৫ই আগস্টের পর দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তুলতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগকে অবৈধ অর্থের যোগান দেয়াসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলার আসামি স্বর্ণ চোরকারবারি চুয়াডাঙ্গার রিপনুল হাসানকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার তাঁতী বাজারে তার নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। রিপনুল হাসান চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের দৌলাতদিয়াড় গ্রামের মাঝেরপাড়া আব্দুল হান্নানের ছেলে। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এক ব্যক্তি নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা রয়েছে। এছাড়াও, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সংগঠিত করতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগসহ কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে অবৈধ অর্থের যোগান দেবার অভিযোগসহ কমপক্ষে চারটি মামলা রয়েছে।
মামলাগুলো হলো- ১. ডিএমপির পল্টন থানার, এফআইআর নম্বর ৩৯, তারিখ ২৯ এপ্রিল, ২০২৫; জিআর নম্বর ২০৫, ধারা- ১৪৩/১৪৪/১৪৭/১৪৮/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭/১০৯/৩৪। ২. ডিএমপির পল্টন থানার এফআইআর নম্বর ২৬, তারিখ ১৬ মার্চ, ২০২৫; জিআর নম্বর ১৩৪, ধারা- ৩০২/১৪৯/১৪৮/১৪৭/১৪৩/১২০ই/৩৪/১০৯ । ৩. ডিএমপির পল্টন থানার এফআইআর নম্বর ১৭, তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫; জিআর নম্বর ৭৯, ধারা- ৩০২/১০৯/। ৪. ডিএমপির পল্টন থানার এফআইআর নম্বর ১৬, তারিখ ০৬ মে, ২০২৫; জিআর নম্বর ২২২, ধারা- ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৫০৬/১০৯।
কে এই রিপন:
সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের কথিত ভাতিজা সেজে স্বর্ণ চোরাচালানে আধিপত্য বিস্তার করেন রিপন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণলয়ের তালিকাভুক্ত স্বর্ণ চোরাকারবারি আলী আজগারের ভাই গোল্ডেন বাবুর সাথে পার্টনারে ব্যবসা রিপনের। ছিল যোগসাজস আরেক স্বর্ণ চোরাকারবারি সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সাথে। অবৈধভাবে স্বর্ণ পাচার করে রাতারাতি ফুলে ফেপে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। ঢাকার তাঁতিবাজারে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের গহনা তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। বসুন্ধরায় রয়েছে জুয়েলারি শোরুম। কৌশলী রিপনুল হাসান দেশত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, আমলাসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে কৌশলে ছবি তুলে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতেন। ছবির অপব্যবহার করে নিয়েছেন নানা সুযোগ-সুবিধা। সাধারণ মানুষের কাছে বোঝাতে চান, তিনি বিশাল ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল চুয়াডাঙ্গায় আসলে তার সফরসঙ্গী ছিলেন রিপনুল হাসান। তার স্বর্ণ ও ডায়মন্ড ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম জুয়েলারি হাউজ। মোবাইল ব্যাংকিং নগদ এবং সিমফনি মোবাইল কোম্পানির চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার ডিস্টিবিউটরও তিনি।
পড়াশুনার জন্য ঢাকায় যান রিপন। এরপর বাবার অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে ঢাকায় থেকে যান। শুরু করেন নানা পদের ব্যবসা। ব্যবসায় লোকসান হলে হারিয়ে ফেলেন তাল। এরপর ঢাকায় প্রথমে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ৪ হাজার টাকা বেতনে, পরে এড পয়েন্ট নামে একটি ফার্মে চাকরি নেন ১০ হাজার টাকা বেতনে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসলে সে সময় মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাতারাতি বদলে যেতে থাকে ভাগ্যের চাকা। বাড়তে থাকে অবৈধ ব্যবসা। স্বর্ণ ও ডায়মন্ড ব্যবসা শুরুর পর থেকে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। এছাড়াও তদবির বাণিজ্য করে বাগিয়ে নিয়েছেন অবৈধ টাকা।
১০ হাজার টাকার কর্মচারী থেকে স্বর্ণ চোরাচালান করে রিপন এখন হয়েছেন কোটিপতি। স্বর্ণ পাচার করতেন চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও জীবননগর এবং ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্যের সহযোগিতায়। স্বর্ণ পাচার সিন্ডিকেটের মূলহোতা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন। ঢাকা থেকে আসা স্বর্ণ তার মাধ্যমে তিন সীমান্তবর্তী এলাকায় পৌঁছাতো। এরপর বাংলাদেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যেত।
রিপনুল হাসানের গ্রেপ্তারের খবরে চুয়াডাঙ্গায় মিষ্টি বিতরণ:
চুয়াডাঙ্গা শহরতলীর দৌলতদিয়ার এলাকার বাসিন্দা ও স্বর্ণ চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সহসভাপতি মো. রিপনুল হাসানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করায় চুয়াডাঙ্গায় মিষ্টি বিতরণ করেছে স্থানীয়রা। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা শহরের বড় বাজারের শহিদ হাসান চত্বরে স্থানীয়দের উদ্যোগে এই মিষ্টি বিতরণের আয়োজন করা হয়। মিষ্টি বিতরণকালে স্থানীয়রা বলেন, স্বর্ণ চোরাকারবারি রিপনুল হাসান দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে কাজ করে এসেছে। মাদক, জুয়াসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ বহু পুরনো। তারা জানান, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময় সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিল এই রিপন। অনেকেই তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও তুলেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোমিন বলেন, ‘রিপনের বিরুদ্ধে অকাজের অভিযোগের কোনো শেষ নেই। অবৈধ যত কাজ আছে সব কাজেই সে পারদর্শী। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের সময়ে হঠাৎ করেই সে কোটিপতি হয়ে যায়। অবৈধ পথে বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাসহ রাজকীয় জীবনযাপন করছিল। চুয়াডাঙ্গায় সে জুয়া, স্বর্ণ চোরাচালান আর মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। তার কারণে বহু তরুণ বিপথে গেছে। তার গ্রেপ্তারে এলাকাবাসী স্বস্তি পেয়েছে। এই আনন্দে আমরা সাধারণ মানুষ মিষ্টি বিতরণ করছি।’
এদিকে বাজুসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সহ-সভাপতি মো. রিপনুল হাসানকে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে চুয়াডাঙ্গার স্থানীয়রা বলেন, ‘সারা দেশে জুয়েলারি ব্যবসা বন্ধ থাকবে কি না জানি না, তবে চোরাকারবারি রিপনের জন্য চুয়াডাঙ্গায় কোনো ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ রাখবে না। কেউ যদি আওয়ামী লীগের এই দোসরের জন্য দোকান বন্ধ রাখে, স্থানীয়রা তা ভালো চোখে দেখবে না, বরং প্রতিবাদ জানাবে।’