গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে ডেঙ্গু ঝুঁকি
- আপলোড তারিখঃ ২৭-০৯-২০১৯ ইং
সমীকরণ প্রতিবেদন:
জুন থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে। সম্প্রতি ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমতে শুরু করেছে। বলা যায়, ইতোমধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির পথে। তবে এখনো পরিস্থিতি অনুকূলে এসেছে নিশ্চিত হয়ে এমন কথা বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গুর পিক মৌসুম বলা হয়ে থাকে। গত ১৮ বছর ধরে এই দুই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। তাছাড়া দেশের প্রায় ৬০ জেলায় এখনো ডেঙ্গুরোগী রয়েছে। রাজধানীসহ এসব জেলায় এখনো দুই হাজারের মতো ডেঙ্গুরোগী ভর্তি রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যুর ঘটনা। কিন্তু মশক নিধন, ডেঙ্গু সচেতনতা ও মনিটরিং কার্যক্রম এবং হাসপাতালে আগত ডেঙ্গুরোগীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ যথাযথ চিকিৎসাসেবায় ভাটা পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, বুধবার হয়েছে দিনভর। ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার প্রজনন কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে যে ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে তা এডিস মশার প্রজননে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। তাই মশক নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দরকার।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, এ মাসের বাকি কয়েকদিনই সারা দেশে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। গতকাল সারা দিনে সর্বোচ্চ রংপুর বিভাগে ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঢাকায় এর পরিমাণ ছিলো ১০ মিলিমিটার।এই পরিস্থিতি আরও কয়েকদিন থাকলে বদ্ধ জায়গায় পানি জমে ডেঙ্গুর লার্ভা জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কিন্তু বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করছে পরিস্থিতি অনেকটা অনুকূলে আছে। আর ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে না। তবে মশকনিধনে দুই সিটি কর্পোরেশনকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। নয়তো ঝুঁকি কিছুটা থাকতেই পারে। এছাড়া এ বছর চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতির জন্য রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনকে দুষছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গত বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে এক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে তারা বলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। অকার্যকর ওষুধ কেনা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা না থাকা, কীটনাশক কেনায় সরকারি নীতি অনুসরণ না করায় এ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতি- এই চারটি পদ্ধতি প্রয়োজন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন শুধু রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকলেও বাকি পদ্ধতিগুলো সিটি কর্পোরেশনের পরিকল্পনায় ও বাজেটে রাখা হয় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, এখন আর ডেঙ্গু বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, মশকনিধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে মশকনিধন কার্যক্রম বন্ধ করলে বাড়তে পারে। আর হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো যথাযথভাবে চিকিৎসা দিচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু চিকিৎসা ও পরীক্ষা কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু যেন থামছে না:
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামে রোজিনা বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে চারজনের মৃত্যু হলো। রোজিনার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তবে তিনি চট্টগ্রাম নগরীর কর্নেল হাট এলাকার বিশ্বকলোনিতে থাকতেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. ইমন তালুকদার জানান, গত বুধবার রাতে রোজিনা বেগমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তখন তার অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে মারা যান রেজিনা। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সন্দেহজনক ২২৪ জনের মৃত্যুর তথ্য জমা পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি ২২৪ জনের মধ্য থেকে ১২৬ জনের মৃত্যু পর্যালোচনা করে ৭৫ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। তার মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ৭১ জন এবং ঢাকার বাইরে চারজন। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, রাজধানীর ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকেই ১৮৩ জনের সন্দেহজনক ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ফাইল জমা পড়েছে। সেখান থেকে ১১১টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ৭১টি মৃত্যু নিশ্চিত করেছে মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি। আবার বেসরকারি হাসপাতালেই ডেঙ্গু সন্দেহে ১০২ জনের মৃত্যুর তথ্য এসেছে অধিদপ্তরে। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু সন্দেহে সবচেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু সন্দেহে সেখানে ৪০ জনের মৃত্যুর তথ্য থেকে ১৩টি ফাইল পর্যালোচনার পর পাঁচজনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঢাকার বাইরে থেকে ডেঙ্গু সন্দেহে মৃত্যু হয়েছে এমন ৪১ জনের তথ্য এসেছে অধিদপ্তরে। সেখান থেকে মাত্র ১৫ জনের মৃত্যু পর্যালোচনা করে চারজনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডেঙ্গুরোগী সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে, ১২ জন। ইউনাইটেড হাসপাতাল ৬ জন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ও অ্যাপোলো হাসপাতালে পাঁচজন করে রোগী মারা গেছেন। এসব হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও ছিল বেশি। এছাড়া ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে চারজন, আসগর আলী হাসপাতালে চারজন, পান্থপথের বিআরবি হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতাল ও কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে তিনজন করে মারা গেছে।
ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি:
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা পরিষদের (আইইডিসিআর) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার ৫৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ ও নারী ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আক্রান্তদের ২৩ শতাংশেরই বয়স ১৫-২৫ বছর। ২২ শতাংশ রোগীর বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে। ৫-১৫ বছর বয়সি রোগীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ। সে হিসাবে ৫-৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত রোগী সবচেয়ে বেশি বলে জানান ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, এরা হচ্ছে মোটামুটি ৭০ শতাংশের বেশি। এই গ্রুপটাই অ্যাকটিভ গ্রুপ। এদের মধ্যে আবার বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ৫-২৫ বছর বয়সি ছেলেমেয়েরা। কারণ এরা শিক্ষার্থী। স্কুল-কলেজে যায়। অর্থাৎ স্কুল ও অফিসগামী মানুষই ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে যে বয়সের রোগী পাওয়া গেছে, তা হলো ৩৫-৪৫ বছর ১১ শতাংশ, ৪৫-৫৫ বছর ৮ শতাংশ, ৫৫-৬৫ বছর ৪ শতাংশ। ১-৫ বছর ও ৬৫ বছর বয়সের বেশি রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ৪ শতাংশ। ০-১ বছর বয়সি শিশুদের আক্রান্তের হার মাত্র ১ শতাংশ।
এছাড়াও পেশাগত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সারা দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ চাকরিজীবী ও ছাত্রছাত্রী। এর কারণ হিসেবে অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীর বেশি আক্রান্ত হওয়ার মানে হচ্ছে তাদের স্কুল-কলেজে ও কর্মস্থলে মশা কামড়িয়েছে। তার মানে এসব স্থানে এখনো মশা আছে। নিধন হয়নি। যদি তা না হতো তাহলে বাড়িতে গৃহিণীরা বেশি আক্রান্ত হতেন।
গত বুধবার সকাল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পূর্বের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৩৮৮ জন নতুন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ২৪ জন, এসএমসি ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৭ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ছয়জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন ভর্তি হয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সাতজন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আটজন এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৮৬ হাজার ৫৪৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৬১৫ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন এক হাজার ৭০৪ জন রোগী। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হলেও ঢাকার বাইরে ২৭১ জন নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৬৫৯ জন এবং ঢাকা শহরের বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অন্যদিকে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নতুনভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ২২ জন রোগী। পাশাপাশি ঢাকা বিভাগের জেলা শহরগুলোতে ৪৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৯ জন ও খুলনা বিভাগে ১১০ জন, রংপুর বিভাগে ১১ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ৩৭ জন, সিলেট বিভাগে তিনজন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ৫৮ জন আক্রান্ত হওয়ার বিপরীতে দুজন মারা যায়। জুন মাসে এক হাজার ৮৮৪ জনের বিপরীতে ছয়জন মারা যায়। এরপর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সারি বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে ১৬ হাজার ২৫৩ জন আক্রান্তের বিপরীতে ৩২ জন মারা যান। আগস্টে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৬৩৬ জনে। মৃত্যুর সংখ্যাও দাঁড়ায় ৩১ জনে। সেপ্টেম্বরের গত ২৬ দিনে ১৫ হাজার ৪৪৬ জন আক্রান্তের বিপরীতে চারজনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
কমেন্ট বক্স