ইসরাইলি আগ্রাসনের কড়া জবাব দিচ্ছে ইরান। তেহরানের এই পালটা জবাবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। দেশটির শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম ভেদ করে ইরান যে এমন প্রত্যাঘাত করতে পারে তা কল্পনায় ছিল না ইসরাইলের। গতকালও ইরান তেল আবিবে হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলও পালটা হামলা চালিয়েছে। নেতানিয়াহু সরকার এখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেতে উঠেপড়ে লেগেছে। ইরানে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই সপ্তাহ বিলম্ব ইসরাইলে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। গতকাল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ইসরাইলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রকাশ্যে ইরানের হামলায় মার্কিন সম্পৃক্ততার জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
‘বিস্মিত ইসরাইল’:
ইরানের দুটি ড্রোন ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলে ও দক্ষিণাঞ্চলে পৃথক হামলা চালিয়েছে। যা অনেকটা অবাক করেছে ইসরাইলকে। হামলার বিষয়টি স্বীকার করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এটি একটি বিরল ঘটনা, যেখানে ইরানের একমুখী আক্রমণাত্মক ড্রোন সফলভাবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, শনিবার ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে জর্ডান সীমান্তসংলগ্ন বেইত শেইন শহরে একটি ড্রোন আঘাত হানে। এতে একটি দুই তলা বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর তথ্যমতে, ইরানের দ্বিতীয় ড্রোনটি দক্ষিণাঞ্চলের একটি খোলা এলাকায় আঘাত হানে। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। গত ৯ দিনে ইরানের বহু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল উপাদান তিনটি। প্রথমত, রাডার শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে। কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার সিদ্ধান্ত নেয় ধেয়ে আসা কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা হবে। এরপর লঞ্চার প্রতিরোধ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। শত্রুপক্ষের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সাধারণত প্রতিরোধকারী দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শনিবারের (গতকাল) হামলায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৮০-৯০ শতাংশ কার্যকর ছিল। অর্থাৎ বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে ইরানের কয়েকটি সম্ভাব্য কৌশল রয়েছে। ইরান একযোগে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যস্ত করে ফেলে, যাতে প্রকৃত হামলাগুলো প্রতিরোধ করা না যায়।
ইরানের সামর্থ্যকে খাটো করে দেখেছিল ইসরাইল:
ইসরাইল ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে একাধিক সামরিক কমান্ডারকে হত্যার পরও দেশটি যেভাবে একের পর এক পালটা হামলা চালিয়ে রাষ্ট্রটির বিভিন্ন শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা হামলার রেশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনে করা মন্তব্যে এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফ্ট-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পার্সি এ প্রসঙ্গে বলেন, ইসরাইলিরা ইরানের ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টিকে খাটো করে দেখেছিল। অত্যন্ত ‘সফলভাবে’ ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যার পর ইরান এত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াবে তা তারা ভাবতে পারেনি।
৭৫ বছরের ক্ষতির রেকর্ড ভাঙল:
এক সপ্তাহের বেশি সময়ে ইরান যে পরিমাণ ক্ষতি ইসরাইলকে করেছে, তা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর দেখেনি দেশটির নাগরিকরা। গত কয়েক দশক ধরে হিজবুল্লাহ, হামাস, পিআইজে বা হুথি মিলিশিয়াদের মাধ্যমে সংঘটিত ক্ষতির তুলনায়ও অনেক বেশি ভয়াবহ ও ‘অকল্পনীয়’। এমন মন্তব্য উঠে এসেছে অনলাইন সংবাদমাধ্যম নিউজ ইসরাইল-এর বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল তার নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি বরাবরই গোপন রাখে, যা একটি ছোট দেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। তবে এই মুহূর্তে ইরানি হামলার বাস্তবতা অস্বীকার করা কঠিন। ইরানের হামলায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ইসরাইলের ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। এতে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে এবং দশকের পর দশক ধরে চলা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, অন্তত ৪৫টি গবেষণাগার পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে হূদিপন্ডের টিস্যু ও জেনেটিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ নমুনাও রয়েছে। দ্য জেরুজালেম পোস্ট একে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ বলে অভিহিত করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং একটি তেল শোধনাগার। ইসরাইলি সেনাপ্রধান জানিয়ে দিয়েছেন, তারা ‘দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তেল আবিবে আগুন:
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, তেল আবিবের দক্ষিণে আগুন লেগেছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, আগুন লাগার কারণ হলো ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র আটকে দেওয়ার পর এর ছিন্নভিন্ন অংশ নিচে নেমে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইসলামিক রিপাবলিক টেলিভিশন জানিয়েছে যে ইরানের ১৮তম বারের মতো ইসরাইলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী আরো হামলা চালানোর খবর নিশ্চিত করার পরই দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র আভিচায় আদরাই সামাজিকমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে অভিযান চালাচ্ছে। দেশটি তেহরানের ইসফাহান পরমাণু কেন্দ্রেও হামলা চালিয়েছে।
‘বুশেহরে হামলা পরিণাম হতে পারে ভয়ঙ্কর’:
ইরানের বুশেহর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইসরাইল হামলা চালালে তার পরিণাম হতে পারে ভয়ানক। এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত নজরদার সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। বুশেহরে হামলা হলে সম্ভাব্য ‘পরমাণু বিপর্যয়’ হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংস্থাটি। তবে সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল গ্রসি আশ্বস্ত করেছেন যে, ইরানের এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এখনো কোনো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়নি। শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে গ্রসি বলেন, ‘ঐ অঞ্চলে যে দেশগুলো রয়েছে, তারা গত কয়েক ঘণ্টায় আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমি একটা বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, বুশেহর পরমাণু কেন্দ্রে যদি আঘাত হানা হয়, তবে তা হলে উচ্চ পর্যায়ের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হবে’।
ম্যাত্রঁদ্ধ ও পেজেশকিয়ানের মধ্যে ফোনালাপ:
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রঁদ্ধর মধ্যে একটি ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফোনালাপের সময় ম্যাত্রঁদ্ধ বলেন, তিনি এবং মাসুদ পেজেশকিয়ান ইউরোপীয় শক্তি এবং ইরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনার বিষয়টি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একমত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে ম্যাত্রঁদ্ধ বলেন, ‘আমি দাবি করেছি, ইরান কখনই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না এবং এর বিষয়ে তাদেরকেই নিয়শ্চয়তা দিতে হবে।’ ম্যাত্রঁদ্ধ বলেন, আমি নিশ্চিত যে, যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় আছে এবং বড় ধরনের বিপদ এড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার কোনো পরিকল্পনা ইরানের নেই। তবে আমাদের পারমাণবিক জ্বালানি এবং গবেষণার অধিকার রয়েছে। এদিকে তুরস্কের সংবাদ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শুক্রবার সন্ধ্যায় ইস্তাম্বুলে বৈঠক করেছেন। তবে বৈঠকে আলোচনা কী ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে তা জানা যায়নি। তাদের একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করার কথা।