ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

কলকাতায় এমপি আনারকে টুকরো টুকরো করে নৃশংভাবে হত্যা

শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা, তিনজন গ্রেপ্তার, শোকে স্তব্ধ কালীগঞ্জ উপজেলা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৩৬:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪
  • / ৯২ বার পড়া হয়েছে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে ৯ দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল বুধবার সকালে তার হত্যাকাণ্ডের কথা নিশ্চিত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা সম্প্রতি ভারতের কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় নিহত আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। দণ্ডবিধি ৩৬৪/৩৪ ধারায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এর আগে গত ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় তার পূর্বপরিচিত বন্ধুসম্পর্কীয় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। গোপালের সঙ্গে তার ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক। ১৩ মে বেলা ২টার দিকে আনোয়ারুল চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন। তখন গোপালকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসবেন। এরপর আর বাসায় না ফেরার কারণে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় গোপাল বিশ্বাস একটি সাধারণ ডায়ারি (জিডি) করেন।

যেভাবে এমপি আজিমকে হত্যা করা হয়:

গতকাল বুধবার দুপুরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার উপনগরী নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া এক-এ সঞ্জীব গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে ব্যারাকপুর পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। পুলিশের একটি তদন্তকারী দল সেখানে যায়। অনেকক্ষণ ধরে তারা সেখানে তদন্তের কাজ চালায়। ওই ফ্ল্যাটের মেঝে রক্তাক্ত দেখতে পায়। ওই অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করে পুলিশ। ভিডিও ফুটেজে দেখতে পায়, একজন নারীসহ চারজন প্রবেশ করেন ওই অ্যাপার্টমেন্টে। এর কিছু সময় পর একটি ট্যাক্সি ক্যাবে করে তিনজনকে বের হতে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এমপি আজিমকে হত্যার পর তার লাশ কয়েক টুকরা করে ঐ ট্যাক্সি ক্যাবে করে গোপন কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডির আইজি অখিলেশ বলেন, ‘আনোয়ারুল আজিমের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তদন্ত চলছিল। তার মধ্যে বুধবার আমরা জানতে পারি, তাকে খুন করা হয়েছে। শেষবার যেখানে তাকে দেখা গিয়েছিল, সেই জায়গাটি স্থানীয় থানা খুঁজে বের করে সিআইডিকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়।’ ব্যারাকপুর পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঐ অ্যাপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে কয়েকজন ঐ আবাসনে ঢুকছেন। পরে তারা সেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চলে যায়। কিন্তু আনোয়ারুল আজিম যাননি।

ব্যারাকপুর পুলিশের সূত্র জানাচ্ছে, আবাসনের একটি ফ্ল্যাটে তারা রক্তের দাগ পেয়েছেন। পুলিশের সন্দেহ, সেটা আনোয়ারুল আজিমের হতে পারে। পুরো জায়গাটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। তারা আনোয়ারুল আজিমের দেহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। যে ফ্ল্যাটে তল্লাশি হয়েছে, সেটা কলকাতার একজন কাস্টমস কর্মকর্তার। তিনি ফ্ল্যাটটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামানকে ভাড়া দিয়েছিলেন বলে সূত্র জানায়। এখানে কেন আনোয়ারুল আজিম থাকলেন তা পুলিশ জানতে পারেনি।

আনার খুনে বাংলাদেশিরা জড়িত : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের খুনের সংবাদ প্রকাশের পর গতকাল বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বুধবার সকালে ভারতীয় পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, এমপি আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় আমাদের বাংলাদেশের মানুষ জড়িত। ভারতীয় পুলিশ যে তথ্য আমাদের দিয়েছিল সে তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ তিনজন অপরাধীকে ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তদন্ত চলছে।’ ঝিনাইদহ সন্ত্রাসপূর্ণ সীমান্ত এলাকা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আনার সাহেব এবারও সেখান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য তিনি ভারতে যাওয়ার পরে এ ঘটনাটি ঘটে। বাংলাদেশ পুলিশ এ নিয়ে কাজ করছে, শিগিগর খুনের মোটিভ নিয়ে জানাতে পারব। ভারতীয় পুলিশ আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। এ বিষয়ে যা যা করা দরকার আমরা সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মরদেহ আমাদের হাতে এখনো আসেনি। দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে সবগুলো প্রকাশ করছি না। তদন্তের স্বার্থে এখন আমরা অনেক কিছুই বলব না। কোথায় খুন হয়েছে, কীভাবে খুন হয়েছে, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে তদন্ত শেষে সবকিছু জানানো হবে। ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, এমপি আনার খুন হয়েছেন এটি নিশ্চিত। খুনের পেছনে কী কারণ তা পরে জানাব।’

হত্যার বিচারে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চান আজিমের মেয়ে:

বাবা হত্যার খবর পেয়ে বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে যান নিহত আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে ডরিন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। আশা করি এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহায্য করবেন।’ বাবা নিহতের ঘটনায় স্থানীয় কাউকে সন্দেহ করছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আমি এখনো এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। আমি এতিম হয়ে গেছি। আপনারা সারা বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে দিন। আমি শুধু আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন। আমিও তো আইন নিয়ে পড়ি। আমি শুধু দেখতে চাই আমার বাবার হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে। ১৪ বছর আমার বাবা নানা মিথ্যা মামলায় হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। আমি নিজ চোখে দেখতে চাই কারা আমাকে এতিম করল।’

যে ফ্ল্যাটে খুন হয়েছে, সেখানে লাশ পাওয়া যায়নি : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এমপি আনোয়ার সাহেবের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। কলকাতা পুলিশ যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে, সেখানে কোনো লাশ খুঁজে পায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ডিবি আটক করেছে, কলকাতা পুলিশও দুই জনকে আটক করেছে। কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। আমরা কলকাতায় আমাদের উপহাইকমিশনের মাধ্যমে খোঁজ রাখছি। মিশন কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কালীগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি পারিবারিক, আর্থিক, না কি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি।’ গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সংসদ ভবন এলাকা থেকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। এ জন্য এ ঘটনায় শেরে বাংলা নগর থানায় মামলা হয়েছে।

শোকে স্তব্ধ কালীগঞ্জ:

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নিহত হওয়ার খবর গতকাল বুধবার সালে তার নিজ নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছালে আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা কালীগঞ্জ। শোকে কাতর হতবিহবল নেতা-কর্মীরা ছুটে আসেন তার ভুষন পাইলট স্কুলপাড়ার বাড়িতে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা কালীগঞ্জ শহর শোকাতুর হয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি অনেক নেতা-কর্মীকে বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখা যায়। দেশ স্বাধীনের পর ভারতের মাটিতে একজন বাংলাদেশী এমপি খুনের বিচার দাবী করেন কালীগঞ্জের নেতা-কর্মীরা। তারা ভারতের কাছে খুনের জবাবও চেয়েছেন।

ঢাকায় অবস্থানরত এমপির ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন পিতার মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, যার বাবা নেই, তার দুনিয়ায় কেউ নেই। আমার বাবাকে কেন খুন করা হলো তার জবাব চাই। ছোট বেলায় আমার বাবাকে কাছে পায়নি। কারণ তিনি মামলা হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। এখন বড় হয়ে বাবাকে আর কাছে পাবো না। ঘাতকরা আমাকে এতিম করে দিয়েছে। আমি ঘাতকদের ফাঁসি দেখতে চাই। তিনি কারো সন্দেহ করছেন না বলেও জানান।

কালীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের নেতা মাসুদুর রহমান মণ্টু বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আনোয়ারুল আজিম আনার নিরহংকার মানুষ ছিলেন। তিনি রাতদিন মোটরসাইকেলে ঘুরেছেন। তিনি কাউকে কোনোদিন শত্রু মনে করেননি। মানুষের উপকার ছাড়া তিনি কারো ক্ষতি করেননি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এ ঘটনার সঙ্গে আমাদের দেশের লোক জড়িত। কালীগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বিজু জানান, তিনি ভালোবাসা দিয়ে কালীগঞ্জের মানুষের মন জয় করেছিলেন। মানুষের দুঃখে ছুটে যেতেন। সেক্ষেত্রে রাতদিন ছিল না।

কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী বলেন, কালীগঞ্জবাসী একজন বন্ধু, ভালো পিতা সর্বপরি একজন অভিভাবককে হারালেন। তিনি বলেন, এভাবে তাকে যে খুন করা হবে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। তাকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত ও বাকরুদ্ধ। তিনি এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করেন। কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমাদের সোনার জামাই কীভাবে চলে গেল। তার টাকা-পয়সা সবকিছু নিয়ে যেত, আমাদের জামাইকে ফিরিয়ে দিত। কেন এভাবে নিয়ে গেল। সে তো কাউকে ক্ষতি করেনি। তাকে কেন মেরে ফেলা হলো। আমরা এর বিচার চাই”। গতকাল বুধবার দুপুরে এমপির বাসভবনের নীচে এভাবেই বিলাপ করছিলেন তিনি। এমপি আনারের বাড়ির সিঁড়িতে বসে বিলাপ করছিলেন, রুবেল হোসেন নামে এক কর্মী। তিনি বলেন, ভারত যাওয়ার আগে তার সাথে শেষ কথা হয়। এসময় এমপি তাকে বলেছিলেন গরিব মানুষের চেকগুলো তুলে রাখ। আমি ফিরে এসে বিতরণ করব। ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল এক শোক বার্তায় উল্লেখ করেছেন, আনোয়ারুল আজিম আনার একজন সজ্জন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

কলকাতায় এমপি আনারকে টুকরো টুকরো করে নৃশংভাবে হত্যা

শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা, তিনজন গ্রেপ্তার, শোকে স্তব্ধ কালীগঞ্জ উপজেলা

আপলোড টাইম : ০৮:৩৬:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে ৯ দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল বুধবার সকালে তার হত্যাকাণ্ডের কথা নিশ্চিত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা সম্প্রতি ভারতের কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় নিহত আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। দণ্ডবিধি ৩৬৪/৩৪ ধারায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এর আগে গত ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় তার পূর্বপরিচিত বন্ধুসম্পর্কীয় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। গোপালের সঙ্গে তার ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক। ১৩ মে বেলা ২টার দিকে আনোয়ারুল চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন। তখন গোপালকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসবেন। এরপর আর বাসায় না ফেরার কারণে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় গোপাল বিশ্বাস একটি সাধারণ ডায়ারি (জিডি) করেন।

যেভাবে এমপি আজিমকে হত্যা করা হয়:

গতকাল বুধবার দুপুরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার উপনগরী নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া এক-এ সঞ্জীব গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে ব্যারাকপুর পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। পুলিশের একটি তদন্তকারী দল সেখানে যায়। অনেকক্ষণ ধরে তারা সেখানে তদন্তের কাজ চালায়। ওই ফ্ল্যাটের মেঝে রক্তাক্ত দেখতে পায়। ওই অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করে পুলিশ। ভিডিও ফুটেজে দেখতে পায়, একজন নারীসহ চারজন প্রবেশ করেন ওই অ্যাপার্টমেন্টে। এর কিছু সময় পর একটি ট্যাক্সি ক্যাবে করে তিনজনকে বের হতে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এমপি আজিমকে হত্যার পর তার লাশ কয়েক টুকরা করে ঐ ট্যাক্সি ক্যাবে করে গোপন কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডির আইজি অখিলেশ বলেন, ‘আনোয়ারুল আজিমের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তদন্ত চলছিল। তার মধ্যে বুধবার আমরা জানতে পারি, তাকে খুন করা হয়েছে। শেষবার যেখানে তাকে দেখা গিয়েছিল, সেই জায়গাটি স্থানীয় থানা খুঁজে বের করে সিআইডিকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়।’ ব্যারাকপুর পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঐ অ্যাপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে কয়েকজন ঐ আবাসনে ঢুকছেন। পরে তারা সেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চলে যায়। কিন্তু আনোয়ারুল আজিম যাননি।

ব্যারাকপুর পুলিশের সূত্র জানাচ্ছে, আবাসনের একটি ফ্ল্যাটে তারা রক্তের দাগ পেয়েছেন। পুলিশের সন্দেহ, সেটা আনোয়ারুল আজিমের হতে পারে। পুরো জায়গাটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। তারা আনোয়ারুল আজিমের দেহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। যে ফ্ল্যাটে তল্লাশি হয়েছে, সেটা কলকাতার একজন কাস্টমস কর্মকর্তার। তিনি ফ্ল্যাটটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামানকে ভাড়া দিয়েছিলেন বলে সূত্র জানায়। এখানে কেন আনোয়ারুল আজিম থাকলেন তা পুলিশ জানতে পারেনি।

আনার খুনে বাংলাদেশিরা জড়িত : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের খুনের সংবাদ প্রকাশের পর গতকাল বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বুধবার সকালে ভারতীয় পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, এমপি আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় আমাদের বাংলাদেশের মানুষ জড়িত। ভারতীয় পুলিশ যে তথ্য আমাদের দিয়েছিল সে তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ তিনজন অপরাধীকে ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তদন্ত চলছে।’ ঝিনাইদহ সন্ত্রাসপূর্ণ সীমান্ত এলাকা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আনার সাহেব এবারও সেখান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য তিনি ভারতে যাওয়ার পরে এ ঘটনাটি ঘটে। বাংলাদেশ পুলিশ এ নিয়ে কাজ করছে, শিগিগর খুনের মোটিভ নিয়ে জানাতে পারব। ভারতীয় পুলিশ আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। এ বিষয়ে যা যা করা দরকার আমরা সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মরদেহ আমাদের হাতে এখনো আসেনি। দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে সবগুলো প্রকাশ করছি না। তদন্তের স্বার্থে এখন আমরা অনেক কিছুই বলব না। কোথায় খুন হয়েছে, কীভাবে খুন হয়েছে, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে তদন্ত শেষে সবকিছু জানানো হবে। ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, এমপি আনার খুন হয়েছেন এটি নিশ্চিত। খুনের পেছনে কী কারণ তা পরে জানাব।’

হত্যার বিচারে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চান আজিমের মেয়ে:

বাবা হত্যার খবর পেয়ে বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে যান নিহত আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে ডরিন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। আশা করি এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহায্য করবেন।’ বাবা নিহতের ঘটনায় স্থানীয় কাউকে সন্দেহ করছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আমি এখনো এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। আমি এতিম হয়ে গেছি। আপনারা সারা বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে দিন। আমি শুধু আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন। আমিও তো আইন নিয়ে পড়ি। আমি শুধু দেখতে চাই আমার বাবার হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে। ১৪ বছর আমার বাবা নানা মিথ্যা মামলায় হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। আমি নিজ চোখে দেখতে চাই কারা আমাকে এতিম করল।’

যে ফ্ল্যাটে খুন হয়েছে, সেখানে লাশ পাওয়া যায়নি : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এমপি আনোয়ার সাহেবের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। কলকাতা পুলিশ যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে, সেখানে কোনো লাশ খুঁজে পায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ডিবি আটক করেছে, কলকাতা পুলিশও দুই জনকে আটক করেছে। কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। আমরা কলকাতায় আমাদের উপহাইকমিশনের মাধ্যমে খোঁজ রাখছি। মিশন কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কালীগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি পারিবারিক, আর্থিক, না কি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি।’ গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সংসদ ভবন এলাকা থেকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। এ জন্য এ ঘটনায় শেরে বাংলা নগর থানায় মামলা হয়েছে।

শোকে স্তব্ধ কালীগঞ্জ:

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নিহত হওয়ার খবর গতকাল বুধবার সালে তার নিজ নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছালে আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা কালীগঞ্জ। শোকে কাতর হতবিহবল নেতা-কর্মীরা ছুটে আসেন তার ভুষন পাইলট স্কুলপাড়ার বাড়িতে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা কালীগঞ্জ শহর শোকাতুর হয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি অনেক নেতা-কর্মীকে বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখা যায়। দেশ স্বাধীনের পর ভারতের মাটিতে একজন বাংলাদেশী এমপি খুনের বিচার দাবী করেন কালীগঞ্জের নেতা-কর্মীরা। তারা ভারতের কাছে খুনের জবাবও চেয়েছেন।

ঢাকায় অবস্থানরত এমপির ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন পিতার মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, যার বাবা নেই, তার দুনিয়ায় কেউ নেই। আমার বাবাকে কেন খুন করা হলো তার জবাব চাই। ছোট বেলায় আমার বাবাকে কাছে পায়নি। কারণ তিনি মামলা হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। এখন বড় হয়ে বাবাকে আর কাছে পাবো না। ঘাতকরা আমাকে এতিম করে দিয়েছে। আমি ঘাতকদের ফাঁসি দেখতে চাই। তিনি কারো সন্দেহ করছেন না বলেও জানান।

কালীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের নেতা মাসুদুর রহমান মণ্টু বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আনোয়ারুল আজিম আনার নিরহংকার মানুষ ছিলেন। তিনি রাতদিন মোটরসাইকেলে ঘুরেছেন। তিনি কাউকে কোনোদিন শত্রু মনে করেননি। মানুষের উপকার ছাড়া তিনি কারো ক্ষতি করেননি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এ ঘটনার সঙ্গে আমাদের দেশের লোক জড়িত। কালীগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বিজু জানান, তিনি ভালোবাসা দিয়ে কালীগঞ্জের মানুষের মন জয় করেছিলেন। মানুষের দুঃখে ছুটে যেতেন। সেক্ষেত্রে রাতদিন ছিল না।

কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী বলেন, কালীগঞ্জবাসী একজন বন্ধু, ভালো পিতা সর্বপরি একজন অভিভাবককে হারালেন। তিনি বলেন, এভাবে তাকে যে খুন করা হবে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। তাকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত ও বাকরুদ্ধ। তিনি এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করেন। কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমাদের সোনার জামাই কীভাবে চলে গেল। তার টাকা-পয়সা সবকিছু নিয়ে যেত, আমাদের জামাইকে ফিরিয়ে দিত। কেন এভাবে নিয়ে গেল। সে তো কাউকে ক্ষতি করেনি। তাকে কেন মেরে ফেলা হলো। আমরা এর বিচার চাই”। গতকাল বুধবার দুপুরে এমপির বাসভবনের নীচে এভাবেই বিলাপ করছিলেন তিনি। এমপি আনারের বাড়ির সিঁড়িতে বসে বিলাপ করছিলেন, রুবেল হোসেন নামে এক কর্মী। তিনি বলেন, ভারত যাওয়ার আগে তার সাথে শেষ কথা হয়। এসময় এমপি তাকে বলেছিলেন গরিব মানুষের চেকগুলো তুলে রাখ। আমি ফিরে এসে বিতরণ করব। ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল এক শোক বার্তায় উল্লেখ করেছেন, আনোয়ারুল আজিম আনার একজন সজ্জন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।