পরবর্তী দেড় বছরের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আভাস দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, আমি প্রধান প্রধান সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন আয়োজনে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরির ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ত সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। সকাল ১০টায় তার এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সম্প্রচার করা হয়। ভাষণের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, আজ জাতির এক বিশেষ দিন। বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার দিন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনেক অস্ত্রকে অগ্রাহ্য করে খালি হাতে রুখে দাঁড়িয়ে সম্মুখ সমরে লড়াই করে নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উৎসবের দিন। এই দিনে স্মরণ করি লাখ রাখ শহীদদের, অগণিত শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ জনতার আত্মত্যাগকে; যার ফলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই অর্জনকে আমাদের দোষে সম্পূর্ণতা দিতে পারিনি। এ বছরের বিজয় দিবস বিশেষ কারণে মহা আনন্দের দিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাত্র চার মাস আগে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেল, দেশের সবাই মিলে একজোটে হুংকার দিয়ে উঠল, স্বৈরাচারী শাসককে তাড়িয়ে আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান। যাদের আত্মত্যাগ ও ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্যের মাধ্যমে এই গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব হলো তাদের সবাইকে স্মরণ করি এবং আজ এবারের মহা বিজয়ের দিনে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।
নির্বাচনের সময় সম্পর্কে আভাস দেয়ার পাশাপাশি ভোটারদের নিয়ে আশা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমার একান্ত ইচ্ছা এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের তরুণ-তরুণী ভোটাররা শতকরা ১০০ ভাগের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করুক। গত ১৫ বছরে যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়েছে, ভোটার তালিকায় তাদের নাম নিশ্চিত করতে হবে। এবার বহু তরুণ-তরুণী জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। এবারের নির্বাচনে তাদের ভোটদান একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার সাহস করতে পারবে না। বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ভুয়া ভোটারদের তালিকা থেকে বের করে দিতে হবে। এবার আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেয়া নিশ্চিত করতে চাই। অতীতে এ বিষয়ে বহু আশ্বাস শুনেছি। এই সরকারের আমলে এটা যেন প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত হয়, তা নিশ্চিত করতে চাই।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, দেশে-বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি গভীর আগ্রহ নিয়ে এই প্রতিবেদন সংগ্রহ করছেন। দেশের মধ্যে পত্রপত্রিকা, সেমিনার, আলোচনা সভা ও টেলিভিশনে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বিগত সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে- এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে গেছে, তার পরিমাপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হিসাব-নিকাশ করে এর পরিমাণ বের করে দিয়েছে। দিনদুপুরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গেছে, তাদের কেউ বাধা দেয়নি। ঋণের টাকায় বিশাল বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মোড়কে বিশাল পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে। সব এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে। পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই। সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায়ও পাচার করা টাকায় গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় নিয়ে একটা সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে, সেটাও মনগড়া। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। যদিও এ বিষয়ক আইন কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের সময়ে আংশিক হলেও যেন টাকা ফেরত আনা যায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ জন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নিজের বৈঠককে ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, কয়েকদিন আগে এই প্রথমবারের মতো ১৯ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। দেশগুলোর বেশির ভাগ দূতাবাস দিল্লিতে। তারা অনেকেই আগে কোনো দিন ঢাকায় আসেননি। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তারা একসঙ্গে ঢাকায় এলেন শুধু এই বার্তা দিতে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়ার কথা আমি তাদের জানিয়েছি। সেটিতে তারা পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার কথা তারা বলেছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ভুল তথ্য প্রচারের বিষয়েও আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের জানিয়েছি। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যাদের ভিসা অফিস নয়াদিল্লিতে আছে, তাদের ঢাকা বা অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে ভিসা অফিস নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছি। এছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার মাত্রা বাড়ানোর বিষয়ে আমি কথা বলেছি।
‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠনের কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছি। এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠনের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি নিজেই এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করব। এই কমিশন শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে। কমিশনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে, সেগুলো চিহ্নিত করা ও বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা।
গুম কমিশনের প্রতিবেদন লোমহর্ষক উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে, এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা! সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে ঘটনাচক্রে যারা এখনো বেঁচে আছেন, তারা আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস করছেন না। তাদের ভয় কিছুতেই কাটছে না। তাদের ভয়, হঠাৎ যদি ওই জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে।
মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য আমরা এখনো পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে। গত কয়েক মাসে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ও বাজার তদারকির মধ্য দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হলে জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে। আমরা আপনাদের কষ্টে সমব্যথী।