ছবির ক্যাপশন:
বহুল আকাক্সিক্ষত ‘জাতীয় জুলাই সনদ, ২০২৫’-এর স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিকেল চারটায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই আয়োজনের প্রস্তুতি এরইমধ্যে সম্পন্ন করেছে সরকার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। সেই সঙ্গে এ আয়োজনে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, এই ঐতিহাসিক সনদ স্বাক্ষরের ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের অব্যাহত ধারার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটা নির্দিষ্ট অঙ্গীকারে পৌঁছাবে। সেই সঙ্গে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে এই জাতীয় সনদ একটি দিকদর্শন হিসেবে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ প্রস্তুত হলেও এতে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেই অনেক রাজনৈতিক দলের। ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের এতে স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও এরইমধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদসহ আর কয়েকটি দল স্বাক্ষর না করার পক্ষে মত দিয়েছে। এই অবস্থায় জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কতোটা সুফল মিলবে তা নিয়ে সন্দিহান বিশ্লেষকরা।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। কোন প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটিও যুক্ত করা হয়েছে জুলাই সনদে। জুলাই জাতীয় সনদের তিনটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আছে সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে আছে সনদ বাস্তবায়নের ৭ দফা অঙ্গীকারনামা। সনদের অনেকগুলো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হলেও অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ কিছু কিছু রাজনৈতিক দল।
যেসব বিষয়ে একমত ও ভিন্নমত:
জুলাই সনদে একত হওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এই প্রস্তাবে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলেও জানানো হয়েছে সনদের চূড়ান্ত খসড়ায়। ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার পক্ষে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বিএনপি-জামায়াতসহ ৩১টি রাজনৈতিক দল ও জোট। অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল। বিএনপির কিছুটা মত পার্থক্য থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও বিএনপি-জামায়াতসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ৯টি রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হয়েছে বলেও জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় জানানো হয়েছে। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের। জাতীয় সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০তে উন্নীত করতে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে সনদে।
ভিন্নমত যে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে:
ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে কয়েকটি প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এর মধ্যে সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিত করণের বিষয়ে ২৯টি রাজনৈতিক দল একমত হলেও ভিন্নমত জানিয়েছে গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ তিনটি দল। তবে প্রধানমন্ত্রী যিনি থাকবেন, তিনি দলীয় প্রধান বা সংসদ প্রধানের মতো একাধিক পদে থাকতে পারবেন না, এমন বিধানের পক্ষে ২৫টি রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছালেও এ নিয়ে ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপিসহ ৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট। সংসদে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতপার্থক্য রয়ে গেছে। সনদে দেখা গেছে উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে জামায়াত এনসিপিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হলেও এতে, ভিন্নমত রয়েছে বিএনপিসহ ৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের।
যেসব কারণে স্বাক্ষর করতে চায় না দলগুলো:
মুক্তিযুদ্ধের যে প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেন্ডেন্ট যদি সংবিধানের তফসিল থেকে বাদ দেয়া হয়, তাহলে এই জুলাই সনদে গণফোরাম স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজান। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, আগামী ১৭ তারিখ জুলাই সনদে এই পাঁচটি দল স্বাক্ষর করবো না। আর সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট না করায় স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত বিবেচনাধীন থাকার কথা জানায় এনসিপি। নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের দাবি জানায় ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, আমরা চাচ্ছি গণভোট নির্বাচনের আগে হবে। নভেম্বরের মধ্যে আমরা গণভোট দাবি করছি। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদের বিষয়ে আমরা স্বাক্ষর করবো কি করবো না সেই বিষয়গুলোকে আমরা বিবেচনাধীন রেখেছি। এই শর্তের উপরে কমিশন এবং সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে জাতির কাছে পরিষ্কার রোডম্যাপ উপস্থাপন করবে।
