সামনে ‘কঠিন সময়’ ভাবাচ্ছে বিএনপিকে

- আপডেট সময় : ০৪:৫২:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ৪৫ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কঠিন পরীক্ষার মুখে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ‘সফল’ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে দলটি? নাকি আবার নির্বাচন বর্জনের পরিস্থিতিতে পড়বে? সুষ্ঠু নির্বাচনে পশ্চিমাদের চাপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সরাসরি মাঠে না থাকার সংকটও আছে। তবে সর্বশক্তি নিয়ে রাজপথ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে দলটি। দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার প্রত্যাশা নেতাদের। দেশের মানুষ এবং বিদেশিদের আস্থায় নিতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি দূরত্ব বজায় রাখলেও সন্দেহ রয়ে গেছে এখনও। অন্য সমমনা দলগুলো নিয়ে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে বড় ধরনের সভা-সমাবেশ হলেও এখনও সরকারের ওপর তেমন চাপ তৈরি করতে পারেনি। রাজপথের কর্মসূচিতে হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার সামলাতে নাকাল অবস্থা দলটির। তবে ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে অত্যাচার-নির্যাতন, মামলা-হামলা সহ্য করা বিএনপি এবার যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া। দেশের অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে এবং নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে এবার ‘সফল’ আন্দোলন গড়ার প্রত্যাশা দলটির শীর্ষ নেতাদের।
বিএনপি ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। এবারও রাজপথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুসংগঠিত শক্তি মোকাবিলা করতে হবে তাদের। আবার দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও সন্দেহ-সংশয় তো রয়েছেই। ওয়ান-ইলেভেনের মতো দলে ভাঙন ধরাতে কোণঠাসা ও হতাশ নেতাদের বাগিয়ে কিংস পার্টির ব্যানারে নির্বাচনে নেওয়ার চাপের শঙ্কাও রয়েছে বিরোধী দলটিতে। সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে এনে নিজেদের দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেওয়াই দলটির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে আরও ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হতে হবে। অনুমতি নিয়ে সভা-সমাবেশ করে দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণজোয়ারের পরিস্থিতি ছাড়া কখনও দাবি আদায় হয় না।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সময়ের প্রয়োজনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পথ খুলে দেন। পরে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিএনপি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরই কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে ভোটারবিহীন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করাই তাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
‘সফল’ আন্দোলন গড়াই বড় চ্যালেঞ্জ
ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনে রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে বিএনপির। দলের ভেতর সংস্কারের বিভেদ রেখা এখনও মুছতে পারেনি। ওই সময়ের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে মুক্তি নিয়ে গুলশানের বাসভবনে থাকলেও রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। এখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। অন্যদিকে, দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি মিটিং করে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে, সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বর্তমানে দেড় লাখ মামলায় দলের প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মী আসামি। এ ছাড়া হামলায় সহস্রাধিক নিহত, ছয় শতাধিক গুম এবং হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও আহত হয়েছেন বলে দাবি করছে দলটি। এ পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও এবার দাবি পূরণ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এবং হতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন দলটির নেতারা।
দলের শীর্ষ নেতারা এটিও বলছেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ করতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে জনমত তৈরি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করা সহজ নয়। অবশ্য সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে জনগণ ও বিদেশিদের সমর্থন পাচ্ছেন তারা। তবে সরকারের হামলা-মামলার কারণে নেতাকর্মীরা রাজপথে দাঁড়াতে পারছেন না। গত দুটি নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন আর এবারের আন্দোলন এক নয়। সম্প্রতি বিভাগীয় গণসমাবেশ, মহানগর ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম হয়েছে। দলের দুঃসময়ে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী করতে বহিষ্কৃত নেতাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা চলছে বিএনপিতে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং বিভিন্ন সময় দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। আবার জনপ্রিয় ও রাজপথে ভূমিকা রাখার মতো নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় বাধা দিচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা। এ পরিস্থিতিতে সহস্রাধিক বহিষ্কৃত নেতাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একই সঙ্গে দলের সংস্কারপন্থি ও কোণঠাসা নেতাদেরও ফিরিয়ে আনা নিয়ে হাইকমান্ডের উদ্যোগ সফল হতে দিচ্ছেন না আসনভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ায় কিছুটা হতাশ দলটির হাইকমান্ড। পরিস্থিতি উত্তরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী কর্মসূচিতে উপস্থিতি কিছুটা সন্তোষজনক হলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মোকাবিলা করে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে কিনা, এ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, স্বৈরশাসকদের মতো সরকার রাজপথে হামলা-মামলার মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন করে আসছে। তার পরও বিএনপি নেতাকর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আশা করেন, এবার সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করেই দাবি আদায় করতে পারবেন।
আন্তর্জাতিক ‘চাপ’ কাজে লাগানোর চেষ্টা:
দেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপ দিচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী ব্যক্তি ও পরিবারকে ভিসা না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণায় খুশি বিএনপি। তবে প্রতিবেশী ভারত, চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানের সমালোচনা করায় কিছুটা চিন্তায় বিরোধী দলটি। একই সঙ্গে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়ে ১০০ নোবেল বিজয়ীসহ বিভিন্ন দেশের সাবেক সরকারপ্রধানদের বিবৃতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিএনপি। ‘আওয়ামী লীগ সরকার ড. ইউনূসবিরোধী’ হওয়ায় বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। অবশ্য বিদেশিরা কেউ এখনও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেননি। সংবিধানের অধীনে যথাসময়ে নির্বাচনের পক্ষে সরকারি দলের বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন না কেউ। শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং কেউ কেউ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশ, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা চাচ্ছে। কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে তারা নির্দলীয় সরকারের কথা না বললেও বিএনপির দাবির প্রতি কিছুটা সমর্থন রয়েছে। বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জনগণই বিএনপির শক্তি। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই তারা গণআন্দোলন গড়ে তুলবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে থাকে। বাংলাদেশে এসব মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের ঘাটতি থাকায় তারা বক্তব্য তুলে ধরছেন।
নির্যাতন করে নিশ্চিহ্ন করা যায় না, বললেন বিশ্লেষকরা:
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এক সময় বলা হতো, বিএনপি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোমরভাঙা দল। আন্দোলন কবে হবে? জনসমর্থনহীন দলে পরিণত হয়েছে। দলটিকে নিয়ে নানা মুখরোচক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হতো। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কর্মসূচিতে বিপুল লোকসমাগম দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপির জনসমর্থন এখনও ব্যাপক। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। দমন-নির্যাতন করে দলকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না, এটাই তার প্রমাণ। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দেশের বড় দলগুলোর মধ্যেই গণতন্ত্র নেই। ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে ধরনের রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, তা নেই। দলগুলোর অনাকাক্সিক্ষত আচরণ, স্বার্থপরতাও বর্তমান সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সত্যিকার অর্থে আদর্শিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দুর্নীতবাজদের বাদ দিয়ে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আনতে হবে। জনকল্যাণমুখী রাজনীতি হলে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপিতে নেতৃত্বের কাঠামো গড়ে উঠছে, তবে সরকারি দলের কাঠামোতে ভিন্ন সংকট রয়েছে।