আয় কমেছে বাড়ছে ব্যায়, ভারী হচ্ছে ঋণের বোঝা

- আপডেট সময় : ০২:২৮:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ জুন ২০২৩ ৩৮ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশে মাথাপিছু আয় কমেছে। সেইসঙ্গে ভারি হচ্ছে ঋণের বোঝা। যে কারণে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে সরকারকে। অথচ গত কয়েক বছর ধরে ঊর্ধ্বমুখীই ছিল মাথাপিছু আয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজর ৫৯১ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৪ ডলারে। কিন্তু গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১ শতাংশ কমে ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে গত এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৬৫২ টাকা। ফলে আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায় ১ লাখ ৫ হাজার ২৫২ টাকা ঋণের দায় চাপবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ঋণনির্ভর হয়ে পড়ায় দেশে মাথাপিছু ঋণ আরও বাড়বে। আগামী এক বছরে আরও ১৫ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২০ হাজার ৪৩৯ টাকা। এ কারণে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেখেছে সরকার। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ ৪৪ হাজার ৮৬৩ টাকা। এ হিসাবে ঋণ মাথাপিছু বরাদ্দের প্রায় আড়াইগুণ। তারা বলছেন, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকার প্রতি বছর দেশীয় উৎস থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক নয়। এটা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ৯ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে। আরও শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির তুলনায় করের অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ থাকা উচিত। তিনি বলেন, করের হার বাড়াতে পারলে ঋণ কমবে। আর উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের আভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ১৫ লাখ ৫ হাজার ৩৬৩ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এই ঋণ জিডিপির ৩৪ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ১ লাখ ৫ হাজার ২৫২ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ৯ হাজার ৬৫২ টাকা।
এদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য আরও ২ লাখ ৫৭। হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে। ফলে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি কমপক্ষে আরও ১৫ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়বে। এই ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেয়া হয়, তার বিপরীতে সরকারকে বছরে ১০ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এ কারণে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার, যা তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় সমান।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসির (সিপিডি) বাজেট বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের বড় অংশই দেশীয় ঋণ। এর সুদ অত্যন্ত বেশি। এর ফলে বেসরকারি খাতেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বাজেটে ঋণ নির্ভরতা কমানোর জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তাই রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সংস্কার জরুরি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তুলনামূলকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকার সহজ পথ হিসাবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। এতে আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যায়। বর্তমানে দেশে মুদ্রার পরিমাণ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমানত ১৫ লাখ ৫ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা এবং জনগণের হাতে নগদ টাকা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। আবার আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানত ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা এবং তলবি আমানত ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা।
কমেছে আয়:
২০২২-২৩ অর্থবছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১ শতাংশ কমে ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবের বরাত দিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিষয়টি জানিয়েছেন। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম অবশ্য বলেছেন, চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হওয়ায় টাকার অংকে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৪ ডলারে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত ও দেশে চলমান ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়, এতে ডলারের অংকে মাথাপিছু আয়ও কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুসারে, গত ছয় বছরে দেশে মাথাপিছু আয় ৯৩ শতাংশের বেশি বেড়ে ৭ হাজার ৬১৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৬ সালে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু মাসিক গড় আয় ছিল ৩ হাজার ৯৩৬ টাকা। সে হিসাবে, গত ছয় বছরে তা বেড়েছে ৩ হাজার ৬৭৮ টাকা। বিবিএস জরিপের তথ্য অনুসারে, দেশের প্রতিটি পরিবার মাসে গড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা আয় করে। প্রতি প্ররিবারে চারজনের সামান্য বেশি সদস্য ধরে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬১৪ টাকায়।
ধারদেনায় চলছে সরকার:
লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ হচ্ছে না। এমনকি গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভিন্ন খাত থেকে যেভাবে কর, শুল্ক পেয়েছে, এ বছর তাও পাচ্ছে না। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতেও ধস। তাই উন্নয়ন প্রকল্পসহ প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহের জন্য ধার করার বিকল্প নেই সরকারের। ফলে সরকারের বাজেট ঘাটতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধার নেয়ার পরিমাণ বাড়ছেই। জানা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে এ উৎস থেকে নেয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২১ পঞ্জিকা বর্ষেই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংক খাত থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রির মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। এক দশক আগে ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে হয় ৫ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। গত বছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সরকারের নেয়া প্রত্যক্ষ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ট্রেজারি বিল- বন্ড বিক্রি করে সরকার ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে গত এক বছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায়ে সরকারের ব্যর্থতার কারণেই প্রতি বছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে। তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশই এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে চলে না। এটি বাড়ানো সম্ভব না হলে ধারদেনা করেই চলতে হবে সরকারকে।