় কেএনএফের পক্ষ থেকে। তখনই র‌্যাবের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের বিষয়টি জানিয়ে বলা হয়, ম্যানেজার নেজামউদ্দীন সুস্থ আছেন। পরে কেএনএফের সঙ্গে আলোচনায় যায় র‌্যাব। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে উদ্ধার করা হয়েছে অপহৃত নেজামউদ্দীনকে।
র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল এস এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দুই দিনের অভিযানের পর রুমা বাজারের পাশের এলাকা থেকে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাকে উদ্ধারে কোনো মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে র‌্যাব-১৫ সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফের কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে মধ্যস্থতা করা হয়েছে। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক লেনদেন ছাড়াই নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নেজাম উদ্দিন কক্সবাজারের চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের বাক্যারপাড়া এলাকার মৃত ইমাম উদ্দিনের ছেলে। ২০১৫ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকে যোগ দেন। ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি শাখায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ২০২১ সালে ম্যানেজার পদে পদোন্নতি ও রুমা শাখার দায়িত্ব পান। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে নেজাম তৃতীয়।
জনমনে আতঙ্ক :
রুমা সদরে সরজমিন দেখা যায়, সবার মনে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীদের বিশাল বহর আর সশস্ত্র অবস্থানের দৃশ্যে সবাই বাকরুদ্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শতাধিক অস্ত্রধারী মঙ্গলবার রাতে প্রথমে সোনালী ব্যাংকে হানা দেয়। ক্যাশিয়ারের কাছে থাকা চাবিতে ভল্ট না খোলায় ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনের সন্ধানে তারা পার্শ্ববর্তী মসজিদে যায়। সেখান থেকে তাকে ব্যাংকে নিয়ে যায়; কিন্তু চাবি না পেয়ে নেজামকে তুলে নিয়ে পাহাড়ি সড়কে হেঁটে চলে যায়। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে তারা সোনালী ব্যাংকে হামলা করে। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে অস্ত্র কেড়ে নেয়। পরে নেজামকে অক্ষত উদ্ধার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার দাবিতে বুধবার বেলা ১১টার দিকে রুমা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে মানববন্ধনও করে উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। রুমা থানার ওসি মো. শাহজাহান জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। পাহাড়ে নববর্ষ ও ঈদের আগে দুই উপজেলায় এমন ঘটনায় ভয় ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য তিন জেলার ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জড়িত সবার মধ্যে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে প্রতিটি ব্যাংকই তাদের শাখাকে সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। বান্দরবানে তিন উপজেলার সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার শাখা বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া জেলার সব ব্যাংকে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে।
সোনালী ব্যাংক বান্দরবান শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি জানান, নিরাপত্তার কারণে আমরা সকাল থেকেই সাময়িকভাবে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি সোনালী ব্যাংকের ৩ শাখার কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি; তবে অন্য সব শাখা খোলা রয়েছে। ব্যাংকে চুরি, ছিনতাই ও জঙ্গি হামলা প্রতিরোধসহ সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ। এখন থেকে সব ব্যাংকে পুলিশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জেলার বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, পুলিশ সুপার মুক্তা ধরসহ বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।’
এদিকে, গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন হঠাৎ তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তা আমাদের জানা ছিল না। আসাদুজ্জামান খান বলেন, কুকি-চিনের আস্তানা র‌্যাব ও আর্মি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। পরে আমাদের সীমানা পার হয়ে তারা ভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। সেখানেই তারা অবস্থান করছিল। এখন তারা কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে! মাঝে মধ্যে তাদের প্রতিনিধিরা আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা শান্তি চান বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে আক্রমণ ও ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা আমাদের কাছে নতুন কিছু মনে হচ্ছে।
শান্তি আলোচনা স্থগিত ঘোষণা :
বান্দরবানে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। গতকাল সকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের উপস্থিতিতে অরুণ সারকী টাউন হলে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৯ জুন স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফর মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের পর উভয় পক্ষের মতামতের ভিক্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দুই দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফর সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয়সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। কমিটির তরফ থেকে এ বিষয়টির ব্যাপারে বারবার অবগত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বরং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, অপরহণসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে।
থানচিতে জিম্মি হয়েছিল ৪০ জন :
বান্দরবানের থানচিতে দুটি ব্যাংক থেকে টাকা লুট হওয়ার সময় বাধা দিতে যাচ্ছিল ওসিসহ পুলিশের একটি দল। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে দুই দফা গুলি চালায় অস্ত্রধারীরা। তারা ব্যাংক কর্মকর্তা, ২ বিজিবি সদস্য, ৯ জন পুলিশ সদস্য ও ব্যাংকে আসা লোকজনসহ প্রায় ৪০ জনকে জিম্মি করে। পুলিশ গুলি চালালে জিম্মিদের গুলি করার হুমকি দেয়া হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় না দিলে অনেক লাশ পড়ত। গতকাল থানচি উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের দুটি শাখার সামনে গিয়ে দেখা যায় সতর্ক পাহারায় রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি জসীমউদ্দীন বলেন, ব্যাংক লুটের খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন থানার প্রধান ফটকের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। একই সঙ্গে থানার পেছন দিক থেকেও গুলি করা হয়। পরে বিকল্প পথে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ব্যাংকের সামনে যখন যাই, ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা টাকা নিয়ে চলে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, আমরা জানতে পারি দুটি ব্যাংকের ভেতরে ব্যাংক কর্মকর্তা, টাকা তুলতে আসা দুই বিজিবি সদস্য, পুলিশ সদস্য, ব্যাংকের গ্রাহকসহ ৪০ জনকে জিম্মি করে রেখেছে অস্ত্রধারীরা। এসব লোককে বাঁচাতে পুলিশ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

পাহাড়ী জনপদে আতঙ্কের ঢেউ

আপলোড টাইম : ০৯:৩০:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ এপ্রিল ২০২৪

সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’ সন্ত্রাসীদের ভয়ানক ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পার্বত্য অঞ্চলে। সংগঠনটির সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে সাড়াশি অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। কুকি চিন সন্ত্রাসীরা পাল্টা হামলা চালাতে পারে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে। কখন কোথায় কী ঘটনা ঘটে, সেই আতঙ্কে কাঁপছেন পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দারা। অতি জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। বাজার-ঘাটও প্রায় জনশূন্য। জেলা সদরেও লোকের আনাগোনা অনেকটাই কমেছে। জোরদার করা হয়েছে ব্যাংকসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানের থানচি বাজারে যৌথবাহিনী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। যে কোনো গোষ্ঠী বা দলের অপতৎপরতা দমনে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। পাশাপাশি বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এদিকে, অপহরণের দুদিন পর রুমার সোনালী ব্যাংক শাখার ম্যানেজার নিজামুদ্দিনকে গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। ম্যানেজারকে ছাড়তে কেএনএফের পক্ষ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ হোসেন।
যেভাবে উদ্ধার হলেন ব্যাংক ম্যানেজার :
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অস্ত্রধারীদের হাতে অপহরণের শিকার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। রুমায় উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে অস্ত্র ও টাকা লুট করে নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এসময় তারা ব্যাংকটির ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে ম্যানেজারকে উদ্ধারে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। মানববন্ধন করে উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। উৎকণ্ঠায় থাকা পরিবারের সদস্যরাও অক্ষত অবস্থায় নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করার আকুতি জানায়। তবে ম্যানেজারের হদিস মিলছিল না। এরইমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয় কেএনএফের পক্ষ থেকে। তখনই র‌্যাবের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের বিষয়টি জানিয়ে বলা হয়, ম্যানেজার নেজামউদ্দীন সুস্থ আছেন। পরে কেএনএফের সঙ্গে আলোচনায় যায় র‌্যাব। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে উদ্ধার করা হয়েছে অপহৃত নেজামউদ্দীনকে।
র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল এস এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দুই দিনের অভিযানের পর রুমা বাজারের পাশের এলাকা থেকে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাকে উদ্ধারে কোনো মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে র‌্যাব-১৫ সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফের কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে মধ্যস্থতা করা হয়েছে। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক লেনদেন ছাড়াই নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নেজাম উদ্দিন কক্সবাজারের চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের বাক্যারপাড়া এলাকার মৃত ইমাম উদ্দিনের ছেলে। ২০১৫ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকে যোগ দেন। ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি শাখায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ২০২১ সালে ম্যানেজার পদে পদোন্নতি ও রুমা শাখার দায়িত্ব পান। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে নেজাম তৃতীয়।
জনমনে আতঙ্ক :
রুমা সদরে সরজমিন দেখা যায়, সবার মনে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীদের বিশাল বহর আর সশস্ত্র অবস্থানের দৃশ্যে সবাই বাকরুদ্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শতাধিক অস্ত্রধারী মঙ্গলবার রাতে প্রথমে সোনালী ব্যাংকে হানা দেয়। ক্যাশিয়ারের কাছে থাকা চাবিতে ভল্ট না খোলায় ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনের সন্ধানে তারা পার্শ্ববর্তী মসজিদে যায়। সেখান থেকে তাকে ব্যাংকে নিয়ে যায়; কিন্তু চাবি না পেয়ে নেজামকে তুলে নিয়ে পাহাড়ি সড়কে হেঁটে চলে যায়। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে তারা সোনালী ব্যাংকে হামলা করে। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে অস্ত্র কেড়ে নেয়। পরে নেজামকে অক্ষত উদ্ধার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার দাবিতে বুধবার বেলা ১১টার দিকে রুমা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে মানববন্ধনও করে উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। রুমা থানার ওসি মো. শাহজাহান জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। পাহাড়ে নববর্ষ ও ঈদের আগে দুই উপজেলায় এমন ঘটনায় ভয় ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য তিন জেলার ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জড়িত সবার মধ্যে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে প্রতিটি ব্যাংকই তাদের শাখাকে সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। বান্দরবানে তিন উপজেলার সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার শাখা বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া জেলার সব ব্যাংকে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে।
সোনালী ব্যাংক বান্দরবান শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি জানান, নিরাপত্তার কারণে আমরা সকাল থেকেই সাময়িকভাবে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি সোনালী ব্যাংকের ৩ শাখার কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি; তবে অন্য সব শাখা খোলা রয়েছে। ব্যাংকে চুরি, ছিনতাই ও জঙ্গি হামলা প্রতিরোধসহ সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ। এখন থেকে সব ব্যাংকে পুলিশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জেলার বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, পুলিশ সুপার মুক্তা ধরসহ বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।’
এদিকে, গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন হঠাৎ তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তা আমাদের জানা ছিল না। আসাদুজ্জামান খান বলেন, কুকি-চিনের আস্তানা র‌্যাব ও আর্মি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। পরে আমাদের সীমানা পার হয়ে তারা ভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। সেখানেই তারা অবস্থান করছিল। এখন তারা কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে! মাঝে মধ্যে তাদের প্রতিনিধিরা আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা শান্তি চান বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে আক্রমণ ও ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা আমাদের কাছে নতুন কিছু মনে হচ্ছে।
শান্তি আলোচনা স্থগিত ঘোষণা :
বান্দরবানে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। গতকাল সকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের উপস্থিতিতে অরুণ সারকী টাউন হলে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৯ জুন স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফর মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের পর উভয় পক্ষের মতামতের ভিক্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দুই দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফর সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয়সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। কমিটির তরফ থেকে এ বিষয়টির ব্যাপারে বারবার অবগত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বরং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, অপরহণসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে।
থানচিতে জিম্মি হয়েছিল ৪০ জন :
বান্দরবানের থানচিতে দুটি ব্যাংক থেকে টাকা লুট হওয়ার সময় বাধা দিতে যাচ্ছিল ওসিসহ পুলিশের একটি দল। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে দুই দফা গুলি চালায় অস্ত্রধারীরা। তারা ব্যাংক কর্মকর্তা, ২ বিজিবি সদস্য, ৯ জন পুলিশ সদস্য ও ব্যাংকে আসা লোকজনসহ প্রায় ৪০ জনকে জিম্মি করে। পুলিশ গুলি চালালে জিম্মিদের গুলি করার হুমকি দেয়া হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় না দিলে অনেক লাশ পড়ত। গতকাল থানচি উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের দুটি শাখার সামনে গিয়ে দেখা যায় সতর্ক পাহারায় রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি জসীমউদ্দীন বলেন, ব্যাংক লুটের খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন থানার প্রধান ফটকের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। একই সঙ্গে থানার পেছন দিক থেকেও গুলি করা হয়। পরে বিকল্প পথে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ব্যাংকের সামনে যখন যাই, ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা টাকা নিয়ে চলে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, আমরা জানতে পারি দুটি ব্যাংকের ভেতরে ব্যাংক কর্মকর্তা, টাকা তুলতে আসা দুই বিজিবি সদস্য, পুলিশ সদস্য, ব্যাংকের গ্রাহকসহ ৪০ জনকে জিম্মি করে রেখেছে অস্ত্রধারীরা। এসব লোককে বাঁচাতে পুলিশ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।