ইপেপার । আজ রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক ও মানুষের বিভ্রান্তি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৪৩:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪
  • / ৯০ বার পড়া হয়েছে

সহজ সরল মানুষ সানোয়ার মামা। শহরে যাওয়ার তেমন সুযোগ হয়ে ওঠে না। হঠাৎ এক দিন শহরের বড় বাজারে এসে জনৈক ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে ৫ টাকার ছোলা ভাজা দিতে বললেন। ঝালমুড়ি বিক্রেতা জানালো, তার কাছে ছোলা ভাজা নেই। সানোয়ার মামা হাত দিয়ে দেখাতেই বিক্রেতা বলল, ‘ওটা ছোলা ভাজা না, ঘুগনি’! পরক্ষণেই সানোয়ার মামা বলে উঠলেন, ‘ওরে সালার ছোলা ভাজা; তুমি ব্রিজ পার হয়ে ঘুগনি হয়েছো’।
সম্প্রতি সাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে যে আতঙ্ক বিরাজের কথা শোনা যাচ্ছে, তাতেই সানোয়ার মামার কাহিনীটি মনে পড়ে গেল! সাপ ভীতি মানুষের সারাজীবনই ছিল। কিন্তু বর্তমানে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সেই আতঙ্কে আরও ঘি ঢেলেছে। চন্দ্রবোড়া সাপটি বাংলাদেশের প্রকৃতিতে বহুকাল ধরেই ছিল এবং এখনও আছে। বিশেষ করে পদ্মার অববাহিকায় এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে।
বছরের পর বছর মানুষের সাথে সহাবস্থান করলেও জনজীবনের মাঝে তেমন কোনো আতঙ্কের কথা শোনা যায়নি। তাছাড়া মাঝখানে বহু বছর এই সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর তেমন কোনো খবর না পাওয়ায় অনেকে ধরেই নিয়েছিল বাংলার প্রকৃতি থেকে এটি হয়ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ২০১৩ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে একজনের মৃত্যুর পর সাপটি নতুন করে আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে পদ্মার অববাহিকায় বিভিন্ন জেলা থেকে এই সাপের বিস্তৃতির খবর পাওয়া যায়।
এরপর সাপটি আলোচনায় থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে নানা মাধ্যমে গুজব ও ভুল তথ্য প্রচারের ফলে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যে সাপকে তারা এতদিন চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া, চক্রবোড়া, শেয়ারচাঁন্দা নামে জেনে এসেছে, সে সাপকেই এখন ‘ভয়ঙ্কর রাসেলস ভাইপার’ নামে প্রচারের ফলে মানুষের মাঝে আরও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকটা সানোয়ার মামার (ছোলা ভাজা ঘুগনি হওয়া) কাহিনীর মতো।
যার কারণে মানুষ না চিনে, না জেনে অন্যান্য বিষধর, মৃদু বিষধর থেকে শুরু করে উপকারী নির্বিষ সাপগুলোকেও নির্বিচারে পিটিয়ে মারছে। অথচ এদের মধ্যে এমন সাপও (গোখরো, শাঁখামুটি) আছে যারা চন্দ্রবোড়া খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতো। সম্প্রতি চন্দ্রবোড়ার বিস্তৃতি বাড়লেও নানা ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
এই সাপ সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক, মানুষকে তেড়ে কামড়াতে আসে, এর কোনো প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নেই ইত্যাদি বিষয়গুলো সঠিক নয়। আক্রমণের দিক থেকে এই সাপ গোখরো সাপেরও নিচে অবস্থান। তেড়ে কামড়াতে আসে ধারণাটিও ভুল। বরং চন্দ্রবোড়া ইঁদুর ধরার জন্য এক স্থানে ঘাপটি মেরে থাকে এবং খুব ধীরে চলাফেরা করে। সাপ সাধারণত মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সরে পড়ে। মাঠে কৃষিকাজ ও চলাফেরার সময় অসাবধানতাবশত এর শরীরের ওপর পা উঠে গেলে অথবা আঘাত পেলে আত্মরক্ষার্থে সাপ কামড় দেয়।
অনেকে চন্দ্রবোড়াকে অজগর বলে ধরতে যেয়েও কামড় খেয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই সাপের অ্যান্টিভেনম আছে। তবে কামড়ের পরপরই যতদ্রুত সম্ভব ভিকটিমকে হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখবেন, সাপে কামড়ের পর প্রতিটি সেকেন্ড আপনার জীবনের জন্য মূল্যবান। তাই সময় নষ্ট না করে কারো কথায় কান না দিয়ে সরাসরি সরকারি হাসপাতালে চলে যাবেন। রোগীকে সাহস দিবেন যেন হার্ট অ্যাটাক না করে। কামড়ের স্থানটি একেবারে নিশ্চল (নড়াচড়া না করা) করে ফেলুন। কোনো ক্রমেই কামড়ের স্থানে শক্ত করে বাঁধবেন না। আর চন্দ্রবোড়ার কামড়ের ক্ষেত্রে তো কোনো বাঁধায় যাবে না। চিকিৎসককে সব খুলে বলুন। ভুলক্রমেও কবিরাজ বা ওঝাঁর কাছে যাবেন না।
একটু সতর্কতার সাথে চলাফেরা করলে সাপে কামড়ানোর ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমানো যায়। কৃষিজমিতে সার বা কীটনাশক ছিটানোর সময় গামবুট ব্যবহার করা যায়। জমির আইল ধরে হাঁটার সময় লাঠি দিয়ে শব্দ করে চললে সাপ সরে যায়। প্রকৃতি থেকে ঈগল, বাজ, পেঁচা, বেজি, গুঁইসাপ, শিয়াল, বন বিড়াল, খাটাশ, মেছোবিড়াল নির্বিচারে মারার ফলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি ঘটছে। অথচ এসব পাখি ও বন্যপ্রাণী সাপ, সাপের ডিম ও বাঁচ্চা খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতো।
পরিশেষে আমরা সবাই সতর্ক থাকব। কাউকে সাপে কামড়ালে কবিরাজ, ওঝাঁর কাছে না যেয়ে সরকারি হাসপাতালে যাবো। আর জীবন ঝুঁকি অথবা একান্ত বাধ্য না হলে অযথা সাপ মারা থেকে বিরত থাকব।

  • মো. বখতিয়ার হামিদ
    শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী
    প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (পরিবেশবাদী সংগঠন, পানকৌড়ি)
ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক ও মানুষের বিভ্রান্তি

আপলোড টাইম : ০৯:৪৩:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪

সহজ সরল মানুষ সানোয়ার মামা। শহরে যাওয়ার তেমন সুযোগ হয়ে ওঠে না। হঠাৎ এক দিন শহরের বড় বাজারে এসে জনৈক ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে ৫ টাকার ছোলা ভাজা দিতে বললেন। ঝালমুড়ি বিক্রেতা জানালো, তার কাছে ছোলা ভাজা নেই। সানোয়ার মামা হাত দিয়ে দেখাতেই বিক্রেতা বলল, ‘ওটা ছোলা ভাজা না, ঘুগনি’! পরক্ষণেই সানোয়ার মামা বলে উঠলেন, ‘ওরে সালার ছোলা ভাজা; তুমি ব্রিজ পার হয়ে ঘুগনি হয়েছো’।
সম্প্রতি সাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে যে আতঙ্ক বিরাজের কথা শোনা যাচ্ছে, তাতেই সানোয়ার মামার কাহিনীটি মনে পড়ে গেল! সাপ ভীতি মানুষের সারাজীবনই ছিল। কিন্তু বর্তমানে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সেই আতঙ্কে আরও ঘি ঢেলেছে। চন্দ্রবোড়া সাপটি বাংলাদেশের প্রকৃতিতে বহুকাল ধরেই ছিল এবং এখনও আছে। বিশেষ করে পদ্মার অববাহিকায় এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে।
বছরের পর বছর মানুষের সাথে সহাবস্থান করলেও জনজীবনের মাঝে তেমন কোনো আতঙ্কের কথা শোনা যায়নি। তাছাড়া মাঝখানে বহু বছর এই সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর তেমন কোনো খবর না পাওয়ায় অনেকে ধরেই নিয়েছিল বাংলার প্রকৃতি থেকে এটি হয়ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ২০১৩ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে একজনের মৃত্যুর পর সাপটি নতুন করে আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে পদ্মার অববাহিকায় বিভিন্ন জেলা থেকে এই সাপের বিস্তৃতির খবর পাওয়া যায়।
এরপর সাপটি আলোচনায় থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে নানা মাধ্যমে গুজব ও ভুল তথ্য প্রচারের ফলে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যে সাপকে তারা এতদিন চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া, চক্রবোড়া, শেয়ারচাঁন্দা নামে জেনে এসেছে, সে সাপকেই এখন ‘ভয়ঙ্কর রাসেলস ভাইপার’ নামে প্রচারের ফলে মানুষের মাঝে আরও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকটা সানোয়ার মামার (ছোলা ভাজা ঘুগনি হওয়া) কাহিনীর মতো।
যার কারণে মানুষ না চিনে, না জেনে অন্যান্য বিষধর, মৃদু বিষধর থেকে শুরু করে উপকারী নির্বিষ সাপগুলোকেও নির্বিচারে পিটিয়ে মারছে। অথচ এদের মধ্যে এমন সাপও (গোখরো, শাঁখামুটি) আছে যারা চন্দ্রবোড়া খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতো। সম্প্রতি চন্দ্রবোড়ার বিস্তৃতি বাড়লেও নানা ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
এই সাপ সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক, মানুষকে তেড়ে কামড়াতে আসে, এর কোনো প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নেই ইত্যাদি বিষয়গুলো সঠিক নয়। আক্রমণের দিক থেকে এই সাপ গোখরো সাপেরও নিচে অবস্থান। তেড়ে কামড়াতে আসে ধারণাটিও ভুল। বরং চন্দ্রবোড়া ইঁদুর ধরার জন্য এক স্থানে ঘাপটি মেরে থাকে এবং খুব ধীরে চলাফেরা করে। সাপ সাধারণত মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সরে পড়ে। মাঠে কৃষিকাজ ও চলাফেরার সময় অসাবধানতাবশত এর শরীরের ওপর পা উঠে গেলে অথবা আঘাত পেলে আত্মরক্ষার্থে সাপ কামড় দেয়।
অনেকে চন্দ্রবোড়াকে অজগর বলে ধরতে যেয়েও কামড় খেয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই সাপের অ্যান্টিভেনম আছে। তবে কামড়ের পরপরই যতদ্রুত সম্ভব ভিকটিমকে হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখবেন, সাপে কামড়ের পর প্রতিটি সেকেন্ড আপনার জীবনের জন্য মূল্যবান। তাই সময় নষ্ট না করে কারো কথায় কান না দিয়ে সরাসরি সরকারি হাসপাতালে চলে যাবেন। রোগীকে সাহস দিবেন যেন হার্ট অ্যাটাক না করে। কামড়ের স্থানটি একেবারে নিশ্চল (নড়াচড়া না করা) করে ফেলুন। কোনো ক্রমেই কামড়ের স্থানে শক্ত করে বাঁধবেন না। আর চন্দ্রবোড়ার কামড়ের ক্ষেত্রে তো কোনো বাঁধায় যাবে না। চিকিৎসককে সব খুলে বলুন। ভুলক্রমেও কবিরাজ বা ওঝাঁর কাছে যাবেন না।
একটু সতর্কতার সাথে চলাফেরা করলে সাপে কামড়ানোর ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমানো যায়। কৃষিজমিতে সার বা কীটনাশক ছিটানোর সময় গামবুট ব্যবহার করা যায়। জমির আইল ধরে হাঁটার সময় লাঠি দিয়ে শব্দ করে চললে সাপ সরে যায়। প্রকৃতি থেকে ঈগল, বাজ, পেঁচা, বেজি, গুঁইসাপ, শিয়াল, বন বিড়াল, খাটাশ, মেছোবিড়াল নির্বিচারে মারার ফলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি ঘটছে। অথচ এসব পাখি ও বন্যপ্রাণী সাপ, সাপের ডিম ও বাঁচ্চা খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতো।
পরিশেষে আমরা সবাই সতর্ক থাকব। কাউকে সাপে কামড়ালে কবিরাজ, ওঝাঁর কাছে না যেয়ে সরকারি হাসপাতালে যাবো। আর জীবন ঝুঁকি অথবা একান্ত বাধ্য না হলে অযথা সাপ মারা থেকে বিরত থাকব।

  • মো. বখতিয়ার হামিদ
    শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী
    প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (পরিবেশবাদী সংগঠন, পানকৌড়ি)