ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর বাংলাদেশের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৮:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ২৫ বার পড়া হয়েছে

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। দেশের পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতে সই করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক চলাকালে গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক এই কনভেনশনে তিনি সই করেন। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা করতালি দিয়ে গুমবিরোধী সনদে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার ক্ষণকে স্বাগত জানান। এসময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’ উল্লেখ্য, আজ ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস, এর আগের দিন এই সনদে যুক্ত হলো বাংলাদেশ।
এদিকে, উপদেষ্টা পরিষদের গতকালের বৈঠকে ‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ রহিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা এখন থেকে আর বিশেষ নিরাপত্তা পাবেন না। বৈঠকে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী বা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স আইন, ২০২১ সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এতে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার বিধানটি যুক্ত করা হবে।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর:
‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স’-এ বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব গতকাল অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই চুক্তিতে বাংলাদেশের সইয়ের উদ্যোগটি নেয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারমূলক বিষয়সমূহের অন্যতম হলো প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স’ (আইসিপিপিইডি) শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি জাতিসংঘের আওতাধীন একমাত্র আন্তর্জাতিক কনভেনশন, যা বলপূর্বক গুমকে কেন্দ্র করে গৃহীত হয়েছে। যার লক্ষ্য হলো জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম প্রতিরোধ করা, ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
উল্লেখ্য, গুমবিরোধী সনদটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এতে অনুস্বাক্ষর করে। পরে ২০১০ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য গুম বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৫টি দেশ এই সনদে যুক্ত হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন কমিটি গঠন করে ২৭ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ সালের ক্ষমতাবলে এই কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এ কমিশন।’
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তা পাবেন না:
‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ রহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ আইনটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আরো বলা হয়, বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ (২০০৯ সালের ৬৩ নম্বর আইন) প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালের ১৫ মে ঐ আইন অনুসারে বিশেষ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি দেওয়ার গেজেট জারি করা হয়। কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি করা হয়েছিল, যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য।
বৈষম্যমূলক হওয়ায় এটা রহিত করা হয়েছে :রিজওয়ানা হাসান
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে শেষে যমুনার সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের এই সরকারটা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আউটকাম। নিরাপত্তা সংস্থা এরকম বিশেষ নিরাপত্তার দরকার আছে বলে মনে করে না। আর এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেটির ভিত্তিতে এটা রহিত করা হয়েছে।’
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল:
কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার বিষয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৯ জুন ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘অর্থবিল, ২০২৪’ পাস হয়েছিল।
বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী আইন সংশোধন হচ্ছে, যুক্ত হবে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার বিধান:
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী বা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স আইন, ২০২১ সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, আইনটি সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ‘জাতির পিতা বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পরিবারের সদস্যগণ’ এবং কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়। গত ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টার সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১’-এর আওতায় প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এছাড়া, বিদ্যমান আইনের আওতায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পরিবারের সদস্যগণের’ নিরাপত্তা প্রদান সংক্রান্ত বিধানগুলো প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। ফলে তা বাতিল করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। ওই আইনের কিছু বিধান বিলোপসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি সংযোজন করে ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৪’ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়।
জাতিসংঘের গভীর সমুদ্রবিষয়ক চুক্তিতে অনুসমর্থন:
সমুদ্র রক্ষা এবং গভীর সাগরে সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ‘বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি অব এরিয়াস বিয়ন্ড ন্যাশনাল জুরিসডিকশন’ (বিবিএনজে) চুক্তিতে অনুসমর্থনের প্রস্তাবও গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর এই চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ। চুক্তির মাধ্যমে সবাইকে গভীর সমুদ্রে ভাসমান সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। জাতিসংঘের এ চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে-মেরিন প্রটেকটেড অঞ্চলে সম্পদ আহরণ করা যাবে না, উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে গভীর সমুদ্রে সম্পদ আহরণ করতে পারে, সেজন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে, অতিরিক্ত মাত্রায় মাছ ধরা যাবে না, পরিবেশের ওপর প্রভাব পর্যালোচনা করতে হবে, সমুদ্রদূষণ রোধ করতে হবে এবং গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে। গভীর সমুদ্রের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বিনির্মাণ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তাকে চুক্তিতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর বাংলাদেশের

আপলোড টাইম : ১০:৩৮:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৪

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। দেশের পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতে সই করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক চলাকালে গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক এই কনভেনশনে তিনি সই করেন। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা করতালি দিয়ে গুমবিরোধী সনদে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার ক্ষণকে স্বাগত জানান। এসময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’ উল্লেখ্য, আজ ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস, এর আগের দিন এই সনদে যুক্ত হলো বাংলাদেশ।
এদিকে, উপদেষ্টা পরিষদের গতকালের বৈঠকে ‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ রহিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা এখন থেকে আর বিশেষ নিরাপত্তা পাবেন না। বৈঠকে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী বা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স আইন, ২০২১ সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এতে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার বিধানটি যুক্ত করা হবে।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর:
‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স’-এ বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব গতকাল অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই চুক্তিতে বাংলাদেশের সইয়ের উদ্যোগটি নেয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারমূলক বিষয়সমূহের অন্যতম হলো প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স’ (আইসিপিপিইডি) শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি জাতিসংঘের আওতাধীন একমাত্র আন্তর্জাতিক কনভেনশন, যা বলপূর্বক গুমকে কেন্দ্র করে গৃহীত হয়েছে। যার লক্ষ্য হলো জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম প্রতিরোধ করা, ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
উল্লেখ্য, গুমবিরোধী সনদটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এতে অনুস্বাক্ষর করে। পরে ২০১০ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য গুম বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৫টি দেশ এই সনদে যুক্ত হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন কমিটি গঠন করে ২৭ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ সালের ক্ষমতাবলে এই কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এ কমিশন।’
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তা পাবেন না:
‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ রহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ আইনটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আরো বলা হয়, বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ (২০০৯ সালের ৬৩ নম্বর আইন) প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালের ১৫ মে ঐ আইন অনুসারে বিশেষ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি দেওয়ার গেজেট জারি করা হয়। কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি করা হয়েছিল, যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য।
বৈষম্যমূলক হওয়ায় এটা রহিত করা হয়েছে :রিজওয়ানা হাসান
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে শেষে যমুনার সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের এই সরকারটা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আউটকাম। নিরাপত্তা সংস্থা এরকম বিশেষ নিরাপত্তার দরকার আছে বলে মনে করে না। আর এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেটির ভিত্তিতে এটা রহিত করা হয়েছে।’
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল:
কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার বিষয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৯ জুন ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘অর্থবিল, ২০২৪’ পাস হয়েছিল।
বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী আইন সংশোধন হচ্ছে, যুক্ত হবে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার বিধান:
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী বা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স আইন, ২০২১ সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, আইনটি সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ‘জাতির পিতা বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পরিবারের সদস্যগণ’ এবং কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়। গত ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টার সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১’-এর আওতায় প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এছাড়া, বিদ্যমান আইনের আওতায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পরিবারের সদস্যগণের’ নিরাপত্তা প্রদান সংক্রান্ত বিধানগুলো প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। ফলে তা বাতিল করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। ওই আইনের কিছু বিধান বিলোপসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি সংযোজন করে ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৪’ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়।
জাতিসংঘের গভীর সমুদ্রবিষয়ক চুক্তিতে অনুসমর্থন:
সমুদ্র রক্ষা এবং গভীর সাগরে সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ‘বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি অব এরিয়াস বিয়ন্ড ন্যাশনাল জুরিসডিকশন’ (বিবিএনজে) চুক্তিতে অনুসমর্থনের প্রস্তাবও গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর এই চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ। চুক্তির মাধ্যমে সবাইকে গভীর সমুদ্রে ভাসমান সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। জাতিসংঘের এ চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে-মেরিন প্রটেকটেড অঞ্চলে সম্পদ আহরণ করা যাবে না, উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে গভীর সমুদ্রে সম্পদ আহরণ করতে পারে, সেজন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে, অতিরিক্ত মাত্রায় মাছ ধরা যাবে না, পরিবেশের ওপর প্রভাব পর্যালোচনা করতে হবে, সমুদ্রদূষণ রোধ করতে হবে এবং গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে। গভীর সমুদ্রের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বিনির্মাণ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তাকে চুক্তিতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।