দেশে ৪৩ শতাংশ শিশু রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে

- আপডেট সময় : ১২:১৭:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ মে ২০২৩ ৬ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশে দুই দশকে পুষ্টির সর্বোচ্চ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। প্রি-স্কুল বাচ্চাদের এক-তৃতীয়াংশ খর্বাকৃতির, এক-পঞ্চমাংশের বেশি কম ওজনের এবং দশভাগের এক ভাগ ক্ষীণকায়। ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুদের ৪৩ শতাংশই রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। বিবাহিত নারীদের এক-তৃতীয়াংশের ওজন প্রত্যাশিত মাত্রার নিচে। ১৩ শতাংশ লম্বায় খাটো। যে কারণে শিশু জন্ম দেওয়ার সময় তারা নানা জটিলতায় ভোগে এবং কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। আইসিডিডিআর’বি-এর এক সমীক্ষায় এসব তথ্য এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খাওয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়লেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন এখনো সম্ভব হয়নি। প্রোটিন বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব, ভুল ধারণা ও অপপ্রচার এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের কথা মানুষ গুরুত্বের সঙ্গে শোনেন এবং তা মেনে চলার চেষ্টা করেন। সবার জন্য প্রোটিনের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে খাদ্যের পাশাপাশি প্রোটিনকেও মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডক্টর খালেকুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের গেস্নাবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। কাজেই একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর দিতে হবে, তেমনি খাদ্যের মান উন্নত করার দিকেও নজর দিতে হবে। প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, উদ্ভিজ্জ্য ও প্রাণিজ আমিষের সম্মিলনে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। রেডমিটে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে তবে হোয়াইট মিট তুলনামূলক নিরাপদ।
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. জহিরুল কবির খান বলেন, দেশে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের খাবারে প্রোটিন ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে এদের ৩৬ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে। তিনি বলেন, ভ্রম্নণ জন্মের পর থেকেই গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শিশু জন্মের পর মায়ের দুধ এবং ৬ মাস পর থেকে সাপিস্নমেন্টারি ফুড দিতে হবে। সঠিক জ্ঞানের অভাবে গ্রামের মানুষ বাচ্চাদের সাপিস্নমেন্টারি ফুড দিতে পারে না। চিকিৎসকরা রোগীদের সাহায্য করলে গ্রামের মানুষও প্রোটিন সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সাপিস্নমেন্টারি ফুড কিভাবে, কতটুকু বাচ্চাকে দিতে হবে তাও শিখতে পারবে।
এ বিষয়ে বারডেমের হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া আইসিডিডিআর’বি এর সমীক্ষা উলেস্নখ করে বলেন, বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পুষ্টি ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রি-স্কুল বাচ্চাদের এক-তৃতীয়াংশ খর্বাকৃতির এক-পঞ্চমাংশের বেশি কম ওজনের এবং দশভাগের এক ভাগ ক্ষীণকায়। ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুদের ৪৩ শতাংশই রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। বিবাহিত নারীদের এক-তৃতীয়াংশের ওজন প্রত্যাশিত মাত্রার নিচে; ১৩ শতাংশ লম্বায় খাটো যে কারণে শিশু জন্ম দেওয়ার সময় তারা নানাবিধ জটিলতায় ভোগে এবং কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। মহুয়া বলেন, স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রোটিন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো অনুপস্থিত। ফলে শিশুদের মধ্যে প্রোটিন বা পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, প্রোটিন ঘাটতির কারণে নানাবিধ রোগব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব প্রজননক্ষম মানুষের মধ্যে ইনফারলিটির সংখ্যা বাড়ছে। আমরা যদি বাংলাদেশের মানুষের আয়ুষ্কাল ৮৫ বছর এবং কর্মক্ষম বয়স সীমা ৭০ বছরে উন্নীত করতে চাই তবে অবশ্যই প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ আরও অনেক বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল এবং আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান (শাহরিয়ার) বলেন, একটা সময় ছিল যখন তিন বেলার খাবার কিভাবে জুটবে সে কথা ভাবতাম। সে চাহিদা পূরণ হওয়ার পর জোর দেওয়া হলো সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন- শুধু ভাত খেলে হবে না, পুষ্টিও নিশ্চিত করতে হবে। পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি থেকে সব মানুষের প্রোটিনের অধিকারও নিশ্চিত করা সম্ভব।
ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের বাংলাদেশ টিম লিড খবিবুর রহমান কাঞ্চন বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রোটিন চাহিদা পূরণ করতে হলে আমাদের স্বল্প জায়গায় পরিবেশের ক্ষতি না করে অধিক পরিমাণ মাছ, মাংস, ডিম উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে।
এদিকে, ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের প্রোটিন বিষয়ক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না প্রতিদিন কতটুকু প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ ডাল বা ডাল জাতীয় খাদ্যকে এবং ৪৪ শতাংশ মানুষ শাক-সবজিকে প্রোটিনের বড় উৎস বলে মনে করে। ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করে- প্রোটিনের চেয়ে ভিটামিন ও মিনারেল অনেক বেশি দরকারি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- প্রতি ৩ জনের ১ জন বাংলাদেশি মনে করে যে প্রোটিন ঘাটতিতে স্বাস্থ্যের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। মানুষ এখনো মনে করে- ডিম খেলে হার্টের সমস্যা হয়, প্রেসার হয়, শরীর মোটা হয়ে যায়, অপারেশনের রোগীকে ডিম দেওয়া যাবে না, বয়স্কদের ডিম-মাংস দেওয়া যাবে না। ব্রয়লার মুরগিকে হরমোন দেওয়া হয়, কাজেই পোল্ট্রি মাংস খাওয়া যাবে না অথচ এগুলো সবই ভুল ধারণা। প্রোটিন সচেতনতা বাড়াতে চিকিৎসকরা এগিয়ে এলে গ্রামের সাধারণ মানুষের উপকার হবে, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে, জাতি আরও মেধাবী হবে, সরকার ও রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হবে।