নজরুল কাব্যে কৃষিজীবী ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী

- আপডেট সময় : ০১:০৯:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ অগাস্ট ২০১৬ ২৭৪৯ বার পড়া হয়েছে
-মুন্সি আবু সাইফ
নজরুলের কবিতায় সমাজের কৃষিজীবী ও পিছিয়ে পড়া মানুষের মর্মবেদনা প্রকাশিত হয়েছে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক-মজুর, কামার, কুমোর, জেলে তাঁতি, বঞ্চিত নারীসমাজ ও পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যে অতি দরদী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
নজরুল ইসলাম নিজে অতি গরীব ঘরের সন্তান ছিলেন বলে বাংলার কৃষক ও হতদরিদ্র মানুষগুলোর দুঃখ, যন্ত্রণার দিকগুলো অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। যে সংগ্রামকে তিনি সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন সে অভিজ্ঞতা কাল্পনিক বা তত্ত্বগত ছিল না। তা নজরুলের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত।
নজরুল মনে করেছিলেন, কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রয়েছে কৃষকের হাতে। তাই কৃষকদের প্রতি যথাযত সম্মান প্রদর্শন করে নজরুল বলেছেন-
“ আপনারাই দেশের প্রাণ, দেশের আশা, দশের আশা, দেশের ভবিষ্যত। মাটির মায়ায় আপনাদের হৃদয়ে কানায় কানায় পূর্ণ, ভরপুর। মাটির খাঁটি ছেলে আপনারাই। রৌদ্রে পুুড়িয়া বৃষ্টির প্রথম দিন হইতে আপনারাইতো এই মাটির পৃথিবীকে প্রিয় সন্তানের মতো লালন পালন করিয়াছেন, করিতেছেন, করিবেন”।
নজরুল ইসলামের কবিতায় কৃষকের জীবনের দুর্দশাকাতর ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় তিনি প্রশ্ন রেখেছেন-
“ জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?”
একই কবিতায় নজরুল ইসলাম কৃষকদের জীবনের বঞ্চনার করুণ কথামালা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। একই সাথে কবি শান্ত , সুস্থির আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন-
“সমাধির মাঝে গুনিতেছে দিন, আসবেন তিনি কবে ?
রোজা ইফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে ?”
নজরুল ইসলামের সমসাময়িক কৃষক সমাজের অস্তিত্ব ছিল ক্ষত-বিক্ষত। অথচ রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যোগানদাতা ছিলো কৃষক। কিন্তু, নীল চাষ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, জমিদারি প্রথার উত্থান, খাজনা আদায় -এর কোনটিই কৃষক স্বার্থের অনুকূলে ছিলো না। নজরুল ইসলাম কৃষকদের পূর্ব ঐতিহ্য, স্বচ্ছলতা ও হারানো গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দীপ্ত বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন-
“ আজ জাগরে কৃষাণ, সব তো গেছে, কিসের বা আর ভয়”।।
পেশাগত কারণে কৃষকদের সমান্তরালে শ্রমিক মজুর শ্রেণির এই প্রান্তিক মানুষগুলোও বঞ্চিত হয়েছে প্রাপ্য অধিকার থেকে। অপেক্ষাকৃত কঠিন পরিশ্রম করে বলেই, তারা সমাজ রাষ্ট্রের প্রাণশক্তির যোগানদাতা অথচ তারা নিম্নবর্গভূক্ত ও অভুক্ত। নজরুল বলেন-
“যাহারা আপনাদের বিন্দু বিন্দু রক্ত দান করিয়া হুজুরের অট্টালিকা লালে লাল করিয়া তুলিতেছে, যাদের অস্থিমজ্জা ছাঁ ঢালিয়া রৌপ্য মুদ্রা তৈরি হইতেছে, যাহাদের চোখের জল সাগরে পড়িয়া মুক্তা মানিক ফলাইতেছে, তাহারা আজ অবহেলিত, নিষ্পেষিত, বুভূক্ষু। তাহাদের শিক্ষা নাই, দীক্ষা নাই, ক্ষুধায় পেট পুরিয়া আহার পায়না, পরণে বস্ত্র নাই”।
নজরুলের কবিতায় নিপীড়িত মানুষের প্রতি অনুপ্রেরণা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেন “ নিপীড়িত জনগণের জয়ধ্বনি এমন বলিষ্ঠভাবে, এমন উদাত্তভাবে, এমন নিঃশঙ্কভাবে বাংলা কবিতায় আগে উচ্চারিত হয়নি”।
নিম্নবিত্ত মানুষগুলো সামাজিক শ্রেণি বিভক্তির শুরু থেকেই বঞ্চিতের তালিকাভূক্ত। নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের সাথে একাত্ম ঘোষণা করে কবি লিখেছেন-
“ নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই
জুলুমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই”
পৃথিবীতে যে সমস্ত অবতার, পয়গম্বর আবির্ভূত হয়েছেন তাঁরা সবাই এসেছেন নিম্নবর্গের ছদ্মবেশে। কারণ মিথ্যা প্রাচুর্যে ঈশ্বরের স্থিতি অসম্ভব। ভারতীয় পুরাণে ও পশ্চিম এশীয় ইতিহাসে তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
নজরুলের কবিতায় অঙ্কিত অধিকাংশ পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চরিত্র যেমন হরিশচন্দ্র , ব্রজগোপাল, ভোলানাথ, গিরীজয়ী বলরাম, ইউসুফ নবী, হজরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রমূখ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিবর্গ সবাই নিম্নবর্গের প্রতিনিধি। জীবনকে তারা অতি দরিদ্রের মধ্যে গ্রহণ করেছেন। তাই এই মহামানবগণের প্রদর্শিত পথকে যারা কলঙ্কিত করেছে নজরুল তাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী মনে করেন।
নজরুলের দৃষ্টিতে চোর-ডাকাত, পাপী-তাপী, নারী-পুরুষ, রাজা-প্রজা, কুলি-মজুর, সতী-বারাঙ্গণা সবাই সমান। মানুষের পরিচয় চন্ডাল, রাখাল, চাষী, মজুর নয়, তার একমাত্র পরিচয় সে মানুষ। আর এই মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের অবস্থান। মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। অন্য দিকে, মানুষকে ঘৃণা করলে ঈশ্বর ও তার সৃষ্টি অপমানিত হন।
“ কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই কাহারে মারিছ লাথি
হয়ত উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি”
কাজী নজরুল সম্পাদিত বিখ্যাত ‘লাঙল’ পত্রিকাটি ছিল কৃষিজীবী ও গরীব মানুষের আশার স্থল।
লাঙল পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, “ ভারতের জাতীয় দাবি পূরণের এখনো একমাত্র অবশিষ্ট উপায় এই, যে দেশের শতকরা আশিজন যাহারা- সেই শ্রমিক ও কৃষকগণকে সংঘবদ্ধ করা এবং তাহাদিগকে জন্মগত অধিকার লাভের সাহায্য করা”। তিনি যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন তার নাম ছিলো ‘কৃষক প্রজা পার্টি’।
নজরুলের সাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে অবহেলিত ও বঞ্চিত নারী সমাজের কথা।
অবস্থা ও ঘটনার শিকার হয়ে অনেক নারীকে নিষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। কেউ তাদেরকে দেহপসারিনী , কেউ তাকে বেশ্যা , কেউ নটি, কেউবা পতিতা নামে আখ্যায়িত করে থাকে।
আধুনিক যুগে তাদেরকে ‘যৌনকর্মী’ নামেও ডাকা হচ্ছে। প্রায় শত বছর আগে ‘ বারাঙ্গনা’ কবিতায় নজরুল ইসলাম তথাকথিত এই ‘অস্পৃষ্য নারীদেরকে’ ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন-
“কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা,কে দেয় থুতু ও গায়ে ?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা সম সতী মায়ে”
মহৎ কবির চেতনা অত্যন্ত শাণিত। বড় কবি শুধু সমস্যা চিহ্নিত করেন না। তিনি সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশ দান করে থাকেন । নজরুলের ক্ষেত্রে বিষয়টির ব্যতিক্রম ঘটলে তিনি হয়তো বাংলা কাব্যে দুঃখবাদী কবি হিসেবেই চিিহ্নত হয়ে থাকতেন। কিন্তু নজরুলের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। কারণ কবি নজরুল জীবনমন্থনবিষ নিজে পান করেছেন আর অমৃত দান করেছেন অবহেলিত ভাগ্যহতদের জন্য।
প্রাবন্ধিক
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ।
পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।