ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

উপদেষ্টাদের দপ্তর রদবদল

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:৫১:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৩৭ বার পড়া হয়েছে

দায়িত্ব নেয়ার ৮ দিনের মাথায় বড় রদবদল হলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে। গতকাল শুক্রবার নতুন করে চার উপদেষ্টা শপথ নেয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই রদবদল করেন। তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে আগে থেকে দায়িত্বে থাকা ব্রি. জেনারেল (অব) এম. সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন উপদেষ্টা হয়েছেন লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এর আগে গতকাল শুক্রবার বিকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরও চার উপদেষ্টা শপথ নেন। এ নিয়ে উপদেষ্টার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। নতুন উপদেষ্টারা হলেন- অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল শুক্রবার বঙ্গভবনে নতুন উপদেষ্টাদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এসময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি তিন বাহিনীর প্রধান এবং সামরিক ও বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নতুন চার উপদেষ্টার শপথ নেয়ার পর বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে উপদেষ্টা পরিষদের দপ্তর পুনর্বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন চার উপদেষ্টাকে একাধিক মন্ত্রণালয় ও কার্যালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় এবং আলী ইমাম মজুমদারকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। নতুন করে দায়িত্ব বণ্টন ও পুনর্বণ্টনের কারণে প্রধান উপদেষ্টার হাত থেকে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় কমে গেল।
৮ উপদেষ্টার দপ্তর পুনর্বণ্টন :
উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। গতকাল তাকে অর্থের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামলানোর দায়িত্বও দেয়া হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নতুন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সামলাতে হবে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলকে। আদিলুর রহমান খানকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করবেন। ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম শুরু থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাকে নতুন করে আগের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আসিফ মাহমুদকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং ফারুক-ই-আজম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। ব্রি. জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এরও আগে তিন দফায় শপথ গ্রহণ করেন ১৭ উপদেষ্টা। এর মধ্যে ৮ আগস্ট শপথ নেন প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ১৩ উপদেষ্টা। ঢাকা ও দেশের বাইরে থাকায় তিনজন উপদেষ্টা সেদিন শপথ নেননি। পরে ১১ আগস্ট দুপুরে বঙ্গভবনে শপথ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের আরও দুই উপদেষ্টা, সুপ্রদীপ চাকমা ও বিধান রঞ্জন রায়। সবশেষ ১৩ আগস্ট শপথ নেন ফারুক-ই-আজম। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপরই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পরদিন ৬ আগস্ট ভেঙে দেয়া হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। এরপর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পরে ৯ আগস্ট শপথ নেয়া প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
নতুন শপথ নেয়া উপদেষ্টাদের মধ্যে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একজন সুপরিচিত বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ। ১৯৪৮ সালের পহেলা জুলাই নোয়াখালী জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। পরে ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপরের বছর তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি (মাস্টার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ড যান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল, এই সময়ের মাঝে তিনি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ২০১১ সালে অবসর নেন। তার শিক্ষাজীবনের মতো কর্মজীবনও বেশ বর্ণাঢ্য। ড. মাহমুদ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএন-সিডিপি) সদস্য। সেই সঙ্গে তিনি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসএএনইআই) চেয়ারম্যান। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তিনি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘ সময় এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন।
উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের জন্ম ১৯৫০ সালে। এর আগে ৭৪ বছর বয়সি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেখান থেকে তাকে এখন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বরে অবসরের আগ পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সে সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মূখ্য সচিবেরও দায়িত্বও তিনি পালন করেন। তার আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রশাসন ক্যাডারের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া আলী ইমাম মজুমদার পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবেও তিনি কাজ করছেন। আলী ইমাম মজুমদার চাকরিজীবনে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উপজেলা ও জেলায় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। কুমিল্লার সন্তান আলী ইমাম মজুমদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন।
উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও একজন সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ। তিনি ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. এম ফওজুল খান ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস অ্যাট বোস্টন, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পার্ট টাইম ও ফুলটাইম ফ্যাকাল্টি হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইউএনডিপি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একজন শীর্ষ পরামর্শক। তার বাড়ি সন্দ্বীপের হরিশপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড পাওয়ারের পরিচালনা পরিষদে ইনডিপেন্ডেন্ট পরিচালক হিসেবে আছেন।
মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা ৭১ বছর বয়সি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক ছিলেন। এরপর ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনের ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন বলে জানা যায়। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীর গঠিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন তিনি। তখন তিনি কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) ছিলেন। ওই বছরই তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। ২০১০ সালে তিনি অবসর নেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশন করেন। একজন গানার হিসেবে কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কমান্ডিং টু আর্টিলারি ব্রিগেডসসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা গেছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

উপদেষ্টাদের দপ্তর রদবদল

আপলোড টাইম : ০৫:৫১:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৪

দায়িত্ব নেয়ার ৮ দিনের মাথায় বড় রদবদল হলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে। গতকাল শুক্রবার নতুন করে চার উপদেষ্টা শপথ নেয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই রদবদল করেন। তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে আগে থেকে দায়িত্বে থাকা ব্রি. জেনারেল (অব) এম. সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন উপদেষ্টা হয়েছেন লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এর আগে গতকাল শুক্রবার বিকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরও চার উপদেষ্টা শপথ নেন। এ নিয়ে উপদেষ্টার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। নতুন উপদেষ্টারা হলেন- অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল শুক্রবার বঙ্গভবনে নতুন উপদেষ্টাদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এসময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি তিন বাহিনীর প্রধান এবং সামরিক ও বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নতুন চার উপদেষ্টার শপথ নেয়ার পর বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে উপদেষ্টা পরিষদের দপ্তর পুনর্বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন চার উপদেষ্টাকে একাধিক মন্ত্রণালয় ও কার্যালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় এবং আলী ইমাম মজুমদারকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। নতুন করে দায়িত্ব বণ্টন ও পুনর্বণ্টনের কারণে প্রধান উপদেষ্টার হাত থেকে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় কমে গেল।
৮ উপদেষ্টার দপ্তর পুনর্বণ্টন :
উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। গতকাল তাকে অর্থের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামলানোর দায়িত্বও দেয়া হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নতুন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সামলাতে হবে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলকে। আদিলুর রহমান খানকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করবেন। ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম শুরু থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাকে নতুন করে আগের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আসিফ মাহমুদকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং ফারুক-ই-আজম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। ব্রি. জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এরও আগে তিন দফায় শপথ গ্রহণ করেন ১৭ উপদেষ্টা। এর মধ্যে ৮ আগস্ট শপথ নেন প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ১৩ উপদেষ্টা। ঢাকা ও দেশের বাইরে থাকায় তিনজন উপদেষ্টা সেদিন শপথ নেননি। পরে ১১ আগস্ট দুপুরে বঙ্গভবনে শপথ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের আরও দুই উপদেষ্টা, সুপ্রদীপ চাকমা ও বিধান রঞ্জন রায়। সবশেষ ১৩ আগস্ট শপথ নেন ফারুক-ই-আজম। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপরই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পরদিন ৬ আগস্ট ভেঙে দেয়া হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। এরপর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পরে ৯ আগস্ট শপথ নেয়া প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
নতুন শপথ নেয়া উপদেষ্টাদের মধ্যে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একজন সুপরিচিত বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ। ১৯৪৮ সালের পহেলা জুলাই নোয়াখালী জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। পরে ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপরের বছর তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি (মাস্টার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ড যান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল, এই সময়ের মাঝে তিনি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ২০১১ সালে অবসর নেন। তার শিক্ষাজীবনের মতো কর্মজীবনও বেশ বর্ণাঢ্য। ড. মাহমুদ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএন-সিডিপি) সদস্য। সেই সঙ্গে তিনি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসএএনইআই) চেয়ারম্যান। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তিনি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘ সময় এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন।
উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের জন্ম ১৯৫০ সালে। এর আগে ৭৪ বছর বয়সি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেখান থেকে তাকে এখন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বরে অবসরের আগ পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সে সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মূখ্য সচিবেরও দায়িত্বও তিনি পালন করেন। তার আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রশাসন ক্যাডারের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া আলী ইমাম মজুমদার পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবেও তিনি কাজ করছেন। আলী ইমাম মজুমদার চাকরিজীবনে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উপজেলা ও জেলায় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। কুমিল্লার সন্তান আলী ইমাম মজুমদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন।
উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও একজন সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ। তিনি ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. এম ফওজুল খান ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস অ্যাট বোস্টন, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পার্ট টাইম ও ফুলটাইম ফ্যাকাল্টি হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইউএনডিপি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একজন শীর্ষ পরামর্শক। তার বাড়ি সন্দ্বীপের হরিশপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড পাওয়ারের পরিচালনা পরিষদে ইনডিপেন্ডেন্ট পরিচালক হিসেবে আছেন।
মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা ৭১ বছর বয়সি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক ছিলেন। এরপর ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনের ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন বলে জানা যায়। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীর গঠিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন তিনি। তখন তিনি কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) ছিলেন। ওই বছরই তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। ২০১০ সালে তিনি অবসর নেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশন করেন। একজন গানার হিসেবে কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কমান্ডিং টু আর্টিলারি ব্রিগেডসসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা গেছে।