মুন্নার জন্য প্রার্থনা

- আপডেট সময় : ০৪:১৫:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ এপ্রিল ২০১৭ ১১৫১ বার পড়া হয়েছে
সাজ্জাদ হোসেন : (অকাল প্রয়াত নাট্যকর্মী হাবিবুর রহমান মুন্না’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। গতবছরের এই দিনে কক্সবাজার সমুদ্রপাড়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেদিনের বিয়োগান্ত ঘটনার অভিজ্ঞতা দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর জন্য লিখেছেন দর্শনাস্থ অনির্বাণ থিয়েটারের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন)। মুন্নার সাথে আর কখনো দেখা হবে না, কথা হবে না, হবে না আলিঙ্গন। সে এখন দূর আকাশের জমিনে বসত গড়েছে। আর আমরা ব্যাকুল প্রতিক্ষায় বসে আছি। মুন্না আসবে, মুন্না আসছে। জানি সে আর কখনই আসবে না। লক্ষ কোটি তারার রাজ্য থেকে কেউ কোনদিন ঘরে ফেরে না। মুন্নার সাথে শেষ সাক্ষাত ২০১৬ সালের ১এপ্রিল। কক্সবাজারে। সেদিন ছিল প্রকৃতির বড্ড মন খারাপ। সারারাত ঝড়-বৃষ্টির কান্নাকাটি, সকালে একই ঘটনার পুনারাবৃত্তি। প্রকৃতির সাথে একরকম যুদ্ধ করতে করতেই আমরা সেদিন সকালে কক্সবাজার পৌঁছালাম। উদ্দেশ্য ‘অনির্বাণ’ আয়োজিত বিচ থিয়েটার ক্যাম্পে অংশগ্রহণ। পূর্ব নির্ধারিত একটি আবাসিক হোটেলে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে সকালের নাস্তার জন্য সোজা খাবার হোটলে গিয়ে উঠলাম। সঙ্গে বাল্যবন্ধু কবির, টিপুুুুু ও টিটো খান। আমরা টেবিলে নাস্তার অপেক্ষায়। এমন সময় মুখভরা হাঁসি নিয়ে উল্কাপিন্ডের বেগে মুন্নার উপস্থিতি। এসেই যথারীতি সালাম, হাত বাড়িয়ে করমর্দন, বুক পাঁজরে আলিঙ্গন এবং কুশল বিনিময়। লাল প্যান্ট, সাদা টিসার্টে ওকে আজ বড় নিস্পাপ ও পবিত্র দেখাচ্ছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তখন মুকুল, শামীম, বাবু, মুন্নার সহধর্মিনী মাহমুদা ও একমাত্র সন্তান তাহমিদ। মুন্নার উচ্চারণ ‘এবার অনেক আনন্দ করবো’। বলি এসো নাস্তা করি। মুন্না বিনয়ের সুরে ‘আমি ওদের সাথে বসি’। আমরা সকলে হাঁ সূচক সম্মতি দিলে স্থান ত্যাগ করে। এতক্ষণে কিছু একটা শূণ্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। মুন্নার উপস্থিতি সেই শূণ্যতা পূণ্যতায় রূপ দিল। মনটা ভরে উঠলো।
মুন্নার উপস্থিতি মানে বাড়তি প্রেরণা। সেটা বাড়িতে, অফিসে, সংগঠনে, বনভোজনে কিংবা আড্ডাবাজীতে। সবখানে সবপ্রাণে। কারো নির্দেশের অপেক্ষা নয় বরং নিজ উদ্যোগে একাই সামলে নেয় দশদিক। এসব কাজগুলি তার নৈতিক দায়িত্ব মনে করে। এই মহানুভাবতার জন্য তিনি সকলের মাঝে সমান জনপ্রিয়। আর অনির্বাণ থিয়েটার কর্মীদের কাছে আত্মার-আত্মীয়, প্রেরণার উৎস। থাক সে সব কথা। নাস্তা শেষ করে আমরা এবার মুন্নার টেবিলের সামনে। বললো-‘ভাইয়া, রুমে গিয়ে প্রস্তুত হন, এক্ষুনি বীচে যাবো’। বললাম-‘মাথা খারাপ! আবহাওয়া ভালো না। আমাদের সবারই বউ-বাচ্চা আছে ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হবে না’। কিছুক্ষণ এসব নিয়ে আলোচনা আর হাসি তামাশা। একসময় আমরা চারজন রুমে ফিরে এলাম। সেখানে আগে থেকেই মজমা বসাতে আমাদের প্রতিক্ষায় মিরাজ, মঙ্গলদা আর সাদী ভাই। আড্ডাবাজি বড্ড জমে উঠেছে। হঠাত দরজা ধাক্কার বেরসিক শব্দ। সাদী ভাই দরজা খুলে দিলে দেখি মুকুল দাঁড়িয়ে। এলান এসেছে সবাই বিচে, আমরা যেতে চাই কি না? সমুদ্র ¯œানের চেয়ে এখন রুমের আড্ডাটা বেশ আনন্দময়। বিধায় আমি, কবির আর টিপু প্রচন্ড অনীহা দেখালাম, বাকীরা যেতে উৎসাহী। পরিস্কার দু’দলে বিভক্ত, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ‘এ’ আর ‘বি’ দলের মতো যুদ্ধাবস্থা। অবশেষে সমঝোতা সিদ্ধান্ত সবাই বীচে যাবো। বাইরে টিপটপ বৃষ্টির কারণে সব সেলফোন ও মানিব্যাগ রুমে রেখে বীচযাত্রা শুরু হলো। সঙ্গে শুধু টিটো খানের ফাজলামী আর বিকট শব্দে অট্টহাসি। উঠলাম লাবনী পয়েন্টে। গিয়ে দেখি ‘বীচ থিয়েটার ক্যাম্প’ জমে উঠেছে। মুন্নাই সবার আগে বীচে এসেছে এবং সেলফোনে কল করে সবাইকে একত্রে করেছে। টিউব, বিশ্রামের জন্য ছাতাওয়ালা চেয়ার মুন্নার নেতৃত্বে রেডি। জুনিয়রদের কেউ কেউ সমুদ্র ¯œানে ব্যস্ত। আর একদল বৃত্তাকারে ফুটবল খেলছে, যা আবার মুন্নার বিশেষ অনুরোধে দর্শনা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের আগমনে একখানা ধুরো ক্যামেরা হাতে বাদল সামনে এসে হাজির। বলে মামা কয়টা ছবি তুলে দিই। এরই মধ্যে মাহমুদা ও তাহমিদ কাছে চলে এসেছে। বাদলের অনুরোধে প্রথমে ওরা তিনজন এবং পরবর্তীতে আমি ও মুন্না কয়েকটি ছবি তুলি। অতঃপর বাদলকে নিয়ে একটু পাশে চলে আসি, কিছু সিঙ্গেল ছবি তোলার জন্য। মুন্না তখন ফুটবল বৃত্তে।
কিছুক্ষণ পর আমরা একই স্থানে ফিরে আসি। পরিচিত কেউ নেই সেখানে। বিচের একজন প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান জানালেন, আমাদের কেউ একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তিনি সদর হাসপাতালে। আমরা দ্রুতই হাসপাতালের দিকে ছুঁটলাম। পথে জুনিয়রদের সাথে দেখা ওরা জানায়-‘খেলারত অবস্থায় মুন্না ভাই আকস্মিক লুটিয়ে পড়ে বালুতে। অবস্থা সুবিধের নয়’। ওদের সমস্ত শরীর ভেজা দেখে বললাম তোরা হোটলে চলে যা। আমরা একটা অটোরিকসা চেপে হাসপাতালে রওনা দিলাম। অটোরিক্সা সবেমাত্র হাসপাতালের গেটে ভিড়েছে। ওমনি মিরাজ কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে-‘মুন্না নেই’। কথাটা শোনা মাত্রই সবাই স্তব্ধ হয়ে পড়ি, এরকম একটা খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ মিরাজকে এক ঝাটকায় সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে যায় মুন্নার কাছে। জরুরী বিভাগে স্ট্রেচারে ঘুমিয়ে মুন্না। রাকু মুন্নার বুকে মাথা রেখে আর্তনাদ করছে-‘মুন্না ভাই এভাবে চলে গেলেন কেন, কে আমাকে শাসন করবে, কে ভালোবাসবে!’। আর মুন্নার পায়ের কাছে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছে মাহমুদা। তাকে সামাল দেবার চেষ্টা করছে পপি। দু’চোখ জলে ভরা। মিনিট দু’য়েক স্থায়ী হতে পারি সেখানে। চোখ মুছি, রাকুকে জোর করে বাইরে নিয়ে আসি। বাইরে তখন কান্নার রোল। কে দেয় কাকে শান্তানা। হাসপাতার চত্বর জুড়ে শুধুই কান্নার শব্দ। সবাই কাঁদছে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এরই মধ্যে খবরটা দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। পরিচিত জনেরা সেলফোনে খবর নেওয়ার চেষ্টা করছেন। অধিকাংশ মানুষই ব্যর্থ হচ্ছেন প্রায় সবার সেলফোন কাছে না থাকার কারণে। এভাবে অনেকক্ষণ।
একোল ওকোল ঘুরে এসময় তাহমিদ আসে আমার কাছে। তাহমিদকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মাহমুদা ছুঁটে আসে পিছনে। তাহমিদের উদ্দেশ্যে বলে-‘বাবা আল্লাহকে বলো আমার বাবাকে ভালো করে দাও’। তাহমিদ নীরব থাকে। মায়ের জোরাজুড়িতে চিৎকার করে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে-‘আল্লা আমার বাবাকে ভালো করে দাও। বাবা তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো’? তাহমিদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে উঠে। চোখের সামনে একই বয়সী আমার কন্যসন্তানের মুখছবি ভেসে উঠে। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা। অবুঝ শিশুর এমন আর্তনাদে ধরে রাখা যায় না। তাহমিদকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে থাকি। কাঁদতে থাকে সবাই। এবার মাহমুদা-‘ঢাকা থেকে ওকে আপনারা ডেকে এনে কেন একলা ফেলে রেখেছেন কেন! আমার জন্য নয়। মায়ের জন্য, তাহমিদের জন্য ওকে আপনারা বাঁচিয়ে তুলুন’। আমরা সকলেই তখন ভাষাহীন, কথা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু সমুদ্রের গর্জনকে ছাড়িয়ে চাঁপা কান্নার শব্দগুলি তীব্র হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় সকল আনুষ্ঠিকতা দ্রুতই সম্পন্ন সম্ভব হলো। এবার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো সহকারী পুলিশ সুপারের সরকারি বাসভবনে। সেখানেই স্থানীয় মসজিদের ঈমামের অধীনে মরহুমের গোসল ও কাফনকার্য সম্পাদন করা হয়। তারপর একটি ফ্রিজড এ্যাম্বুলেন্সে করে মরহুমের দেহাবশেষ ঢাকা হয়ে দর্শনার উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রাক্কালেই উপস্থিত হন কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার। তিনি দর্শনার সন্তান। ডাক নাম ‘শদা’। ছিলেন জরুরী কাজে ঢাকাতে। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান-‘মুন্না বলেছিল এবার কক্সবাজারে আমার বাসায় আসবে। সে তার কথা রেখেছে। আমার বাসায় এসেছে ঠিকই, কিন্তু লাশ হয়ে’। এবার পালা শোকযাত্রার। ৬২২ কিলোমিটারের ১৮ ঘন্টার দীর্ঘপথ। সবাই নিঃশ্চুপ-নিস্তব্ধ। আফসোস একটায় মুন্না চিকিৎসা দেবার সময় দিলো না! মাঝে মাঝে টানা দীর্ঘশ্বাস আর হাতের তালুতে চোখমুছা। বিন¤্র শ্রদ্ধায় মুন্নার জন্য প্রার্থনা। সুখে থেকো, ভালো থেকো।