দামুড়হুদার বড় বলদিয়া থেকে সড়ক নির্মাণ কাজে আলমডাঙ্গার মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে আলমসাধুযোগে যাত্রা ট্রাকের ধাক্কা : ঘটনাস্থলে ৮ জনসহ প্রাণ গেলো ১৩ শ্রমিকের

- আপডেট সময় : ০৫:৪৯:৩৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ মার্চ ২০১৭ ৩৯৮ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক: দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। যখন যেখানে কাজর সন্ধান পায়, সেখানেই কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের দিনমুজুর সকলেই আলমসাধুযোগে রওনা দেয় গন্তব্য স্থলে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বড়বলদিয়া গ্রামের ২২ জন দিনমজুর গতকালও ভোরে গ্রাম থেকে আলমসাধুযোগে রওনা দেয় কাজের উদ্দেশ্যে। আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সীগঞ্জে মাথাভাঙ্গা নদীর ওপারে লক্ষীপুর-মাজহাদে সড়ক নির্মাণ কাজ চলছিলো। সেখানেই যাচ্ছিলো তারা। সময়মতো বাড়ি ফিরে স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতার সাথে বসে দুমুঠো খাওয়ার কথাও ছিলো অনেকের। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে কিছু নিয়ে আসার আদেশও দেয় অনেকের সন্তানেরা। সংসারের সকল কিছু মাথায় নিয়ে একটি আলমসাধুতে বাঁশ বেধে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ২২ জন শ্রমিক সকাল ৬টার দিকে দামুড়হুদার বড়বলদিয়া গ্রাম থেকে রওনা দেয়। তাদের সাথে ছিলেন পার্শ্ববর্তি সুলতানপুর গ্রামের একজন শ্রমিক। দর্শনা বাজার হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে যেতে তারা যখন দামুড়হুদা জয়রামপুরের বটতলা স্কুলের কাছে পৌছায়, তখন ঘড়ির কাটা পৌনে সাতটা। মুহূর্তেই যেন মুছে গেলো সকল চিন্তা-ভাবনা। সেকেন্ডের মধ্যে পাল্টে গেলো সবকিছু।
চুয়াডাঙ্গার দিক থেকে আসা দর্শনামূখী বালিভর্তি একটি ট্রাক (চুয়াডাঙ্গা-ট -১১-০৫৮৮)শ্রমিকদের বহনকারী ওই আলমসাধুতে ধাক্কা দেয়। বালিভর্তি দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় আলমসাধু থেকে গেলে আরও প্রায় ১০ গজ সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় ট্রাকটি। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৮ শ্রমিক। পরে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, চুয়াডাঙ্গা থেকে বালি বোঝাই একটি ট্রাক (চুয়াডাঙ্গা-ট -১১-০৫৮৮) দর্শনার দিকে যাচ্ছিল। এ সময় ২৫ জন মাটি কাটা শ্রমিক একটি আলমসাধু যোগে দামুড়হুদার বড়বলদিয়া গ্রাম থেকে চুয়াডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জে আসছিল। ট্রাক-আলমসাধু জয়রামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পৌছালে মুখোমুখি সংঘর্ষের র্ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাস্থলেই ৮ জন ও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তির পর ২ জন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে ২ জন এবং দামুড়হুদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরো ১জন মারা যায়।
নিহতরা হলেন, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বড়বলদিয়া গ্রামের রহিম ম-লের ছেলে আবদার আলী (৪৫), ঠা-ু ম-লের ছেলে বিল্লাল (৩৬), মৃত ইন্নালের ছেলে আকুব্বার (৪৮), গোলামের ছেলে ইজ্জত আলী (৪২), কিতাব আলীর ছেলে নজির (৩৬), গাজির উদ্দীনের ছেলে শান্ত (৩৮), বাবুল আক্তারের ছেলে হাফিজুল (৩৫), মৃত কানাই ম-লের ছেলে লাল মোহাম্মদ (৪৫), রমজান আলীর ছেলে রফিকুল আলম (৪০), ভোলাই ম-লের ছেলে বিল্লাল (৩৯), খোদা বক্সের ছেলে জজ মিয়া (২৮), লিয়াকত আলীর ছেলে শাহীন (২৫) এবং পার্শ্ববর্তি ফিরোজ আলীর ছেলে শফিকুল (৩৭)।
দুর্ঘটনায় আহতরা হলেন, মৃত মিনহাজ উদ্দীনের ছেলে আলী হোসেন (৫৫), নাসির উদ্দীনের ছেলে কালু (১৯), আনোয়ার হোসেনের ছেলে মজিবর রহমান (২৫), মৃত নিয়ামত আলীর ছেলে জিয়াউর রহমান (৩৫), নাসির উদ্দীনের ছেলে শফিউদ্দীন (২৪), আব্দুল জলিলের ছেলে আতিকুল (৩০), আশান বিশ্বাসের ছেলে শফিকুল (২৭), মৃত আজান আলীর ছেলে আলতাব হোসেন (৩০), কিতাব আলীর ছেলে সোহরাব উদ্দীন (৪৮) এবং মৃত আশু ভারামির ছেলে নূর ইসলাম (৩৮)। আহতদের মধ্যে কালু, মজিবার, জিয়াউর, শফিউদ্দীন, আতিকুল ও শফিকুলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।
ঘটনার সময় উপস্থিত স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী বারিকুল জানান, সকালে দোকান খুলে বসে থাকার সময় দেখি একটি ট্রাক দামুড়হুদা থেকে জয়রামপুরের দিকে আসছিলো। ট্রাকটি রাস্তার ডানদিক ও বামদিক করছিল। এ সময় শ্রমিক ভর্তি আলমসাধুটি দামুড়হুদার দিকে যাচ্ছিলো। হঠাত করে ট্রাকটি আলমসাধুর উপর তুলে দেয়। আর এতে আলমসাধুটি চূর্ণ বিচুন্ন হয়ে যায়। কয়েকজনের মরদেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পর চালক ও হেলপার ট্রাকটি ফেলে পালিয়ে গেছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ট্রাকটি জব্দ করেছে।
সদর হাসপাতালে ভর্তি আহত নুর ইসলাম জানান, ভটভটিতে করে তাঁরা ২২ জন আলমডাঙ্গার মুন্সীগঞ্জের মাথাভাঙ্গা নদীর ওপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে রাস্তার নির্মাণকাজে যাচ্ছিলেন। সে সময় তাঁরা দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।
চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ইনচার্জ আবদুস সালাম জানান, সংঘর্ষের পর তাঁরা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করেন।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা সার্কেলের সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার কলিমুল্লাহ জানান, ঘটনাস্থলে ৮ জন নিহত হয়েছে। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে এবং নেয়ার পর আরও ৫ জন নিহত হয়। তবে কি কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা, তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক (ডিসি) সায়মা ইউনুস সদর হাসপাতালে গিয়ে হতাহতদের স্বজনদের সান্ত¡না দেন। লাশ দাফন ও আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।এসময় সিভিল সার্জন ডা. রওশন আরা, পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) আনজুমান আরা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুর রাজ্জাক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দেব প্রসাদ পাল, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৃনাল কান্তি দে, চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু, মদনা-পারকৃষ্ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য শরিফুজ্জামান শরিফ, জেলা জামায়েতে ইসলামের আমির আনোয়ারুল হক মালিক, সেক্রেটারী রুহুল আমিন, হাউলী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী শাহ মিন্টুসহ সকল প্রশাসনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।
পরে নিহতদের ময়নাতদন্ত ছাড়ায় লাশ নিজ গ্রামে নেয়া হয়। বাদ আছর বড় বলদিয়া গ্রামের স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়ে গ্রামের কবরস্থানে পাশাপাশি ১২ জনের দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাজা ও দাফনকাজে দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল হাসান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজাদুল ইসলাম আজাদ, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলমসহ এলাকা ও আশপাশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা পড়ান মুফতি আকতারুজ্জামান। চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম দুর্ঘটনায় হতাহত হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহযোগিতার জন্য এ সময় সবার প্রতি আহ্বান জানান। জানাজার আগে ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খাজা আবুল হাসনাত ঘোষণা দেন, হতাহত প্রতিটি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপকোষাধ্যক্ষ মাহমুদ হাসান খান ওরফে বাবু খানের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের হাতে শিগগিরই টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।