অস্বাভাবিক দাবদাহে পুড়ছে দেশ

- আপডেট সময় : ০৯:৪৫:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩ ৭ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
টানা চার দিন ধরে বেড়ে চলেছে তাপমাত্রার পারদ। দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে তীব্র দাবদাহ। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আবারও উঠেছে ৪১ ডিগ্রির ঘরে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরক্ষরেখায় ঢেউয়ের উৎপত্তি হওয়ায় পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এছাড়া বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে গরম একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছে। এদিকে তীব্র গরমের কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। কিন্তু জ্বালানির অভাবে দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে না। ফলে গরমের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এতে সার্বিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। অন্যদিকে, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সারা দেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (বর্ষাকাল) বিস্তার লাভ করতে পারে। এতে চার-ছয় দিন হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বজ্র ঝড় হতে পারে। এ মাসেই বঙ্গোপসাগরে একটি বা দুটি লঘুচাপ সৃষ্টির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া দেশে মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সে.) থেকে মাঝারি (৩৮-৪০ ডিগ্রি সে.) ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কতিপয় স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। উত্তরের জেলা দিনাজপুরে বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দীর্ঘ ৬৫ বছর পর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে জেলাটিতে। ভ্যাপসা গরমে উত্তরের জেলাগুলোর মানুষ যেন সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! রাজধানীর তাপমাত্রাও এর কাছাকাছি অবস্থান করছে। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে অনুভূত হয়েছে ৪২ ডিগ্রির মতো। ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষের স্বস্তি নেই। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, গরম থেকে আপাতত নিস্তার নেই। ৮ বা ৯ জুনের পর বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ ৭ জুন পর্যন্ত দেশের দাবদাহ অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়াবিদ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বর্ষাবাহী মৌসুমি বায়ু উপকূলের কাছাকাছি চলে আসায় বাতাসে ব্যাপক পরিমাণ জলীয়বাষ্প ভেসে আসছে। জলীয়বাষ্প বেশি থাকলে গরমের অনুভূতিও বেশি হয়। ফলে এখন ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। তাপপ্রবাহ দেশের চার জেলায় তীব্র রূপধারণ করেছে। ৪৪ জেলায় চলছে মৃদু থেকে মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ। এই তাপমাত্রা অস্বাভাবিক।’ আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও সৈয়দপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে চলছে সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে। এছাড়া ঢাকা, ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগ এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বাকি জেলাগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ হয়ে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহের পাশাপাশি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে ঢাকা, যশোর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। ঢাকার আশপাশেও তিন থেকে চার ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে ভুগছেন মানুষ। বুধবার থেকে শুরু হওয়া এই লোডশেডিং শুক্রবার কিছুটা কমেছে। এ বিষয়ে ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বলছে, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি সমন্বয় করতে নিয়মিত লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ঢাকা শহরে বুধবার গড়ে তিন ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করেছে দুই বিতরণ সংস্থা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপস্নাই কোম্পানি (ডেসকো) ১৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পেয়েছে। একই সময়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) কম সরবরাহ পেয়েছে ৩৫০ মেগাওয়াটের মতো। শুক্রবারও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পায়নি বিতরণ সংস্থা দুটি। তীব্র গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি ইউনিট আজ অথবা আগামীকাল বন্ধ হয়ে যেতে পারে জ্বালানি স্বল্পতার কারণে। কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম এ তথ্য জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গরম না কমায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। চাহিদা যত বাড়ছে, ঘাটতিও তত বাড়ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর তথ্য অনুযায়ী, বুধবার মধ্যরাতে লোডশেডিং আড়াই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। রাতভর প্রতি ঘণ্টায় দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি করে লোডশেডিং হয়েছে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার তথ্য বলছে, বুধবার রাতে লোডশেডিং হয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পলস্নী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বুধবার দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেড় হাজার মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করেছে প্রতি ঘণ্টায়। সন্ধ্যার পর এটি আরও কিছুটা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় তারা সরবরাহ কম পেয়েছে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। শুক্রবারও একই রকম সরবরাহ পেয়েছে সংস্থাটি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য অনুযায়ী, আগামী জুলাই মাসে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত ৬০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরের শেষে তা ৮০ শতাংশ বাড়তে পারে। নাসার বিজ্ঞানীরাও স্যাটেলাইটের ছবি পর্যবেক্ষণ করে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ স্রোত দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দিক দিয়ে এগোতে দেখেছেন। এতে সাগরে ঢেউয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর নিরক্ষরেখায় ঢেউয়ের উৎপত্তি হওয়ায় পানির তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাগর থেকে মৌসুমি বায়ু যতটা বেগে পূবদিক থেকে পশ্চিমে আসার কথা ছিল, ততটা আসেনি। ফলে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় খরা জাতীয় অবস্থা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগের বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে করোনা মহামারির বৈশ্বিক পরিস্থিতি অবসানের পর আর্থিক ক্ষতি কাটাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহারে ঝুঁকেছে। এতে আবহাওয়া আবারও চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। ১৯ শতকের শেষ দিকের উষ্ণতার চেয়ে বর্তমানে তাপমাত্রা প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি। সবকিছু মিলিয়ে এর খেসারত দিতে হচ্ছে উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশের মানুষকে। গাইবান্ধা থেকে ইসলাম শফি জানান, কয়েকদিনের টানা খরতাপে কাহিল হয়ে পড়েছে জেলার মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাপপ্রবাহ চরম আকার ধারণ করছে। এ সময় বাইরে বের হলেই মনে হয় গায়ে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড গরমে শহরের রাস্তা যানবাহন ও লোকশূন্য হয়ে পড়ছে। গরমে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। তীব্র গরম থেকে একটুখানি প্রশান্তির আশায় প্রকৃতির কোলে আশ্রয় খুঁজছে মানুষ। বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলায় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। এদিকে তীব্র গরমের কারণে পেটের পীড়াসহ নানা রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ইতোমধ্যে জেলার হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গত দুদিনে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি বেড়েছে। অন্যদিকে দিনে ও রাতে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে জেলার মানুষ অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না পাওয়ায় লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।