চুয়াডাঙ্গা ০১:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
কালিদাসপুর স্টুডিও’র মধ্যে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গণধোলাই নাগদাহ ও খাসকররা ইউনিয়ন আ.লীগের কর্মী সভায় এমপি ছেলুন জোয়ার্দ্দার কলেজিয়েট স্কুলের উপাধ্যক্ষ শামিম রেজার ৫২তম জন্মবার্ষিকী পালন বারাদী ইউনিয়নে গণসংযোগ, পথসভা ও লিফলেট বিতরণকালে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে রোগীর স্বজনের অভিযোগ আলমডাঙ্গায় পুত্রবধূর বটির কোপে শাশুড়ি জখম বাংলাদেশিদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিউজিল্যান্ডের কাছে বড় ব্যবধানে হারলো বাংলাদেশ মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে পুলিশ-আমলা-বিচারাঙ্গন সবার মধ্যে আতঙ্ক আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা

মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম মানুষ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:১০:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ৩৯ বার পড়া হয়েছে
সময়ের সমীকরণ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সমীকরণ প্রতিবেদন:
গত বছরের আগস্ট থেকে দেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির তীব্র চাপ অনুভব করছে। সরকারি হিসাবে এই সময়ের মধ্যে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। তবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপ আরও অনেক বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মূল্যস্ফীতির পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব যেমন আছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সংকটও আছে। তবে যে কারণই থাকুক না কেন এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ ভোগ কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ওএমএস-এর ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইন দেখলেই বোঝা যায়, এরই মধ্যে নতুন করে একাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যম আয়ের মানুষ এখন টিকে থাকতে মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। শখ করে সপ্তাহান্তে কিংবা মাস শেষে পরিবারের ভূরিভোজের আয়োজন এক রকম উধাও হয়ে গেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর সেলিম রায়হান বলেন, বিবিএস যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি। এই মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের ওপর বেশি। আর শহর এবং গ্রাম উভয় এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বেশি। এর কারণ ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বেশি। আর স্বল্প আয়ের মানুষ ভোগ্যপণ্য কিনতেই তার আয়ের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করে। সেটা এখন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ হতে পারে। তাই এই পরিস্থিতিতে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি মনে করেন, বিশ্ব পরিস্থিতি, ডলার সংকটসহ আরও অনেক সংকট আছে। তারপরও সরকারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ আছে। ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ডক্টর নাজনীন আহমেদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতির পেছনে বিশ্ববাজারের প্রভাব আছে সত্য তবে এখানে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনারও ত্রুটি আছে। কারণ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ হয় না।
এখানে সিন্ডিকেট আছে, মধ্যস্বত্বভোগী আছে। দেশে চালের দামও স্বাভাবিক নেই। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চালের ব্যবসায় নেমে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে। বেড়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণের শক্তি। আবার ভোজ্যতেলসহ আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হলেও এখানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। এখানেও বাজার প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে। এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে তবে তা সার্বিক নয়। অথচ সার্বিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতি দেশের নিম্ন এবং মধ্যবিত্তকে দারিদ্র্যের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি। সানেমের এক জরিপে উঠে এসেছে, মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবার ধার করে চলছে। দেশের গ্রাম ও শহরের স্বল্প আয়ের পরিবারের ওপর করা এই জরিপে যেসব পরিবার অংশ নিয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
সানেমের জরিপের তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বাড়তে থাকায় গত ছয় মাসে যে ৭৪ শতাংশ পরিবার ধার করে চলেছে, তাদের ধার করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো আসেনি। বরং পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে আগামী ৬ মাসে তাদের আরও ধার করতে হবে। জরিপ বলছে, ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, আর সঞ্চয় বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার। ধারের উৎস হিসেবে ৪৫ শতাংশ পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান। সানেম মনে করে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ফলে নিম্নআয়ের মানুষ সুদের দুষ্টচক্রে পড়ে এবং পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ধার করার জন্য আরও অনেক পথ খুঁজছে মানুষ। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩ শতাংশ পরিবার।
সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করে চলছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। ছয়মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে ৪ বার মুরগি খেত, এখন তারা ২ বার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবায়ও স্বল্প আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। বিশেষ করে পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য। জরিপের তথ্য বলছে, শহরের স্বল্প আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে। গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি। সানেমের জরিপে উঠে এসেছে, ঘরে খাবার আছে কিনা, তা নিয়ে নিম্নআয়ের পরিবারে আগের তুলনায় উদ্বেগ বেড়েছে। ফলে খাবারে বৈচিত্র্য কমেছে। খাদ্যতালিকায় থাকছে মাত্র কয়েকটি পদ। খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিতে হচ্ছে এসব মানুষকে। যার কারণে আগের থেকে কম দামি মাছ-মাংস খেতে হচ্ছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, দুধ-ফলমূলসহ যেসব খাদ্য প্রতিদিন খাওয়া সম্ভব না হলেও সপ্তাহে অন্তত তিন-চারদিন খাওয়া জরুরি ওইসব খাবার এখন মধ্যবিত্তের কাছে বিলাসী খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে অনেকে এসব খাবার শুধু নিজেরই নয়, পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, দুধ মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে কাজ করে। মানবদেহ গঠনের প্রয়োজনীয় সবগুলো প্রোটিন দুধের মধ্যে থাকায় শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সের মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মায়েদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে দুধের বিকল্প নেই। দুধে পরিমাণমতো ফসফরাস থাকায় পশ্চিমা বিশ্বে একে নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় রাখা হয়। দুধ ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও পূরণ করে। শিশু ও বাড়ন্ত বয়সে হাড়, দাঁতের গঠন ও মজবুতের জন্য এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধ করার জন্য দুধ অত্যন্ত প্রয়োজন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ খাদ্যটিও এখন শখের খাবারের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পাস্তুরিত তরল দুধের মধ্যে মিল্কভিটার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গত বছরের জুনে এ কোম্পানির এক লিটার দুধের দাম ছিল ৭০ টাকা, যা এখন ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ২৬.৬৬ শতাংশ। মিল্কভিটা ছাড়াও বিভিন্ন খামার, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও খোলাবাজারে মানভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যেত প্রতি লিটার তরল দুধ। সবগুলোর দামই প্রায় ৩০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি হারে বেড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি ব্র্যাকের পণ্য আড়ংয়ের তরল দুধের এক লিটারের প্যাকেটের দাম ছিল ৭০ টাকা, এখন যা ৯৫ টাকা। তাদের আধা লিটার দুধের দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। প্রাণের প্রতি লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের দাম ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ টাকা হয়েছে। প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের দামও বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। দুই থেকে তিন মাসের ব্যবধানে, বাজারে শিশু খাদ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়ায় অনেকে বিকল্প খাবার খুঁজে নিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ন্যান, সেরেলাক, বায়োমিল, প্রাইমাসহ পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর দাম প্যাকেট প্রতি একশ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক পরিবার। মূল্যস্ফীতির এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত অনেকের কাছে এসব শিশুখাদ্য এখনও বিলাসী পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তারা অনেকে শিশু সন্তানের জন্য স্বল্প দামের বিকল্প খাদ্য খুঁজে নিয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম মানুষ

আপডেট সময় : ০৯:১০:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদন:
গত বছরের আগস্ট থেকে দেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির তীব্র চাপ অনুভব করছে। সরকারি হিসাবে এই সময়ের মধ্যে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। তবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপ আরও অনেক বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মূল্যস্ফীতির পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব যেমন আছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সংকটও আছে। তবে যে কারণই থাকুক না কেন এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ ভোগ কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ওএমএস-এর ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইন দেখলেই বোঝা যায়, এরই মধ্যে নতুন করে একাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যম আয়ের মানুষ এখন টিকে থাকতে মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। শখ করে সপ্তাহান্তে কিংবা মাস শেষে পরিবারের ভূরিভোজের আয়োজন এক রকম উধাও হয়ে গেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর সেলিম রায়হান বলেন, বিবিএস যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি। এই মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের ওপর বেশি। আর শহর এবং গ্রাম উভয় এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বেশি। এর কারণ ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বেশি। আর স্বল্প আয়ের মানুষ ভোগ্যপণ্য কিনতেই তার আয়ের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করে। সেটা এখন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ হতে পারে। তাই এই পরিস্থিতিতে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি মনে করেন, বিশ্ব পরিস্থিতি, ডলার সংকটসহ আরও অনেক সংকট আছে। তারপরও সরকারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ আছে। ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ডক্টর নাজনীন আহমেদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতির পেছনে বিশ্ববাজারের প্রভাব আছে সত্য তবে এখানে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনারও ত্রুটি আছে। কারণ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ হয় না।
এখানে সিন্ডিকেট আছে, মধ্যস্বত্বভোগী আছে। দেশে চালের দামও স্বাভাবিক নেই। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চালের ব্যবসায় নেমে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে। বেড়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণের শক্তি। আবার ভোজ্যতেলসহ আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হলেও এখানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। এখানেও বাজার প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে। এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে তবে তা সার্বিক নয়। অথচ সার্বিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতি দেশের নিম্ন এবং মধ্যবিত্তকে দারিদ্র্যের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি। সানেমের এক জরিপে উঠে এসেছে, মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবার ধার করে চলছে। দেশের গ্রাম ও শহরের স্বল্প আয়ের পরিবারের ওপর করা এই জরিপে যেসব পরিবার অংশ নিয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
সানেমের জরিপের তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বাড়তে থাকায় গত ছয় মাসে যে ৭৪ শতাংশ পরিবার ধার করে চলেছে, তাদের ধার করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো আসেনি। বরং পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে আগামী ৬ মাসে তাদের আরও ধার করতে হবে। জরিপ বলছে, ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, আর সঞ্চয় বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার। ধারের উৎস হিসেবে ৪৫ শতাংশ পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান। সানেম মনে করে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ফলে নিম্নআয়ের মানুষ সুদের দুষ্টচক্রে পড়ে এবং পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ধার করার জন্য আরও অনেক পথ খুঁজছে মানুষ। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩ শতাংশ পরিবার।
সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করে চলছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। ছয়মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে ৪ বার মুরগি খেত, এখন তারা ২ বার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবায়ও স্বল্প আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। বিশেষ করে পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য। জরিপের তথ্য বলছে, শহরের স্বল্প আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে। গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি। সানেমের জরিপে উঠে এসেছে, ঘরে খাবার আছে কিনা, তা নিয়ে নিম্নআয়ের পরিবারে আগের তুলনায় উদ্বেগ বেড়েছে। ফলে খাবারে বৈচিত্র্য কমেছে। খাদ্যতালিকায় থাকছে মাত্র কয়েকটি পদ। খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিতে হচ্ছে এসব মানুষকে। যার কারণে আগের থেকে কম দামি মাছ-মাংস খেতে হচ্ছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, দুধ-ফলমূলসহ যেসব খাদ্য প্রতিদিন খাওয়া সম্ভব না হলেও সপ্তাহে অন্তত তিন-চারদিন খাওয়া জরুরি ওইসব খাবার এখন মধ্যবিত্তের কাছে বিলাসী খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে অনেকে এসব খাবার শুধু নিজেরই নয়, পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, দুধ মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে কাজ করে। মানবদেহ গঠনের প্রয়োজনীয় সবগুলো প্রোটিন দুধের মধ্যে থাকায় শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সের মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মায়েদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে দুধের বিকল্প নেই। দুধে পরিমাণমতো ফসফরাস থাকায় পশ্চিমা বিশ্বে একে নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় রাখা হয়। দুধ ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও পূরণ করে। শিশু ও বাড়ন্ত বয়সে হাড়, দাঁতের গঠন ও মজবুতের জন্য এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধ করার জন্য দুধ অত্যন্ত প্রয়োজন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ খাদ্যটিও এখন শখের খাবারের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পাস্তুরিত তরল দুধের মধ্যে মিল্কভিটার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গত বছরের জুনে এ কোম্পানির এক লিটার দুধের দাম ছিল ৭০ টাকা, যা এখন ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ২৬.৬৬ শতাংশ। মিল্কভিটা ছাড়াও বিভিন্ন খামার, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও খোলাবাজারে মানভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যেত প্রতি লিটার তরল দুধ। সবগুলোর দামই প্রায় ৩০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি হারে বেড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি ব্র্যাকের পণ্য আড়ংয়ের তরল দুধের এক লিটারের প্যাকেটের দাম ছিল ৭০ টাকা, এখন যা ৯৫ টাকা। তাদের আধা লিটার দুধের দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। প্রাণের প্রতি লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের দাম ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ টাকা হয়েছে। প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের দামও বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। দুই থেকে তিন মাসের ব্যবধানে, বাজারে শিশু খাদ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়ায় অনেকে বিকল্প খাবার খুঁজে নিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ন্যান, সেরেলাক, বায়োমিল, প্রাইমাসহ পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর দাম প্যাকেট প্রতি একশ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক পরিবার। মূল্যস্ফীতির এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত অনেকের কাছে এসব শিশুখাদ্য এখনও বিলাসী পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তারা অনেকে শিশু সন্তানের জন্য স্বল্প দামের বিকল্প খাদ্য খুঁজে নিয়েছেন।