- একতারপুর বাওড়ের পাশে পার্ক উন্নয়ন
- ইউএনও নিজেই বালি তুলে কাজ বাস্তবায়ন করছেন
- পিআইসি সভাপতি জানেন না কী কাজ হয়েছে
- আরেক পিআইসিকে ১১ লাখ টাকা তুলে দিতে চাপ
- টাকা তোলার পর বুঝে নিলেন ইউএনও’র অফিস স্টাফ
পার্কের উন্নয়নের নামে পিআইসির মাধ্যমে ২ লাখ টাকা উত্তোলন, আবার পিআইসির কাছ থেকে সেই টাকা ফেরত নেয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ ইউনএনও'র বিরুদ্ধে। পিআইসি ও ইউপি সদস্য বলছেন, ‘সব কাজ ইউএনও স্যার করেছেন, আমি কিছুই জানি না। টাকা তুলে ইউএনও স্যারের নামে তার অফিসের লোকের কাছেই বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।’ আর ইউএনও অফিসের কর্মচারী বলছেন, ‘টাকা প্রকল্পের। ইউএনও স্যারের হাতেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার আরেক পিআইসি ও ইউপি সদস্যকে দিয়ে একই স্থানের উন্নয়নের নামে আরও ১১ লাখ টাকা টাকা উত্তোলন করতে চাইলে, ওই ইউপি সদস্যের বিরোধিতায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সাড়ে ৫ লাখ টাকার বিল দিলেও ওই পিআইসি ইউপি সদস্য’র দাবি ব্যাংকে জমা করেননি বিলটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জীবননগর উপজেলার কেডিকে ইউনিয়নের একতারপুর বাওড়ের পাশে বেশ কয়েক বছর ধরে একটি সরকারি পার্কের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই পার্কের উন্নয়নের জন্য এডিপির মাধ্যমে কিছু কাজ চলমান রয়েছে। তবে এই পার্কের সাইড বাড়ানোর জন্য জীবননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার একতারপুর বাওড় থেকে বেশ কিছুদিন যাবৎ বালি তুলছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বালি তোলা বন্ধ করে দেন ইউএনও।
এদিকে, সরকারি বাওড় থেকে বালি তুলে পার্ক ভরাট করা হলেও সেখানে পিআইসির মাধ্যমে ২ লাখ টাকা ইতোমধ্যেই তুলে নিয়েছেন জীবননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আল-আমীন। কেডিকে ইউনিয়ন পরিষদের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য ও ওই পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পিআইসি সভাপতি স্বপ্না খাতুন বলেন, ‘দুইবারে ২ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ইউএনও সাহেব আমাকে পিআইসি বানিয়েছে। আমার হাতে টাকা-পয়সা কিছু দেয়নি। আমাকে শুধু পিআইসি করা হয়েছে, এটা আমি জানি। ওখানে কাজ হচ্ছে কি না সেটা আমি জানি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। সোহেল আমাকে বলেছে, আমাকে পিআইসি বানানো হয়েছে। তার কাছেই সব টাকা দিয়েছি। আমাকে এক টাকাও দেয়নি। একজন ইউএনও যদি বলে, আমি কী করব। তারপরও আমি ইউএনওকে বলে এসেছি, এরপর থেকে আমাদেরকে পিআইসি করবেন না। আমাদের মাথার ওপর ভেঙ্গে আপনি খাচ্ছেন, আমরা খাচ্ছি না। এর মধ্যে আমরা কী করতে পারি। আমি মহিলা মানুষ, ওতো বুঝিনি। আর আমি কোনো টাকা-পয়সা পাইনি। ইউএনও’র কাছে খোঁজ নেন।’
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের অফিস সহকারী সোহেল রানার সাথে। প্রথমে টাকার বিষয়টি অস্বীকার করলেও স্বপ্না খাতুনের নাম শোনার পর সোহেল রানা বলেন, ‘প্রকল্পটা বিভাগীয় কমিশনার স্যারের, পিআইসি স্বপ্না খাতুন। কিন্তু কাজ তো সম্পূর্ণ করছে ইউএনও স্যার। স্বপ্না খাতুনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে উপজেলা পরিষদের সিএ পিটু ভাইয়ের কাছে আমি টাকাটা দিয়েছিলাম।’ কথা বলার এক পর্যায়ে সোহেল রানা বলেন, ‘এখানে পিটু ভাই আছেন। তার সাথেই আপনি কথা বলেন।’
মুঠোফোনটি উপজেলা পরিষদের সিএ সেলিম মো. আহসানুর রহমান পিটু হাতে নিয়ে বলেন, ‘ওটা প্রকল্পের টাকা। টাকাটা আমি নিইনি। আমার নেয়ার ক্ষমতা নেই। সোহেল আমার কাছে দিয়েছে রাখার জন্য, ইউএনও স্যার রাখতে বলেছেন, এই। টাকা স্যারের কাছে আছে। ব্যয় হয়েছে কি না, বলতে পারছি না। স্যার বোধহয় প্রকল্পের কাজের টাকা শোধ করেছে আরকি।’
অপর দিকে, একই স্থান তথা ওই পার্কের উন্নয়নের নামেই কেডিকে ইউনিয়নের আরেক ইউপি সদস্য আব্বাস আলীকে একটি প্রকল্পের পিআইসি করা হয়েছে। ইউএনও মো. আল-আমীন নিজে কাজ করলেও ইউপি সদস্য আব্বাস আলীকে দিয়ে প্রকল্পের টাকা উঠানোর জন্য ইউএনও অফিস থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্ধেক ব্যয় তথা সাড়ে ৫ লাখ টাকা বিল ওঠানোর কাজগপত্র ইউপি সদস্য আব্বাস আলীকে দেয়া হয়েছে। তবে নিজে কাজ না করে আবার টাকা তুলে দেয়াটাকে নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করছেন ইউপি সদস্য আব্বাস আলী। তিনি বাধ সেধেছেন, টাকা তুলবেন না।
কেডিকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. আব্বাস আলী বলেন, ‘একতারপুর বাওড়ের পাশে যে পার্ক নির্মাণ হচ্ছে, এখানে মাটি ভরাটের জন্য পিআইও অফিস থেকে আমাকে পিআইসি করে ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু পিআইসি হিসেবে আমার নাম থাকলেও ইউএনও স্যার নিজে বাওড় থেকে বালি তুলে সেটা ভরাট করছে। এখন আমাকে উপজেলাতে ডেকেছিল এবং ওই টাকা তুলে দিতে বলছে। সাড়ে ৫ লাখ টাকার একটি কাগজ দিয়েছে। ব্যাংকে জমা দেবার জন্য। আমি সেটি জমা দিইনি। আমার দোকানে রেখে দিয়েছি। আমি বলে এসেছি, কাজের পিআইসি আমি, আমি জানি না যে কাজ শেষ হয়েছে। কীভাবে কাজ শেষ হলো? আমি কাজ না করে টাকা তুলবো না। আমি কালকে ইউএনও সারের সাথে দেখা করব। এবং তাকে বলব, আমি পিআইসি হলে আমাকে দিয়েই কাজ করাতে হবে। আপনি কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেটি দেখবেন। এভাবে টাকা তুলে দিতে পারব না।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অঞ্জন কুণ্ডু বলেন, ‘একতারপুর বাওড়ের পাশে পার্কের উন্নয়নকাজে পিআইসি ও ইউপি সদস্য স্বপ্না খাতুন দুই বারে এক লাখ টাকা মোট দুই লাখ টাকা তুলেছেন। এছাড়া আরেকজন পিআইসি ইউপি সদস্য আব্বাস আলীর বরাদ্দ ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে ৫ লাখ টাকা তোলা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জীবননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আল-আমীনের সাথে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’