ইপেপার । আজ শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভক্ত দেশ সরব বিএনপি ও ইসলামপন্থী দলগুলো : নীরব আ’লীগ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:৫৩:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ২০১৬
  • / ৫৭৪ বার পড়া হয়েছে

image_1739_267070

সমীকরণ ডেস্ক: রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশ। মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্বেষের শিকার এ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানে ইসলামপন্থী দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হলেও নীরব ভূমিকা পালন করছে শাসকদল। আর রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং তাদের ফেরত পাঠাতে দল-মত নির্বিশেষ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন আন্দোলন কমিটি করেছে স্থানীয় জনগণ। যদিও ভেসে আসা এসব শরণার্থীদের জন্য সীমিত আকারের সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান না দিলেও ইস্যুটিতে স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানবিকতার দিক বিবেচনা করে কিছুদিনের জন্য সীমান্ত শিথিলতা দেখানো স্থায়ী সমাধানের পথ হতে পারে না। এ জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা উচিত। এটা মিয়ানমার সরকারের বিষয়। তাদের মাধ্যমেই সমাধানে যেতে হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়টি মিয়ানমারের ইচ্ছাধীন হতে পারে না। আবার তাদের সাময়িক আশ্রয়দানও কোনো সমাধান নয়। অবৈধ এই অভিবাসন সংকটের স্থায়ী সমাধান দরকার। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই ফল পাওয়া যেতে পারে।
তথ্যমতে, গত ৯ অক্টোবর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকিতে হামলার পর রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযানের সময় ব্যাপকহারে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর ধ্বংসের অভিযোগ ওঠে। যদিও অভিযানের সময় কোনো ধরনের সহিংস আচরণের অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার সরকার। তাদের ভাষ্য, দেশের উত্তরের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে অনেকেই এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে। যদিও কয়েক শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
মূলত ইতিহাসের জঘন্যতম এই মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে তাদের আশ্রয়দান নিয়ে শুরু থেকেই সরব দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হেফাজত। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়ার দাবিতে আল্টিমেটাম পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছে দলটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে কক্সবাজারে গণসমাবেশের হুশিয়ারি দিয়েছে তারা। সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম গেটে আয়োজিত সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর শাখার সেক্রেটারি আবুল হাসানাত আমিনী বলেছেন, মুসলমানদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য প্রাচীরঘেরা শরণার্থী শিবির করতে হবে। যদি টাকা না থাকে তবে এর খরচের দায়িত্ব হেফাজত বহন করবে। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্ব জাতিসংঘ-ওআইসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা। তিনিও রোহিঙ্গা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি জানান। আর একই দিন চট্টগ্রামে আয়োজিত সমাবেশে সংগঠনের মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, বার্মার রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই গণহত্যার কারণে সারা বিশ্বের মুসলমান ব্যথিত। এই হত্যা যদি বন্ধ না হয় তাহলে বাধ্য হয়ে কোটি কোটি জনগণকে নিয়ে লংমার্চ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
হেফাজতের পাশাপাশি বস্নগ ও ফেসবুকেও চলছে দেদার প্রচারণা। ‘শরণার্থীরা মুসলমান, মুসলমান মুসলমানের ভাই’- এমন বক্তব্যের সঙ্গে নির্যাতনের চিত্র জুড়ে দিয়ে অনেকেই পালন করছেন সরব ভূমিকা। দাবি জানিয়েছেন সীমান্ত শিথিলের। নিপীড়নে অতিষ্ঠ মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার বন্ধ রাখার প্রতিবাদ করে সাংবাদিক এসএম মামুন হোসাইন লেখেন, ‘বার্মিজ ইয়াবার জন্য সীমান্ত খোলা অথচ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত বন্ধ। হাই গ্রেইড ইয়াবার চাইতে মজলুম, অসহায় মানবতা বেশি ক্ষতিকর….।’ ছাত্রলীগ কর্মী সাখাওয়াৎ হোসেন শাহীন লেখেন, ‘এরা কোন ধর্মের লোক জানি না! কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো মুসলিম দেশ কেন কথা বলে না? কোথায় হেফাজতে ইসলাম? কোথায় খেলাফত মজলিস আর কোথায় চরমোনাই পীর সাহেবের মুরিদরা? প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন, ‘আমরা বলি মুসলিম মেরো না, হিন্দু মেরো না, খ্রিস্টান মেরো না কিংবা বুদ্ধিস্ট মেরো নাথ কেউ বলি না যে ‘মানুষ’ মেরো না। মনুষ্যত্বের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় যেখানে বড়; বিরোধ, বৈষম্য, হানাহানি সেখানে অপরিহার্য। মানবিকতার জয় হোক’।
সরব বিএনপি, নীরব আওয়ামী লীগ: এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত কয়েকদিন ধরেই সরব রয়েছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয়দানের স্পষ্ট আহ্বানও জানিয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মিয়ানমারে চলমান নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে যত দূর সম্ভব আশ্রয় দেয়া উচিত। খালেদা জিয়া বলেন, প্রতিটি মানবতাবাদী রাষ্ট্রের সরকার, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব, জাতিসংঘ, ওআইসিসহ প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান- কেবল কথামালা নয়, রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বলিষ্ঠ এমন পদ?ক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসুন, যাতে মিয়ানমার সরকার গণহত্যার কালো হাত গুটিয়ে নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীদের শাস্তিবিধানে বাধ্য হয়। শরণার্থীদের আশ্রয় ও সাহায্য দেয়ার পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে দেশে ফিরতে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের কথাও জানান তিনি। আর দলটির স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ। তিনি আহ্বান জানান, নৌকায় ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিন অথবা সাময়িকভাবে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে পরবর্তীতে কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করুন। বিএনপি প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ সরকার নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে, অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
অন্যদিকে নীরব ভূমিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এমনকি ইস্যুটি এখনো পর্যন্ত বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়নি শাসক দলটি। বিষয়টি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে যা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ সময় মিয়ানমার ইস্যুকে বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ইস্যু না বানানোর জন্য বিএনপি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এর আগে রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পুশ-ব্যাকের বিষয়টি যথেষ্ট কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের বুঝতে দিচ্ছে যে- তাদের বাংলাদেশে আসার ‘অধিকার বা স্বীকৃতির’ পরিবর্তন হচ্ছে।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চুপচাপ থাকলেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান ও তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সীমিত আকারের ব্যবস্থা রেখেছে সরকার। ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, ৯ নভেম্বর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত অনিবন্ধিত একাধিক ক্যাম্পে মোট ৭ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের অনিবন্ধিত লেদা ক্যাম্পে রাখা হয়েছে মোট ১ হাজার ৩৮৮ জন শরণার্থীকে। এই ক্যাম্পে আগে থেকেই ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছিল। অন্যদিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ঠাঁই দেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৬৫০ জন রোহিঙ্গাকে। যেখানে আগে থেকেই ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ছিল। বিজিবি বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খোলা এই ক্যাম্পে প্রতিদিনই নতুন করে কেউ না কেউ যুক্ত হচ্ছে। যদিও তারা নিবন্ধিত ক্যাম্পে ঢুকতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে ক্যাম্পের আশপাশের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় ও চিকিৎসা দুটোই দেয়া হচ্ছে। তবে তা একেবারেই মানবিক কারণে। তিনি বলেন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে। এর আগে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান বের করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছে। আর বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আলোচনা চালিয়ে আসছে। তবে সবকিছুর আগে মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

error: Content is protected !!

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভক্ত দেশ সরব বিএনপি ও ইসলামপন্থী দলগুলো : নীরব আ’লীগ

আপলোড টাইম : ১২:৫৩:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

image_1739_267070

সমীকরণ ডেস্ক: রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশ। মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্বেষের শিকার এ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানে ইসলামপন্থী দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হলেও নীরব ভূমিকা পালন করছে শাসকদল। আর রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং তাদের ফেরত পাঠাতে দল-মত নির্বিশেষ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন আন্দোলন কমিটি করেছে স্থানীয় জনগণ। যদিও ভেসে আসা এসব শরণার্থীদের জন্য সীমিত আকারের সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান না দিলেও ইস্যুটিতে স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানবিকতার দিক বিবেচনা করে কিছুদিনের জন্য সীমান্ত শিথিলতা দেখানো স্থায়ী সমাধানের পথ হতে পারে না। এ জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা উচিত। এটা মিয়ানমার সরকারের বিষয়। তাদের মাধ্যমেই সমাধানে যেতে হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়টি মিয়ানমারের ইচ্ছাধীন হতে পারে না। আবার তাদের সাময়িক আশ্রয়দানও কোনো সমাধান নয়। অবৈধ এই অভিবাসন সংকটের স্থায়ী সমাধান দরকার। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই ফল পাওয়া যেতে পারে।
তথ্যমতে, গত ৯ অক্টোবর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকিতে হামলার পর রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযানের সময় ব্যাপকহারে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর ধ্বংসের অভিযোগ ওঠে। যদিও অভিযানের সময় কোনো ধরনের সহিংস আচরণের অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার সরকার। তাদের ভাষ্য, দেশের উত্তরের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে অনেকেই এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে। যদিও কয়েক শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
মূলত ইতিহাসের জঘন্যতম এই মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে তাদের আশ্রয়দান নিয়ে শুরু থেকেই সরব দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হেফাজত। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়ার দাবিতে আল্টিমেটাম পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছে দলটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে কক্সবাজারে গণসমাবেশের হুশিয়ারি দিয়েছে তারা। সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম গেটে আয়োজিত সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর শাখার সেক্রেটারি আবুল হাসানাত আমিনী বলেছেন, মুসলমানদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য প্রাচীরঘেরা শরণার্থী শিবির করতে হবে। যদি টাকা না থাকে তবে এর খরচের দায়িত্ব হেফাজত বহন করবে। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্ব জাতিসংঘ-ওআইসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা। তিনিও রোহিঙ্গা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি জানান। আর একই দিন চট্টগ্রামে আয়োজিত সমাবেশে সংগঠনের মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, বার্মার রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই গণহত্যার কারণে সারা বিশ্বের মুসলমান ব্যথিত। এই হত্যা যদি বন্ধ না হয় তাহলে বাধ্য হয়ে কোটি কোটি জনগণকে নিয়ে লংমার্চ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
হেফাজতের পাশাপাশি বস্নগ ও ফেসবুকেও চলছে দেদার প্রচারণা। ‘শরণার্থীরা মুসলমান, মুসলমান মুসলমানের ভাই’- এমন বক্তব্যের সঙ্গে নির্যাতনের চিত্র জুড়ে দিয়ে অনেকেই পালন করছেন সরব ভূমিকা। দাবি জানিয়েছেন সীমান্ত শিথিলের। নিপীড়নে অতিষ্ঠ মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার বন্ধ রাখার প্রতিবাদ করে সাংবাদিক এসএম মামুন হোসাইন লেখেন, ‘বার্মিজ ইয়াবার জন্য সীমান্ত খোলা অথচ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত বন্ধ। হাই গ্রেইড ইয়াবার চাইতে মজলুম, অসহায় মানবতা বেশি ক্ষতিকর….।’ ছাত্রলীগ কর্মী সাখাওয়াৎ হোসেন শাহীন লেখেন, ‘এরা কোন ধর্মের লোক জানি না! কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো মুসলিম দেশ কেন কথা বলে না? কোথায় হেফাজতে ইসলাম? কোথায় খেলাফত মজলিস আর কোথায় চরমোনাই পীর সাহেবের মুরিদরা? প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন, ‘আমরা বলি মুসলিম মেরো না, হিন্দু মেরো না, খ্রিস্টান মেরো না কিংবা বুদ্ধিস্ট মেরো নাথ কেউ বলি না যে ‘মানুষ’ মেরো না। মনুষ্যত্বের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় যেখানে বড়; বিরোধ, বৈষম্য, হানাহানি সেখানে অপরিহার্য। মানবিকতার জয় হোক’।
সরব বিএনপি, নীরব আওয়ামী লীগ: এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত কয়েকদিন ধরেই সরব রয়েছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয়দানের স্পষ্ট আহ্বানও জানিয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মিয়ানমারে চলমান নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে যত দূর সম্ভব আশ্রয় দেয়া উচিত। খালেদা জিয়া বলেন, প্রতিটি মানবতাবাদী রাষ্ট্রের সরকার, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব, জাতিসংঘ, ওআইসিসহ প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান- কেবল কথামালা নয়, রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বলিষ্ঠ এমন পদ?ক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসুন, যাতে মিয়ানমার সরকার গণহত্যার কালো হাত গুটিয়ে নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীদের শাস্তিবিধানে বাধ্য হয়। শরণার্থীদের আশ্রয় ও সাহায্য দেয়ার পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে দেশে ফিরতে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের কথাও জানান তিনি। আর দলটির স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ। তিনি আহ্বান জানান, নৌকায় ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিন অথবা সাময়িকভাবে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে পরবর্তীতে কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করুন। বিএনপি প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ সরকার নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে, অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
অন্যদিকে নীরব ভূমিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এমনকি ইস্যুটি এখনো পর্যন্ত বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়নি শাসক দলটি। বিষয়টি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে যা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ সময় মিয়ানমার ইস্যুকে বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ইস্যু না বানানোর জন্য বিএনপি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এর আগে রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পুশ-ব্যাকের বিষয়টি যথেষ্ট কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের বুঝতে দিচ্ছে যে- তাদের বাংলাদেশে আসার ‘অধিকার বা স্বীকৃতির’ পরিবর্তন হচ্ছে।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চুপচাপ থাকলেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান ও তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সীমিত আকারের ব্যবস্থা রেখেছে সরকার। ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, ৯ নভেম্বর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত অনিবন্ধিত একাধিক ক্যাম্পে মোট ৭ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের অনিবন্ধিত লেদা ক্যাম্পে রাখা হয়েছে মোট ১ হাজার ৩৮৮ জন শরণার্থীকে। এই ক্যাম্পে আগে থেকেই ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছিল। অন্যদিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ঠাঁই দেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৬৫০ জন রোহিঙ্গাকে। যেখানে আগে থেকেই ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ছিল। বিজিবি বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খোলা এই ক্যাম্পে প্রতিদিনই নতুন করে কেউ না কেউ যুক্ত হচ্ছে। যদিও তারা নিবন্ধিত ক্যাম্পে ঢুকতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে ক্যাম্পের আশপাশের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় ও চিকিৎসা দুটোই দেয়া হচ্ছে। তবে তা একেবারেই মানবিক কারণে। তিনি বলেন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে। এর আগে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান বের করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছে। আর বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আলোচনা চালিয়ে আসছে। তবে সবকিছুর আগে মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে।