মূল্যস্ফীতির তথ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি!

- আপডেট সময় : ১০:৫৮:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ মে ২০২৩ ৩১ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে দেশে চলতি বছরের মার্চের তুলনায় এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমেছে। এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। মার্চে এর হার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির এসব তথ্য উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন এ হারের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তাদের ভাষ্য, বাজারে পণ্য মূল্যের যে অবস্থা বিবিএসের তথ্যে তার প্রতিফলন ঘটেনি। এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়াটা দেশের বাস্তবতায় রীতিমতো বিস্ময়কর।
নিত্যপণ্যের বাজারের বাস্তবতা ও সরকারের নির্ধারিত হিসাবে বিস্তর অমিলের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্ধতিগত ত্রম্নটির কারণে বরাবরই এমনটি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে চালের মূল্য বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখলেও অন্য পণ্যের ব্যাপারে কোনো খেয়াল রাখে না। এতে দেখা যায়, অন্য সব পণ্যের দাম বাড়লেও চাল নিয়ন্ত্রণ থাকায় মূল্যস্ফীতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলেন, বিবিএস যে হিসাব করে তা গড় মূল্যের ভিত্তিতে। ফলে একটি পণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি আরেকটি পণ্যের দাম কম থাকে। এই গড় মূল্য নির্ধারণের কারণে বিবিএসের হিসাবে বাজারের প্রকৃত চিত্রে প্রতিফলন হয় না। এতে দেখা যায়, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি ততটা বাড়ছে না।
গত ৩ মে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি মার্চের তুলনায় দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে। মার্চে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। যা থেকে কমে এপ্রিলে হয় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কাছাকাছি ছিল। মার্চের মতোই এপ্রিলেও এই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ ছিল বলে বিবিএসের প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে।
তবে ভোক্তারা বলছেন, সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে জিনিসপত্রের দামে কোনো স্বস্তি নেই। বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। অনেক পণ্য সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কেজিতে ১০৪ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে ১০৯ টাকা বেঁধে দিয়েছিল সরকার। তবে এ সময় বাজারে খোলা চিনি ১১২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ন্যূনতম ১১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। একইভাবে মে মাসের প্রথমভাগে সরকার চিনির দাম এক লাফে ১৬ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা কেজি দরে। চিনি ছাড়াও তেল, লবণসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও অনেক সময় সরকার নির্ধারিত দাম মানা হয় না। অথচ মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে বিবিএস সরকার নির্ধারিত দামই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। ফলে ঊর্ধ্বমুখী পণ্যের
মূল্যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলেও মূল্যস্ফীতি কমার অযৌক্তিক চিত্র পাওয়া যায়। মূল্যস্ফীতি বাড়ার যে পরিসংখ্যান বিবিএস প্রকাশ করে তার সঙ্গে বাস্তবতার যথেষ্ট ফারাক থাকে বলে অভিযোগ করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমছে- এ প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ডক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সবগুলো খাদ্যপণ্য মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে না। বিশেষ করে চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে চালের দাম স্থিতিশীল। এমনকি কোনো ক্ষেত্রে কমেছেও। যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, এগুলো মূলত আমদানি পণ্য। যেমন তেল, চিনি, পেঁয়াজ। এগুলো খুব বেশি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে না। এ কারণে মার্চের তুলনায় এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে।
ডক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান বাজারমূল্যে সব শ্রেণির মানুষের ওপর প্রভাবটা সমান নয়। দেশে তিন শ্রেণির ভোক্তা আছে। একটা শ্রেণির হাতে অনেক অর্থ। তারা বাজার করার পরও প্রচুর অর্থ তাদের হাতে থাকে। আরেকটি শ্রেণির হাতে কিছু উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে। সেই অর্থ দিয়ে তারা বাজার করছে। আরেকটি শ্রেণি আছে যারা সব সময় ঘাটতিতে থাকেন। এই শ্রেণির মানুষ প্রচন্ড চাপে আছে। এই শ্রেণির মধ্যে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বেশি, বিশেষ করে চাকরিজীবী।
এদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্যে যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে তা সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেও তার স্পষ্ট চিত্র মিলছে। রাষ্ট্রীয় ওই দুই সংস্থার ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ মে মাসে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৮ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ১২ টাকা বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে আদা কেজিপ্রতি ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা দরে। এপ্রিলে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা। এখন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৬-৮০ টাকায়। চিনি, রসুনসহ অন্যান্য জিনিসের দামও ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া সরকারের ওই দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে সবজির বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। মাছসহ সব ধরনের সবজি অত্যধিক চড়া মূল্যে কিনতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় ও টিসিবির হিসাবে মে মাসের মতো এপ্রিলে বাজারে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতির ধারায় ছিল। পণ্যের মূল্য বেশি থাকায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের লোকজন হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু বাজারের এমন উত্তাপ সত্ত্বেও হিসাব-নিকাশের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে সরকারি সংস্থা বিবিএস তথ্য প্রকাশ করেছে মূল্যস্ফীতি কমছে।
জানা গেছে, সোয়া চারশ’ পণ্য ও সেবা দিয়ে মূল্যস্ফীতি গণনা করে বিবিএস। সংস্থাটির মূল্যস্ফীতির গণনায় মোটাদাগে ৪৭টি পণ্যের দামের হিসাব থাকে। বিবিএসের হিসাবে দেখা গেছে, মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে ওই পণ্যের অর্ধেকেরও বেশি দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিবিএস সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির ভিত্তি বছর পরিবর্তন করেছে। এজন্য তাদের বৃদ্ধির হারটা সেভাবে বোঝা যায় না। বিবিএসের মূল্যস্ফীতির বাস্কেটে চালের ওয়েট (অংশ) অনেক বেশি। এজন্য মাছ বা সবজির দাম বেশি হলে তা মানুষ খেতে না পারলেও চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখলেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই বিবিএসের বাস্কেটে চালের অংশ কমিয়ে অন্যান্য পণ্যের ওয়েট বাড়ানো উচিত।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘যেভাবে বাজারের গড় করে বিবিএস মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করে সেটি যৌক্তিক নয়। কারণ বাজারে সব ক্রেতা সব ধরনের পণ্য কেনে না।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ প্রকৃত যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে, সেটি সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হচ্ছে না। দরিদ্র মানুষের ব্যয়ের বেশিরভাগ খাদ্যের পেছনে যায় বলে তাদের পক্ষে ব্যয় কমানো সম্ভব হয় না।
বিবিএস’র মূল্যস্ফীতি পরিমাপ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে সানেম বলছে, পরিবারের অর্থ ব্যয়ের ধরন বা ভোগের ধরন নিরূপণ করা হয় ২০০৫-২০০৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের জন্য দু’টি আলাদা ভোগ্যপণ্যের তালিকা বা কনজ্যুমার বাস্কেট নির্ধারণ করা হয়। শহরের ভোক্তাদের এ তালিকায় আছে খাদ্য, অন্যান্য নানা ব্যবহার্য জিনিসসহ ৪২২টি পণ্য এবং একইভাবে গ্রামের ভোক্তাদের তালিকায় আছে ৩১৮টি পণ্য। ভোক্তা মূল্যসূচক তৈরি করতে কোনো পণ্যের গড় মান (পরিসংখ্যানের ভাষায় যাকে বলা হয় ওয়েট) কত হবে, সেটি বিবিএস নির্ধারণ করে একটি পরিবারের মোট খরচের কত অংশ কোন পণ্যের পেছনে যায়, তার ভিত্তিতে। আর এ উপাত্তের উৎস ২০০৫-২০০৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ। অথচ এরপর দেশে আরও একটি খানা আয় ব্যয় জরিপ হয়েছে ২০১৭ সালে। এ ছাড়া শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছে।
সানেম বলছে, খাদ্যবস্তুর যে তালিকার ভিত্তিতে বিবিএস জরিপ করে, তার বেশির ভাগই গরিব মানুষ কেনে না। ফলে মূল্যস্ফীতি পরিমাপের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। আবার ২০০৫-২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশের দরিদ্র ও সচ্ছল উভয় শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। অথচ বিবিএস যখন সিপিআই হিসাব করে, তখন এ খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বিবেচনায় আসে না।
নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতে সানেম বলছে, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে তাদের মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। আর গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিবিএস এ ক্ষেত্রে যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় এ হার অনেক বেশি। বিবিএসের হিসাবে শহর ও গ্রামের পরিবার তাদের মোট খরচের যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে।