সঙ্গীত শিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাসের সাথে চায়ের আড্ডার আলাপচারিতায় ঘন্টা পার -হুসাইন মালিক, বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সময়ের সমীকরণ।

- আপডেট সময় : ০৫:২৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ অগাস্ট ২০১৬ ১৬৪৯ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় হুইপ এবং চুয়াডাঙ্গা গণমানুষের নেতা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার এমপি চুয়াডাঙ্গায় অবস্থান করা মানেই প্রশাসন আর সাংবাদিকদের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়া। আমি সারাদিন হুইপ মহোদয়ের প্রোগ্রামগুলো কভার করতে ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় ব্যস্ততা কমলে সোজা অফিসে চলে এলাম। প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদগুলো কাটাছেড়া করে পাঠক উপযোগী করতে বেশ মনোযোগী হয়ে অফিস ডেস্কে, আমার একটাই öলক্ষ্য নিউজগুলো দ্রুত শ্যামল দার হাতে পৌঁছানো। খুব সকালে গ্রাহকের হাতে পত্রিকা পৌঁছাতে বাসের ফাস্ট ট্রিপের কথা মাথায় রেখেই কাজ করতে হয় আমাদের। ভীষণ গরমে অঝোরে গা ঘামছে প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন ভাই অফিসে ঢুকেই এসির মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন আর আমাকে বললেন হুসাইন এগজাস্ট ফ্যানটা চালিয়ে দাও, দেখো গরম পালাবে। আমি এগজাস্ট ফ্যানের কর্ডটা টানতেই আমার মোবাইল ফোন টা বেজে উঠলো ওপার থেকে ছোট বোন সিনথিয়া বললো ভাইয়া তোমার প্রিয় শিল্পী এখন আমাদের বাড়ী, বাবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আমি ওর কথা শেষ করার আগেই ফোনটা কেটে দিয়ে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লাম প্রিয় শিল্পীর একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য। মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দারের বাড়ী যখন পৌঁছালাম রাত তখন আটটা। চেয়ারম্যানের বাড়ী দ্বিতীয় তলায় ড্রয়িং রুমে পৌঁছাতেই মামির চা পরিবেশন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই নকুল কুমার বিশ্বাসের সাথে আলাপচারিতা, শুরু হল জমকালো আড্ডা। আমি নকুল কুমার বিশ্বাসের কাছে তার পারিবারিক জীবন নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি এক নিশ্বাসে বললেন ১৯৬৫ সালে মাদারীপুর জেলার দত্তকেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া গ্রামের এক সংগীত পরিবারে আমার জন্ম। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে আমার অবস্থান ৫ম। মা শ্রীমতী মঙ্গলী দেবী ও বাবা সুরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস অনেক আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, বলতেই চোখের কোনে একফোটা জলের সন্ধান পেলাম। যাহোক সাংবাদিক তো এগিয়ে গেলাম আলোচনায়। তিনি আবারো বলতে শুরু করলেন আমার স্ত্রী এবং আমার দুই সন্তান পলক কুমার বিশ্বাস ও মেয়ে প্রত্যাশা বিশ্বাসকে নিয়ে সুখের সংসার আমার। সঙ্গীতে কিভাবে এলেন প্রশ্ন করতেই, এক মিনিটের নিরবতা ভেঙ্গে চলে গেলেন শিশুকালে, বললেন সেই মেজভাই হীরালাল বিশ্বাসের হাত ধরে গোপালগঞ্জে ১৯৭৫ সালে যাত্রাদল দীপালি অপেরায় শিশুশিল্পী হিসেবে অডিশন দিতে আসি। অডিশনকক্ষে সেদিন আমার গান শুনে অবাক বনেছিলেন উপস্থিত সবাই! অডিশনকক্ষে হারমোনিয়ামে সুর তুলে একের পর এক গান শুনিয়েছিলাম সেদিন। মাদারীপুরের ওস্তাদ রণজিৎ দা’র কাছে হারমোনিয়ামে রাগ সংগীতের তালিম নিয়েছি আমি এবং মাত্র ছয় মাসেই এটা আয়ত্ত করেছি। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, প্রধান হারমোনিয়াম মাস্টার হিসেবে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। আমার গুরু আশু মিয়ার কাছে বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের গল্প শুনে মনে মনে ঠিক করলাম পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতো বিখ্যাত হতে হবে। ১৯৮০ সালে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পকেটে মাত্র ৫০০ টাকা আর মনের অদম্য সাহস নিয়ে পাড়ি জমায় কলকাতায়। কলকাতার সুভাষ বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রখ্যাত সেতারবাদক ওস্তাদ মোস্তাক আলী খানের নাতি-শিষ্য শ্রী রণজিৎ বিশ্বাসের কাছে কিছুদিন সেতার শিক্ষা নিই। সেই সময় ২৮০ টাকা দিয়ে একটি সেতার কিনি। এরপর ফিরে আসি নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে। দেশে ফিরেই এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান, অভিনয়, নৃত্য দিয়ে মানুষের মন জয় করতে থাকি। এরপর ১৯৮৩ সালে বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চলে আসি ঢাকায়। আশ্রয় পায় ওস্তাদ আমানউল্লাহ খানের বাড়ির ভাঙা বারান্দায়। তাঁর কাছে কিছুদিন তালিমও নিই। সে বছরই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উচ্চাঙ্গ সংগীতের এক আসরে এককভাবে হারমোনিয়াম বাজানোর সুযোগও পায়। উপস্থিত সবাই আমার পরিবেশনায় মুগ্ধ হন সে সময়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাকে কেন্দ্রের ফান্ড থেকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলো সেদিন। এরপর বাংলাদেশ বেতারে চাকরি হয় আমার। কিন্তু চাকরিতে মন বসাতে পারলাম না। ১৯৮৬ সালে আবারও গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলাম এসএসসি পরীক্ষা দিতে। ওই সময় এক কবিয়ালের কাছে তাঁর লেখা কিছু গান সংগ্রহ করতে গেলে সেই কবিয়াল গান না দেয়ায় অভিমান হয় আমার। এরপর নিজেই লেখা শুরু করি। সেই থেকে আজ অবধি অন্য কারো লেখা গান গায়নি। এসএসসি পাস করে পরের বছর আবার ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড এন্টার প্রাইজের ব্যানারে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম একক অ্যালবাম ‘ভাগবত পড়ে ভগবানকে পাইছোনি’। অ্যালবামটি হিট হয়। একই সঙ্গে গান ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের বিখ্যাত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে ‘দাদা বিয়া করলাম ক্যান’ গানটি গাওয়ার সুযোগ পাই। এই গানটি আমাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এরপর টানা দশ বছর ইত্যাদিতে জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে জীবনমুখী গান নিয়ে একেরপর এক হাজির হয়েছি। এরমধ্যে কলকাতার অডিও বাজারে লাগে আমার গানের ঢেউ। কলকাতার অডিও কোম্পানি জেএমডি থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় আমার ‘নদীয়ান নকুল’ এবং ২০০৩ এ এসডি অডিও কোম্পানির ব্যানারে প্রকাশিত হয় ‘চাকরি নাই বুড়ো বাবার’ নামে আরেকটি অ্যালবাম। ভারত-বাংলাদেশ আমার প্রায় অর্ধশত অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। আপনাদের ভালবাসায় প্রত্যেকটি অ্যালবাম হিটও হয়েছে। বর্তমানে কি নিয়ে ব্যস্ততা জানতে চাইলে তিনি জানালেন ২টি বই লিখছি
উল্লেখ্য, মাত্র আট বছর বয়সে যাত্রার দলে শিল্পী হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীতের ক্যারিয়ার শুরু। সেই থেকে যাত্রাসহ গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বহু অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছেন তিনি। গানের পাশাপাশি তিনি সেতার, তবলা, বাঁশি, সরোদ, সন্তুর, দোতারা, ও ম্যান্ডালিনসহ আরো নানারকম বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী, বিশেষ করে হারমোনিয়াম বাজানোতে রয়েছে তাঁর বিশেষ দক্ষতা। বাংলাদেশ বেতারে যন্ত্র ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে চাকরি করেছেন অনেকদিন। তবে ক্যারিয়ারে তাঁর সর্বসেরা সুযোগটি আসে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ‘ইত্যাদি’ তে গান পরিবেশনের সুবাদেই শ্রোতা-দর্শকদের কাছে তাঁর সর্বাধিক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। সংগীতাঙ্গনের পরিচিত মুখ নকুল কুমার বিশ্বাস। তিনি একাধারে কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গীতিকার। একের পর এক তুমুল জনপ্রিয় অ্যালবাম বের হয়েছে তার। ১৯৮৭ সালে রমজানের ঈদে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড এন্টারপ্রাইজ থেকে নকুলের সঙ্গীত ক্যারিয়ারের প্রথম একক অ্যালবাম ‘কনকর্ড ভলিউম-১’ প্রকাশিত হয়। বের হয় এক এক করে ৫০টি অ্যালবাম। ছন্দে ছন্দে কথা বলা ও উপস্থাপনায় এদেশে নকুল কুমারের বিকল্প সে নিজেই। ‘ছন্দ আনন্দ’ অনুষ্ঠানটি তার প্রমাণ। টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টে সব ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেছে এইটি। আর ‘ছন্দ আনন্দ’ উপমহাদেশের প্রথম অনুষ্ঠান যার পুরোটাই ছন্দে সাজানো। উল্লেখযোগ্য গান সমূহ ‘চাচায় চা চায়’ ‘এই আমার পকেটে আছে’ ‘মানুষটা পাঁচ ফিট’ ‘হ্যালো হ্যালো মাই ডিয়ার’ ‘মাগো তুমি যেন না কাঁদো’ ‘পাঁচতলার ঐ চিলেকোঠায়’ ‘ভালো হইতে পয়সা লাগে না’।