জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৮৯৮ জন আটক
- আপলোড তারিখঃ ১১-০৬-২০২১ ইং
ভারতে অবৈধভাবে পারাপারের নিরাপদ রুট মহেশপুর সীমান্ত
রয়েছে আইনের দুর্বলতা, দুই হাজার টাকা জরিমানা দিলেই জামিন
ঝিনাইদহ অফিস:ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে জেলা প্রশাসনের জরুরি বিধি-নিষেধ ও বিজিবির কঠোর নজরদারীর মধ্যেই ব্যাপক হারে মানুষ এপার-ওপার করছেন। এই অবৈধ পারাপারে দুই দেশের দালালরা নিয়োজিত। গতকাল বৃহস্পতিবারও ৬ জন অনুপ্রবেশকারীকে আটক করেছে বিজিবি। মহেশপুর উপজেলার জুলুলী ও বৃত্তিপাড়া গ্রাম থেকে তাঁদের আটক করা হয় বলে মহেশপুর-৫৮ বিজিবির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান গতকাল বৃহস্পতিবার এক ই- মেইল বার্তায় জানান।
এর মধ্যে যশোরের শার্শা উপজেলার সোহেল রানা, ঝিকরগাছা উপজেলার পদ্মপুকুর গ্রামের আলামিন, স্ত্রী রোখসানা বেগম ও মেয়ে হাবিবা খাতুনকে অবৈধপথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ও সিরাজগঞ্জের দারিয়াপুর গ্রামের যতিন মদক, স্ত্রী কামনা মদক ও ছেলে লিখন মদককে ভারতে প্রবেশের সময় আটক করে বিজিবি।
সীমান্তের গ্রামবাসীর অভিযোগ, কোনোভাবেই এই জনস্রোত থামানো যাচ্ছে না। সন্ধ্যার পর দালালের নিয়োজিত সদস্যরা গ্রামে গ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁরা বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পারাপারে লিপ্ত হন। ঝিনাইদহের মহেশপুরে ভারতের সীমান্ত রয়েছে ৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে কাটাতারবিহীন এলাকা প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার। এসব এলাকা দিয়ে মূলত অবৈধভাবে মানুষ যাতায়াত করে।
এদিকে বিজিবির হাতে আটক হয়ে ২-১ দিন পরই অনুপ্রবেশকারীরা পাসপোর্ট আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। এমন অবৈধ পারাপার করোনার ভারতীয় ধরণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝিনাইদহ জেলা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিকিৎসকরা জানান। বেশ কয়েকদিন মহেশপুর সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে অনুসন্ধান করে মানুষ পরাপারের চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।
প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তে প্রবেশের সময় কিছু মানুষ আটক হলেও বেশিরভাগ মানুষ অধরা থেকে যায়। তাঁরা নির্বিঘ্নে এপার-ওপার করে বেড়ায়। অন্যদিকে বিজিবির হাতে কিছু অনুপ্রবেশকারী আটক হলেও তাঁদের ছাড়াতে আদালতপাড়ায় ভিড় করেন দালাল চক্রের সদস্যরা। আদালতপাড়ায় কথা হয় এমন এক দালাল চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে।
নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, ‘ভারতে অপু দাদা নামে একজন আছেন। তিনি নদীতে নৌকা চালান। তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। কখনো তাঁকে দেখিনি। ওপারে তাঁর একটি গোডাউন রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে প্রবেশকারীদের এনে রাখা হয়। বর্ডারে তাঁর লোক আছে। রাতে সুযোগ বুঝে গ্রুপ করে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পাচার করে। এপারে (বাংলাদেশ) সাইফুল দাদা তাদের বুঝে নেন। সাইফুল দাদাও একইভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করেন।’
ওই সদস্যের ভাষ্যমতে, ‘ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় যারা বিজিবির হাতে আটক হয়, তাঁদের নাম-ঠিকানা ও আইডিকার্ড অপুদা ভারত থেকে আমাদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেন। আমাদের টাকা পাঠান বিকাশে। এরপর আমরা তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি। বাংলাদেশ থেকে সাইফুল দা যাদের পাঠায় ভারতে অপুদা বুঝে নেন। এ কাজে আরও একাধিক চক্র আছে। সুবিধা ও পরিস্থিতি বুঝে জনপ্রতি ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়। এভাবেই বছরের পর বছর অবৈধ পথে মহেশপুরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ-ভারতে শত শত মানুষ প্রবেশ করছে।’
বিজিবির হাতে আটক দালাল মহেশপুরের হাদি বাহিনীর প্রধান হাদিসুর রহমান বলেন, ‘ওপারে যোগাযোগ হয় মেইন মেইন মানুষের সঙ্গে। বেনাপোলের লোক আছে ওদের সঙ্গে। ওপার থেকে গাড়িতে তুলে ফোন দিয়ে বলে দেয় একটা গাড়ি যাচ্ছে। তাদের অন্য আরেকটা গাড়িতে তুলে দিও। আমি তাদের অন্য একটা গাড়িতে তুলে দিতাম।’ তিনি বলেন, ‘বেনাপোল থেকে রাজু, জহুরুল, ছালাম আর মহেশপুরের কিতাব, আশা, হান্নানসহ আরও অনেকে এই পাচার কাজের সঙ্গে জড়িত।’
মহেশপুর ভারতীয় সীমান্তের যাদবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ বি এম শাহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ভারত থেকে যে হারে অবৈধ পথে মানুষ আসছে, তাতে আমরাই বিপদ ডেকে আনছি।’ তিনি বলেন, অবৈধ যাতায়াত ঠেকাতে হলে সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয়দের সহযোগিতা খুবই দরকার।
মহেশপুরের-৫৮ বিজিবি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ৮৯৮ জনকে আটক করেছে বিজিবি। তাঁদের বিরুদ্ধে সীমান্তবর্তী মহেশপুর থানায় পাসপোর্ট আইনে ১৬০টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১৭৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৭০, মার্চে ২২২, এপ্রিল ১০৬, মে মাসে ৫৮ জন ও জুন মাসের ১০ দিনে ৬৭ জন আটক হয়েছেন। গত ২৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ভারতে যাওয়া বন্ধ থাকার কারণে অবৈধ পথে যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে ঝিনাইদহের সীমান্ত এলাকায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম জানান, বৃহস্পতিবার ৫৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২১ জনের করোনা পজিটিভ হয়েছে। করোনা আক্রান্তের হার বলা যায় ঊর্ধ্বমুখি। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদর ৫ জন, শৈলকুপায় ৬ জন, হরিণাকুণ্ডুতে ৪ জন, কালীগঞ্জ ৫ জন ও সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরে ১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. মিথিলা ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে যারা ধরা পড়ছেন, তাঁদের আমরা কোয়ারেন্টিনে রাখছি। যারা ধরা পড়ছে না, তাঁদের ব্যাপারে আরও বেশি তৎপর হাওয়া প্রয়োজন। কারণ এদের মধ্যে যারা করোনা পজিটিভ হবেন, তাঁদের থেকে ভারতীয় ধরণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ইতোমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহেশপুরের সীমান্তবর্তী বাউলি গ্রাম লকডাউন দিয়েছে। সেখানে একই পরিবারে ৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাছাড়া জুন মাসের ১০ দিন ১২৫ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন দুই জন।
ঝিনাইদহ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া মিলন বলেন, ‘১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট অধ্যাদেশ আইনে সীমান্ত অনুপ্রবেশে দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের জেল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে আদালত থেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ হবে। তাছাড়া ১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট অধ্যাদেশ আইনকেও যুগোপযোগী করা দরকার। কেননা আইনের দুর্বলতার সুযোগে এমন অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে তিনি মনে করেন।
বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহের মহেশপুর-৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পরিচালক লে. কর্নেল কামরুল আহসান বলেন, ‘সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। অবৈধ পথে কেউ যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, এজন্য সীমান্তে বসবাসকারীদের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। তাঁদের সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য বলা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তে টহলের জন্য আমাদের কোনো পথ নেই। মাঠ-ঘাট বাগান দিয়ে আমাদের নজরদারি করতে হয়। এছাড়া আমাদের তেমন যানবাহনও নেই। ফলে সাইকেল চালিয়ে মেঠো পথেই আমাদের সদস্যরা সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন, যা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, ‘মহেশপুর সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মিটিং করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মিটিং করেছেন এবং সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে মানুষকে আনা নেওয়ার কাজে কেউ যেন সহযোগিতা না করে। আমরা এর সুফল পাচ্ছি।’
কমেন্ট বক্স