নানামুখী সংকটের মধ্যেও ঈদের খুশিতে ভাসছে দেশ। এই খুশি আরও বাড়িয়ে দেয় যখন গায়ে থাকে নতুন পোশাক। আর তাই ধনী-দরিদ্র সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করে থাকেন। গত কয়েক বছর ধরেই ঈদের সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ আসন্ন। বছরের প্রথম দিনটি কত সুন্দরভাবে কাটানো যাবে সেই চেষ্টার কমতি নেই কারও। এ জন্যও করা হচ্ছে বাড়তি কেনাকাটা। উৎসব উদ্যাপনে কেনা হচ্ছে- পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল, প্রসাধনী, জুয়েলারি ও খাদ্যসহ নানাবিধ পণ্য। ব্যবসায়ীরা সারা বছর মুখিয়ে থাকেন ঈদ ও পহেলা বৈশাখের বেচা-বিক্রির জন্য। ঈদের বাজারে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্যের আশায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা। বেচাকেনা ও বিক্রি ভালো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের এক কোটি প্রবাসী মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। সেই রেমিটেন্সের জোয়ারে ভাসছে দেশ। চলতি মার্চ মাসের গত ২৬ দিনে রেমিটেন্স এসেছে প্রায় ৩ বিলিয়ন বা ২৯৫ কোটি ডলার। ঈদের আগে রেমিটেন্স আহরণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অতীতে এ রকম দেখা যায়নি। গত বছরের শুরু থেকেই নেতিবাচক ছিল অর্থনীতি। এ অবস্থায় শুরু হয় জুলাই বিপ্লব। ৫ আগস্টের পর পালটে যায় সব হিসাব-নিকাশ। বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে অর্থনীতি।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাসের চেষ্টা, রমজান ও ঈদ সামনে রেখে অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ঈদের পর পরই আছে আরেকটি উৎসব। চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনেরও আভাস আছে। এ সবই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। ফলে রমজান, ঈদ ও পহেলা বৈশাখের উৎসব ঘিরে অর্থনীতি চাঙা হয়েছে।
মূলত ঈদ ও পহেলা বৈশাখের উৎসব ঘিরে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ এসেছে ঈদকে ঘিরে। অভ্যন্তরীণ বেচাকেনায় গতি ফিরেছে অর্থনীতিতে। দুই উৎসব ঘিরে কয়েক লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবার শবেবরাতের পর থেকে কেনাকাটা করছেন নগরবাসী। আর এখন ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের দম ফেলার সময় নেই। গভীর রাত পর্যন্ত ক্রেতারা কেনাকাটা করতে মার্কেটে আসছেন। ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা দেশের মার্কেট, বিপণি বিতান, ফ্যাশন হাউজ ও শোরুমগুলো। তবে এবার পোশাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়লেও ভোজ্যতেল ও চাল ছাড়া বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম কমে আসছে। বৈশ্বিক সংকটের এই সময় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষের সঞ্চয় কিছুটা কমতে পারে।
এছাড়া ঈদ ও পহেলা বৈশাখের লম্বা ছুটির কারণে অর্থনীতিতে কিছুটা বাড়তি চাপ তৈরি হতে পারে। তবে ব্যবসায়ীরা ঈদের বেচা-বিক্রি ও কেনাকাটা নিয়ে ইতোমধ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এবার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে জোয়ার বইছে। এর সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি খাতের বেতন-বোনাস ঈদের কেনাকাটায় খরচ হবে। অনেকে বাড়তি কেনাকাটা করতে হাতে জমানো সঞ্চয় খরচ করছেন। তবে এবারের ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে আসলে কত লাখ কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হবে সে বিষয়ে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্য সংগঠনের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। যে যার মতো মনগড়া ও অনুমানভিত্তিত তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছেন। যদিও বেশ কয়েক বছর আগে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংগঠন থেকে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার ঘোষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রায় ২ লাখ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ঈদ অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে পোশাকের বাজার। এসময় দোকানগুলোতে পোশাকের বেচাকেনা তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। এই তথ্য বেশ কয়েক বছর আগের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দেশ ২০ কোটি মানুষের এক বিশাল বাজার। দিন দিন অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ভোগ্য ব্যয় বাড়ছে। তাই ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে এ বছর দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রত্যাশা করছেন এবারের রোজার ঈদকে ঘিরে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু পোশাকের বাজারেই যোগ হতে পারে ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা। ধনী মানুষের দেওয়া জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে প্রায় ৩৮-৪০ হাজার কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অতিরিক্ত বাণিজ্য ১ হাজার কোটি টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪-৫ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া প্রায় সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিক ঈদ বোনাস পাবেন, যা ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হবে। পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আসছে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা করে। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে বাড়তি ব্যয় মেটাতে পাঠানো প্রচুর পরিমাণে এ বৈদেশিক মুদ্রা ঈদ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে অন্যতম বড় ভূমিকা রাখছে। ঈদকে ঘিরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা হয়। তার আগের বছর ২০২৩ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা হয় ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এবার ঈদকেন্দ্রিক আড়াই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, এবার দেশে কিছুটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকলেও মানুষের মনে স্বস্তি আছে। দলে দলে মানুষ মার্কেট-শপিং মলে আসছেন ঈদ কেনাকাটা করতে। তবে রোজার শুরুতে মার্কেটগুলোতে বিক্রি কিছুটা কম হলেও মধ্য রোজার পর থেকে বিক্রি-বাট্টা বেড়েছে। আর শেষ দিকে এসে তো মার্কেটে ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। কারণ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা বোনাস হাতে পেয়েছেন। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবী এবং ব্যাংকাররা চলতি মাসের বেতনও ইতোমধ্যে হাতে পেয়ে গেছেন। তাই পোশাক বাজার, খাদ্যপণ্যের বাজার থেকে শুরু করে সব ধরনের বাজারেই ক্রেতার ভিড় বেড়েছে। আমরা আশা করছি, এবারের ঈদবাজার সব মিলিয়ে খুব ভালো কাটবে এবং ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে এখনো যেহেতু কিছুদিন সময় রয়েছে, তাই ঠিক কত টাকার ঈদ বাণিজ্য এবার হবে- সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। সঠিক হিসাব রোজার পর বলা যাবে। তবে আমরা আশা করছি, এবারের ঈদকেন্দ্রিক আড়াই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। আমাদের এ টার্গেট পূর্ণ হবে কি না, সেটি বলতে পারছি না। কারণ এবার পণ্যের দাম কিছুটা বাড়তি। অবশ্য আমরা আশাবাদী আড়াই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা না হলেও বিক্রি পরিস্থিতি আমাদের প্রত্যাশার কাছাকাছিই থাকবে।