টোটকা চিকিৎসা, ফলমূল ও মনবল সুস্থতার প্রধান পথ্য
- আপলোড তারিখঃ ০২-০৬-২০২০ ইং
দৈনিক সময়ের সমীকরণ সংলাপে করোনাজয়ী দুই ম্যাজিস্ট্রেট
বিশেষ প্রতিবেদক:
সমসাময়িক বিষয়ভিত্তিক ‘সমীকরণ সংলাপ’-এ এবার কথা বলেছেন করোনাভাইরাস সংক্রমণে (কোভিড ১৯) আক্রান্ত দুই ম্যাজিস্ট্রেট খাইরুল ইসলাম ও আমজাদ হোসেন। তাঁরা দুজনেই চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনে কর্মরত। এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে করোনাভাইরাস পজেটিভ রিপোর্ট আসার পর থেকে গেজেটেড অফিসার্স ডরমেটরিতে কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন তাঁরা। আক্রান্ত হওয়ার কারণ ও সুস্থ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে গতকাল সোমবার দৈনিক সময়ের সমীকরণ ফেসবুক পেজে প্রচারিত ‘সমীকরণ সংলাপ’ পরিচালক ও সঞ্চালক দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁরা দুইজন। পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হুসাইন মালিকের গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় এবং বিশেষ প্রতিবেদক এস এম শাফায়েতের প্যানেল প্রযোজনায় শুরুতে সঞ্চালকের শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর কথা বলেন সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খাইরুল ইসলাম।
কীভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন, তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২৬ অক্টোবর থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এর মধ্যে হঠাৎ বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাই। তাৎক্ষণিক প্রশিক্ষণ স্থগিত করে বর্তমান মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদেরকে মাঠে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আমরা বিদেশ থেকে ফেরা নাগরিকদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত, সচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে জনগণের সঙ্গে কাজ করেছি। এ অবস্থার মধ্যে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও অস্থিরতা নিরসনে নিয়মিত মনিটরিং করেছি। সাধারণ মানুষ যেন মহামারির সময় কোনোরূপ ভোগান্তিতে না পড়ে, সে ব্যাপারে সজাগ থেকেছি। এরপর যখন গোটা জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হল, তখনও মাঠে কাজ করতে হয়েছে আমাদের। সাধারণ মানুষ লকডাউনটাকে সঠিকভাবে মানছে কি না, বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছে কি না, কোনোভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে কি না, এসব বিষয়গুলো নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় নিয়মিত মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হয়েছে। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার স্যারের নির্দেশনায় ২৪ মার্চ থেকে ১৪ মে পর্যন্ত জীবননগর উপজেলায় দায়িত্বপালন করেছি। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর, দামুড়হুদা উপজেলাসহ গোটা জেলা চষে বেড়িয়েছি। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিদর্শনে আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় কাদামাটি মাড়িয়ে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। আসলে এই অবস্থার মধ্যে নিজের কথা ভাবার সুযোগ হয়নি। সবসময় দেশ ও দেশের মানুষের কথা, জনগণের কথা ভেবেছি। নিরলসভাবে কাজ করেছি। এরইমধ্যে কখন যে অদৃশ্য জীবাণু দানব করোনাভাইরাসের শিকার হয়েছি, কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়েছি, টের পাইনি। শরীরে এই ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাই এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকা শুরু করি।’
সুস্থ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘১৪ মে আমার পজেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর থেকে হালকা জ্বর ছিল। কিন্তু ষষ্ঠ-সপ্তম দিনে আমার জ্বরটা বেড়ে যায়। শারীরিক দুর্বলতা ছিল। রাতের বেলা একটু বেশি হাত-পা ব্যাথা করত। তখন আমার মনে হয়েছিল যে, জীবাণু আমার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। স্বাভাবিকভাবে আমি বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবর দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলাম। প্রথমেই জেলা প্রশাসক স্যার ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন। সাহস দিয়ে বলেছেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো রিপোর্ট আসলে ভীতু হওয়ার দরকার নেই। স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও সাহস দিয়ে সতেজ রাখার চেষ্টা করেছি। প্রথমে আমি একটি যন্ত্র দিয়ে নিয়মিত গরম পানির ভাপ নিয়েছি। আমাদেরকে ঘরের বাইরে থেকে ওয়ানটাইম প্লেটে করে খাবার ও ওয়ানটাইম গ্লাসে পানি দেওয়া হয়েছে। কিছু ওষুধ সেবন করেছি। ‘জি ম্যাক্স’ ওষুধের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দেশীয় ফলমূল খেয়েছি। তারসঙ্গে নিজের আত্মবিশ্বাসী মনবল আমাকে সুস্থ করে তুলেছে।’
সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যেও অসতর্কতায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের শিকার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমি এই পরিস্থিতির প্রথম থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। মার্চের ১ তারিখে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জেলা কমিটি গঠনের ব্যাপারে আমাদের এখানে একটা পরিপত্র আসে। সাধারণ শাখার দায়িত্বে থাকায় আমি এ বিষয়গুলো দেখাশোনা করতাম। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত সভা, সেমিনার ও আলোচনা করতাম। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম যে করোনা রোগী শনাক্ত হয়, তারপর ইমিগ্রেশন থেকে বিদেশ প্রত্যাগতদের একটি তালিকা প্রেরণ করা হয়। তালিকা অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গা জেলার মার্চের ১ তারিখ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত যারা বিদেশ থেকে এসেছিল, এমন ৮২৬ জনের ঠিকানা নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সহযোগিতায় হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হয়। আমার সদর উপজেলায় দায়িত্ব ছিল। জনসচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও সংক্রমণরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে নিয়ে কাজ করেছি। এরমধ্যে রমজান মাস শুরু হয়। রমজান মাসে যেমন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়, তারসঙ্গে মহামারি আসলে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে মাঠপর্যায়ে কাজ করেছি। নিয়মিত আমাদের কাছে যে ফাইলগুলো আসে, সেগুলো ধরেছি, মোবাইল কোর্ট করতে গিয়ে অনেক সময় অসতর্কতার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারিনি হয়ত। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সতর্কতার পরেও কখন যে সংক্রমিত হয়েছি, বুঝতে পারিনি। তবে যখন বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকে সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। এরপর থেকে কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম।’
সুস্থ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৪ তারিখ নমুনা পাঠানোর পর ১৬ তারিখ আমার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। ওই সময় জেলা প্রশাসক স্যার ফোন করে সাহস জুগিয়েছেন আর ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেন। সেই সঙ্গে কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমার একটু শ্বাসকষ্ট ছিল। হাঁটতে, উঠতে, বসতে আমার একটু দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হত। একটু জ্বর ও গলা ব্যাথাও ছিল। আমি তখন থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছি। জেলা প্রশাসক স্যার আমাদের সুস্থ হয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী, ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফলমূল ও খাবার বা উপহার-সামগ্রী পাঠিয়েছেন। যাতে করে আমাদের কারো, কোনো কিছুর ঘাটতি না থাকে। বিশেষ করে আমার আক্রান্তের খবরে কেউ যেন দুশ্চিন্তা না কওে, তার জন্য প্রথমত এই খবর গোপন রেখেছিলাম। কোয়ারেন্টাইনে থেকে সহকর্মী খাইরুল ইসলামের মতো স্বাভাবিক চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছি। এরপর ২৩ মে’র রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ।’
প্রসঙ্গত, ১২ মে প্রথম জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিবানী সরকারের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। কোয়ারেন্টাইনে থেকে স্বাভাবিক ও ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে অন্যদের মতো তিনিও সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আজ থেকে আবারও অফিস ও অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করবেন এই তিন ম্যাজিস্ট্রেট। কোভিড ১৯-এর সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ সুস্থ হয়ে ফেরা এই তিনজনকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আজ সংবর্ধনা জানাবে জেলা প্রশাসন।
কমেন্ট বক্স