
সমীকরণ প্রতিবেদন:
পাঠ্যপুস্তকে ভুলের পর প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফলেও ‘ভুল’। কেন বারবার এমন ভুল দেখতে হচ্ছে? কেন এমন ভুলের শিকার হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের? এসবের ফলে শিক্ষার্থীরা যেবিপদে পড়ছে, তারা যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা নিয়ে বড় হচ্ছে, তার কী হবে? প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল গত মঙ্গলবার প্রকাশ করার চার ঘণ্টার মধ্যেই তা স্থগিত করা হয়। পরীক্ষাই দেয়নি এমন শিক্ষার্থীকেও বৃত্তি দেয়া হয়েছিল সেই ফলাফলে। তাছাড়া সেখানে ট্যালেন্টপুল হয়ে গেছে সাধারণ গ্রেড আর সাধারণ গ্রেড হয়ে গেছে ট্যালেন্টপুল। ফল স্থগিত করার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এমন ভয়ানক ভুলের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে কম্পিটার কোডিংয়ে ভুলের কথা বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে যান্ত্রিক ত্রæটির কথা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন অবশ্য তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা তো তাড়াহুড়ো করে ফল প্রকাশ করতে বলিনি। কেন করেছে? এই ফল প্রকাশ করে আবার তা স্থগিত করার কারণে আমাদের দুর্নাম হচ্ছে। শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি, যারা দায়ী হবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তার কথা, ‘এখানে শিশুরা যেমন ক্ষতির শিকার হলো, সরকারও আর্থিক ক্ষতির শিকার হলো।’ পাঠ্যপুস্তকে ভুলের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখানেও স্পষ্ট যে যাদের দায়িত্ব তারা ঠিকমতো পালন করেননি। আমি নিজে প্রাথমিকের সচিবকে নিয়ে প্রাথমিকের সব বই আগে পড়েছি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী হয়ত ব্যস্ত থাকেন, তাই পড়তে পারেননি। কিন্তু আমাদের পড়তে হবে। এটাই তো আমার কাজ।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে অদক্ষতা অযোগ্যতা যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু লোক আছে যারা একটা ঝামেলা পাকাতে চায়। তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।’ পাঠ্যপুস্তকে ভুল এবং তথ্য চুরির অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর তদন্ত এবং ভুল সংশোধনের কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুটি বই প্রত্যাহারও করা হয়েছে। সেই কমিটি এখনো কাজ করছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা। এখানো দেয়নি। তারা ভুল চিহ্নিত করার পর তা সংশোধন করা হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘এখানে কিছু আছে তথ্যগত ভুল। বানান ভুলও আছে। আর কিছু বিষয় আছে দৃষ্টিভঙ্গিগত বিতর্ক। আর প্লেজারিজমেরও অভিযোগ আছে।’ তিনি আশ্বাস দেন, ‘প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা স্কুলে স্কুলেও যাবো শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে। আমরা চেষ্টা করবো সংশোধনটা ঠিকমতো করতে।’ নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের কিছু ভুল এরই মধ্যে সংশোধন করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাকি সংশোধনে সময় লাগবে। নতুন বই নয়, সংশোধনের অংশ আমরা ছেপে আলাদাভাবে স্কুলে পাঠাবো।’ তিনি স্বীকার করেন, এর কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছে। এটা তাদের মনোজগতে বড় প্রভাব ফেলছে। তবে তার কথা, ‘বানান ভুলের বিষয়টি নিয়ে সার্বিকভাবে সমস্যা আছে। বাংলা বানানরীতি নিয়ে নানা মত আছে। তবে কিছু ভুল আছে কম্পিউটার কম্পোজের ভুল। সতর্ক হলে এগুলো এড়ানো যেতো।’ কপি করা বা তথ্যগত ভুলের দায় কে নেবে? এর জাবাবে তিনি বলেন, ‘দায়তো আমাদের নিতে হবে। যারা বই লিখেছেন, দেখেছেন সবার।’ দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো তো মানবিক ভুল। ভুল কমানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু শতভাগ নির্ভুল করা তো সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘আসলে এইসব ঘটনার কোনো বিচার হয় না। বিচারহীনতার কারণে আমরা যতই কথা বলি না কেন শিক্ষায় একের পর এক বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে।’ তার কথা, ‘এই যে বৃত্তি পরীক্ষার ফল নিয়ে যা হলো, এখন আমার স্কুলের অনেকে ভয়ে আছে তারা নতুন ফলাফলে আবার বাদ পড়ে কিনা। বাদ পড়লে তারা কী করবে? কোনো অনাকাঙ্খিত অবস্থা তৈরি হতে পারে। সে এবং তার পরিবার সামাজিক নিন্দার মুখে পড়বে। এর দায় কে নেবে? আর পাঠ্যপুস্তকের কথা কী বলবো! শিশুদের যে কোনটা শিখাবো তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। ছবির ক্যাপশনেও ভুল। এই ভুল নিয়ে তারা বড় হচ্ছে। কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই,” বলেন এই শিক্ষক।
পিরোজপুরের মিরুখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন খান বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের কী পড়াবো বুঝতে পারছি না। কবে বই সংশোধন হয়ে আসবে, তা জানি না। এই ভুলই চলছে। কাউকে শাস্তির আওতায়ও আনা হয় না। তাই ভুল কমে না, বরং বাড়ে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. অহিদুজ্জামান বলেন, ‘ধরে নিলাম অনেক বছর পর বৃত্তি পরীক্ষা হয়েছে। কম্পিউটারে ফল প্রকাশ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে। কিন্তু আরেকটু সতর্ক হলে এই এই বিপর্যয় এড়ানো যেতো বলে আমি মনে করি। এর ফলে শিশুরা এখন মানসিক যন্ত্রণায় আছে। এখন উচিত হবে নতুন ফলাফলে কাউকে বাদ না দিয়ে যারা নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের যোগ করে ফল প্রকাশ করা। বাদ দিলে ওই শিশুরা মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’ ‘আর পাঠ্যপুস্তক নিয়ে রীতিমতো স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। এখানে নানামুখী ভুল। প্লেজারিজমের মতো অপরাধও হয়েছে। কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত না নিয়েই নতুন পাঠক্রম করা হয়েছে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে। এটা হয় না। তাই সংশোধন কমিটি থেকে আমি আমার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’ ‘দুইটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরো বই সংশোধন করতে হবে। এখানে অর্থের অপচয় হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়ে মানসিক চাপে আছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’ আর প্রাথমিক এবং গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আসলে আমাদের বিশেষজ্ঞ দরকার। শিক্ষা প্রশাসনে যারা কাজ করেন, তারা বিভিন্ন সেক্টর থেকে আসেন। কয়েক বছর পর চলে যান। এ কারণেই এই পরিস্থিতি। সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে শিক্ষায়। কিন্তু এইসব কারণে দুর্নাম হচ্ছে। আমরা এগুলো বন্ধের চেষ্টা করছি।’