বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন, রাস্তা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গার্মেন্টসে

মিরপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬, বহু নিখোঁজ

আপলোড তারিখঃ 2025-10-15 ইং
বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন, রাস্তা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গার্মেন্টসে ছবির ক্যাপশন:

রাজধানীর মিরপুর শিয়ালবাড়ীতে কসমিক ফার্মা নামের একটি কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে রাস্তার বিপরীত পাশের আরএন ফ্যাশন নামের একটি গার্মেন্টসে। সেখান থেকে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। ১৬টি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় গার্মেন্টসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন। এতে বিষাক্ত গ্যাস ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। বিপজ্জনক হওয়ায় ৩০০ গজের মধ্যে কাউকে ঢুকতে দেয়নি ফায়ার সার্ভিস।


আগুনের খবরে ছুটে আসেন গার্মেন্টসে চাকরি করা ব্যক্তিদের স্বজনরা। নিখোঁজ স্বজনের ছবি হাতে ঘটনাস্থল ও বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটতে থাকেন। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে অগ্নিকাণ্ডস্থল ও আশপাশের পরিবেশ। ঘটনাস্থলে ভিড় জমায় উৎসুক জনতা। ভিড় সামলাতে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, স্বেচ্ছাসেবী ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মোতায়েন করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ক্রাইম সিন ও কেমিক্যাল ল্যাব বিশেষজ্ঞরা। গতকাল রাত ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থল থেকে ১৬টি মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়। পরে মরদেহগুলো মর্গে রাখা হয়।


প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে হঠাৎ করে কেমিক্যাল গোডাউন ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। উপস্থিত অনেকে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে আগুন আরো বেড়ে যায়। তখন সবাই বুঝতে পারেন, কেমিক্যাল থাকায় পানিতে আগুনের মাত্রা বেড়ে গেছে। এরপর সবাই নির্দিষ্ট দূরত্বে চলে যান। আর মুহূর্তে আগুন মাঝখানের রাস্তা অতিক্রম করে বিপরীত পাশের গার্মেন্টস ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিস্ফোরণের শব্দে কেউ কেউ বের হতে পারলেও আটকা পড়েন অনেকে। খবর পেয়ে একে একে ঘটনাস্থলে পৌঁছে অগ্নিনির্বাপণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। আটকা পড়া অনেককে জানালা ও দেওয়াল ভেঙে বের করে আনা হয়।


ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা তালহা বিন জমিস বলেন, আগুনের খবরে প্রথমে তিনটি পরে আরো ৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। কেমিক্যালের আগুন নির্বাপণে বিশেষ প্রশিক্ষিত টিম ও হাজমত গাড়ি পাঠানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শী আরএন ফ্যাশন গার্মেন্টসের কাটিং মাস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনলাম। বিল্ডিংটা কেঁপে উঠল। ভাবছিলাম, ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু পরে দেখি জানালা দিয়ে ধোঁয়া আসছে। ধীরে ধীরে ধোঁয়া বাড়তে থাকে। এরপর আর বের হতে পারছিলাম না। পরে পাশের ভবন থেকে ওয়াল ভেঙে আমাকে বের করা হয়। পরে তাকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। মামুন আরও জানান, তাদের ঐ ভবনটি পাঁচতলাবিশিষ্ট। তৃতীয় তলায় সুইং সেকশন। সেখানেও বহু ওয়ার্কার ছিলেন। এর মধ্যে অনেকে আটকা পড়েছেন।


আহত সুরুজ্জমান বলেন, তিনি আব্দুল্লাহপুরের টেক্সজোরা গ্লোবাল নামে একটি বায়িং হাউজে কাজ করেন। একটি ওয়ার্ক অর্ডারের কাজে আরএন ফ্যাশনে গিয়েছিলেন। এর মধ্যেই পাশের ভবন থেকে গার্মেন্টেসে আগুন ধরে যায়। এতে তিনিও আটকা পড়েন। পরে নিজেই চেষ্টা করে বের হন। এ ঘটনায় সোহেল সরদার (৩২) নামে আরেক জন আহত হয়েছে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মাঝখানে সড়ক। সড়কের ডান পাশে দোতলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং। এর চারপাশে দেওয়াল আর ওপরে টিনশড। যা অগ্নিকাণ্ডস্থল কসমিক ফার্মা কেমিক্যালের গোডাউন। আর সড়কটির বাঁ পাশে আরএন ফ্যাশন গার্মেন্টসসহ অন্যান্য ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কসমিক ফার্মা কেমিক্যাল গোডাউনের সামনের সড়কে দাঁড় করানো থাকা একটি মিনি কাভার্ড ভ্যান আগুনে পুড়ে গেছে। পাশে থাকা ফুটপাতের দোকান, ছাউনি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এরপর প্রায় সাত-আট ফিট চওড়া সড়কটি অতিক্রম করে আগুন লেগে যায় পাঁচতলাবিশিষ্ট আরএন ফ্যাশন গার্মেন্টসে। আগুনের লেলিহান শিখার ছোঁয়া লাগে পিচ ঢালা সড়কেও। গার্মেন্টস ভবনের বাইরের অংশ কালচে হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি ছিটিয়ে গার্মেন্টস অংশে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। পাশের ভবন থেকে গার্মেন্টস ভবনের দেওয়াল কেটে আটকা পড়া বেশ কয়েক জনকে বের করে আনেন। বিকাল প্রায় সাড়ে ৪টার দিকে গার্মেন্টসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তবে কেমিক্যাল গোডাউনে তখনো অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম শুরু করা হয়নি।


ফায়ার সার্ভিস ছিল সতর্ক:
অগ্নিনির্বাপণে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন ফায়ার ফাইটার জানান, কেমিক্যালের আগুন নির্বাপণে প্রথমে কোনো কার্যক্রম চালানো হয়নি। একে আগুনের বেশ বেগ ছিল, তাছাড়া ভেতরে কী ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই আগে তারা কেমিক্যালের বিষয়ে নিশ্চিত হন। কেননা, গত ২২ সেপ্টেম্বর টঙ্গির ফেমাস কেমিক্যাল গোডাউনে আগুনের ঘটনায় তিন ফায়ার ফাইটারের মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় ভেতরে কেমিক্যাল ছিল কি না এবং কী ধরনের কেমিক্যাল ছিল, সেটি কেউ নিশ্চিত করেনি। তাই এখানকার ঘটনায় ফায়ার সদস্যরা আগে তথ্য নেন, এরপর পর্যবেক্ষণ সিদ্ধান্ত নেন। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস সতর্কতা অবলম্বন করে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ প্রশিক্ষিত টিম ও হাজমত গাড়ি ব্যবহার করে কেমিক্যালের আগুন নির্বাপণ করা হয়। তবে তাদের পৌঁছার আগে স্থানীয় অনেকে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। এতে কেমিক্যালের আগুনের ভয়াবহতা আরো বেড়ে যায়।


কেমিক্যাল গোডাউন ছিল অবৈধ:
ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম জানান, পোশাক কারখানার দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। তিনি বলেন, আগুনের খবরে আমাদের ফায়ার ফাইটাররা এসে প্রথম দিকে দুই ভবনে অর্থাৎ কেমিক্যাল ও গার্মেন্ট ভবনে আগুন দেখতে পান। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কেমিক্যাল গোডাউনে প্রথমে আগুন লাগে। সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে। আর সেই আগুন রাস্তার বিপরীত পাশে গার্মেন্টে ছড়িয়ে পড়ে। কেমিক্যাল বিস্ফোরণে বিষাক্ত গ্যাস ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বিষাক্ত গ্যাস গার্মেন্টেও ঢুকে পড়ে। এতে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ায় ৩০০ গজের মধ্যে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমাদের লোকজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক ও স্থানীয় জনগণকে নির্ধারিত দূরত্বে থাকতে আমরা বারবার বলেছি। তিনি বলেন, গোডাউনে পার অক্সাইড, ব্লিচিং পাউডার, পটাশ, এনজাইমসহ ছয়-সাত ধরনের কেমিক্যাল ছিল বলে আমরা পাশের একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জানতে পেরেছি। এসব কেমিক্যাল টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থ। আলম নামের একজন গোডাউনটির মালিক বলে অনেকে জানিয়েছেন। তবে তাকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। আশপাশের দোকানিরা তাকে কল করেও পাননি। গোডাউনটির কোনো বৈধতা ছিল না।


পরিচয় শনাক্তে লাগবে ডিএনএ পরীক্ষা:
এ ঘটনায় রাত ৮টা পর্যন্ত ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তবে পোশাক কারখানা থেকে যে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম। তিনি বলেন, পরিচয় শনাক্তের পর যথাযথ নিয়মে ও কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

সম্পাদকীয় :

প্রধান সম্পাদকঃ নাজমুল হক স্বপন
ফোনঃ +৮৮০২৪৭৭৭৮৭৫৫৬

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ শরীফুজ্জামান শরীফ

ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ শরীফুজ্জামান শরীফ

বার্তা সম্পাদকঃ শরীফুজ্জামান শরীফ


বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ

অফিসঃ পুলিশ পার্ক লেন (মসজিদ মার্কেটের ৩য় তলা) কোর্ট রোড, চুয়াডাঙ্গা।

ইমেইলঃ dailysomoyersomikoron@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১-৯০৯১৯৭, ০১৭০৫-৪০১৪৬৪(বার্তা-বিভাগ), ০১৭০৫-৪০১৪৬৭(সার্কুলেশন)