
স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়নি। এগুলোকে স্থায়ী ভিত্তি দেয়ার সব চেষ্টা বরবাদ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী দল। দলটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করেছে। গণতন্ত্রের গলায় ফাঁস পরিয়ে তাকে হত্যা করেছে। এমনকি সাধারণ নিয়ম-নীতিও দলটি মানেনি। রীতিমতো রাজতন্ত্রের কায়দায় ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।
চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরার এবং সংস্কারের মাধ্যমে এ সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী ভিত্তি দেয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্র্বতী সরকার সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করে সম্ভাব্য ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের জায়গাগুলো চিহ্নিত করেছে। সংস্কারের সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালাও তৈরি করেছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। কিন্তু এক বছর পর এসে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে- তাকে বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, হতাশাজনক।
তাদের নিরাশ হওয়ার কারণ অস্পষ্ট নয়। সাধারণ মানুষ যেসব সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ বলে বোঝে, রাজনৈতিক দলগুলো সে রকম অনেক বিষয়েও আপত্তি শুধু নয়; রীতিমতো নাকচ করে দিচ্ছে। তাদের কাছে দলীয় স্বার্থ যতটা প্রাধান্য পাচ্ছে, দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ জন্যই দেখা যাচ্ছে, বিপুল অর্থ ব্যয়সাপেক্ষ দুইকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনে ঐকমত্য হচ্ছে। কিন্তু নারী প্রতিনিধিদের নির্বাচিত হয়ে আসার বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে দলগুলো আসলেই মৌলিক সংস্কার চায় কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা গত ৫৪ বছরের যেমন খুশি চলার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতেই বেশি আগ্রহী। এ জন্যই সংস্কার কমিশনের প্রধানকে বলতে হচ্ছে, 'সংস্কারে কর্ণপাত না করলে দলগুলোকেই মাসুল দিতে হবে।'
কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘ আলাপ শেষে ১১টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ মৌলিক সংস্কারের ৮৪টি সুপারিশে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এসব সুপারিশ 'জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫'-এ উল্লেখ থাকছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছে। কেউ গণভোটের কথা বলছেন, কেউ প্রক্লেমেশনের কথা। নাগরিক সংগঠন সুজনের ড. বদিউল আলম মজুমদার যথার্থই বলেছেন, জুলাই সনদ প্রণয়নের সার্থকতা মূলত এর বাস্তবায়নে। আপত্তি জানিয়ে এবং সংস্কার পরের সংসদে বাস্তবায়নের কথা বলেই রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব শেষ হয় না।
আমাদের বিশ্বাস, সংস্কারের বিষয়ে জনগণের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, একগুঁয়েমি, দলীয়করণ, তথা সব ধরনের স্বৈরাচারী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ সুষ্ঠুভাবে চলবে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলবে এবং জন-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে চলবে- এটিই আপামর জনগণের চাওয়া।
সংস্কারের মধ্য দিয়ে তেমন ব্যবস্থাই মানুষের কাম্য। রাজনীতিকরা সেটি করতে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। আবারো জনগণের রোষের মুখে পড়তে হবে তাদের। বড় বা ছোট যে দলই জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে হাঁটবে, তাদেরই এই পরিণতি ভোগ করতে হবে। আগামী নির্বাচনে কোনো দলের ওপর যেন জনগণের সেই আস্থাহীনতার খরা নেমে না আসে সেটি হৃদয়ঙ্গম করার দায় রাজনৈতিক দলগুলোরই।