ভারতের বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে ২৪২ আরোহীর মধ্যে ২৪১ জনের মৃত্যুসহ ৩ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অলৌকিকভাবে এক ব্রিটিশ যাত্রী প্রাণে বেঁচে গেছেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মৃতদের মধ্যে গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীসহ ভারতের ১৬৯ জন, যুক্তরাজ্যের ৫২, কানাডার একজন এবং সাতজন পর্তুগালের নাগরিক ছিলেন। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার এই দুর্ঘটনা ঘটে। আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা ছিল বিমানটির। এই দুর্ঘটনায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমারসহ বিশ্ব নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। দুর্ঘটনার তদন্তে সহায়তা করতে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি তদন্ত দল। ভারতের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ড এ তথ্য জানিয়েছে। এছাড়া, একটি ব্রিটিশ দলকেও তদন্তে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত সংস্থা।
যেভাবে বিমান দুর্ঘটনা:
ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান ফয়েজ আহমেদ কিদওয়াই এসোসিয়েটেডে প্রেসকে জানিয়েছেন, উড়োজাহাজটিতে ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু ছিলেন। এর ফ্লাইট নাম্বার ছিল এআই ১৭১। উড়োযানটি একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। যার ধারণক্ষমতা ২৫৬ জন। উড্ডয়নের পরপরই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিমান চলাচল পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ফ্লাইট রাডারের তথ্য, রানওয়ে থেকে ওঠার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ৬২৫ ফিট উচ্চতায় বিমানের সিগন্যাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুর্ঘটনার আগে বিপদসংকেত পাঠিয়েছিলেন বিধ্বস্ত বিমানটির পাইলট। আহমেদাবাদ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বা এটিসি জানিয়েছে, বিমানটি আহমেদাবাদ থেকে স্থানীয় সময় একটা ৩৯ মিনিটে আকাশে ওড়ে। বিমানটির পাইলট ক্যাপ্টেন সুমিত সাভারওয়াল বিমান থেকে বিপদ বার্তা দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরে এটিসির ডাকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। যাত্রার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘানি নগরের লোকালয়ের মধ্যে বিমানটি ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনার পর একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই বিমানের লেজের অংশটি নিচের দিকে নামতে নামতে হঠাৎ মাটিতে ভেঙে পড়ে। বিমানটি মার্কিন বিমান সংস্থা বোয়িংয়ের বি৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমান ছিল। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটি আহমেদাবাদের টার্মিনাল-২ থেকে ছেড়েছিল। ৯ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের উড়ান শেষে সেটির নামার কথা ছিল লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে। মাটিতে আছড়ে পড়ার পর দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে বিমানটি। বিস্তীর্ণ অংশ ঢেকে যায় কালো ধোঁয়ায়। আতঙ্কে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। যানজট সৃষ্টি হয় রাস্তায়। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলের যে ছবি প্রকাশ্যে আসে, তাতে ধরা পড়ে যে বিমানটি আছড়ে পড়ার পর তা একটি বহুতল ভবনের ওপর আটকে যায়। বিমানের সামনের অংশটি বহুতল ভবনে আটকে যায়। বহুতলটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
পুলিশ জানায়, বিমানবন্দরের কাছে চিকিৎসকদের একটি হোস্টেলের ওপরে বিমানটি ভেঙে পড়ে। বিমানটি ধ্বংস হয়ে গেছে। দুর্ঘটনাস্থলের চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিমানের চাকা ও বিভিন্ন অংশ। লোকালয়ে ভেঙে পড়ায় বিমানের আরোহী ছাড়াও বহু প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের একাধিক দল। বিমানের দুই পাইলটের নাম ক্যাপ্টেন সুমিত সবরওয়াল এবং ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দর। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটিতে ছিলেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা বিজয় রূপাণী। তিনি লন্ডনে যাচ্ছিলেন। তবে কোনো খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
‘যেন ভূমিকম্প হল’
আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন যে তার মনে হয়েছিল যেন ভূমিকম্প হলো। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি ঘরেই বসেছিলাম, হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দ হলো। মনে হল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। আমি তখনো জানতাম না বিমান ভেঙে পড়েছে। পরে এখানে এসে জানতে পারি।’ তিনি বলেন, এখানে এসে দেখি বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে আর ওখানে অনেকগুলো মৃতদেহ পড়ে আছে।
এক ব্রিটিশ যাত্রী জীবিত উদ্ধার:
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির এক ব্রিটিশ যাত্রী জীবিত রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। আহমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার জিএস মালিক সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ১১এ নম্বর আসনে বসেছিলেন ঐ যাত্রী এবং তিনি জীবিত আছেন। মালিক এ-ও জানিয়েছেন যে ঐ যাত্রী এখন হাসপাতালে। তার চিকিৎসা চলছে। বিমানের যাত্রীর যে তালিকা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছেন, তা থেকে জানা যাচ্ছে যে, ওই ব্যক্তির নাম বিশ্ব কুমার রমেশ এবং তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে যে, তারা হাসপাতালে রমেশের সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি সাংবাদিকদের নিজের প্লেনের বোর্ডিং পাশও দেখিয়েছেন। সেখানে তার নাম রয়েছে এবং আসন সংখ্যা উল্লেখ করা আছে ১১এ বলে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তার বক্তব্য প্রচার করেছে, যেখানে তিনি বলছেন, আকাশে ওড়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ভীষণ জোরে আওয়াজ হয় আর বিমানটা ভেঙে পড়ে। সব কিছু খুব কম সময়ের মধ্যেই ঘটে যায়। এদিকে অন্তত ৫০ মেডিক্যাল শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি যে চিকিৎসকদের ছাত্রাবাসের ওপর বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানকার ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছে ভারতের চিকিৎসকদের সংগঠন ফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (ফাইমা)। অ্যাসোসিয়েশনটি জানায়, পাঁচজন শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া অন্তত দুইজনকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে রাখা হয়েছে। কয়েক জনের চিকিৎসকের স্বজনও নিখোঁজ বলে জানা গেছে।
এই প্রথম বোয়িং ৭৮৭ এভাবে ভেঙে পড়ল:
আহমেদাবাদের আগে কখনো বোয়িং ৭৮৭ বিমান এভাবে ভেঙে পড়েনি। প্রায় ১৪ বছর আগে এই মডেলটি বাজারে এনেছিল বোয়িং সংস্থা এবং ছয় সপ্তাহ আগে ড্রিমলাইনার মডেলের বিমানে ১০০ কোটি যাত্রী বহন করার মাইল ফলক অর্জন করে বোয়িং কোম্পানি। সেই উপলক্ষ্যে বোয়িং জানিয়েছিল যে, তাদের তৈরি ১ হাজার ১৭৫টি বোয়িং ৭৮৭ বিমান ৫০ লাখ উড়ান অপারেট করেছে, বিমানগুলো আকাশে উড়েছে তিন কোটি ঘণ্টা। এই ঘটনাটি বোয়িং সংস্থাকে এত বড় ধাক্কা দিল এমন একটা সময়ে, যখন সংস্থাটি ৭৩৭ বিমান একের পর এক ভেঙে পড়াসহ নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আহমেদাবাদের ঘটনার পরে সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, তারা ঘটনার ব্যাপারে প্রাথমিক রিপোর্ট পেয়েছে এবং চেষ্টা করছে আরও তথ্য জানতে।
বিশ্ব নেতাদের শোক:
বিমান দুর্ঘটনার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, আহমেদাবাদের এই দুর্ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে, দুঃখিত করেছে। এটা কতটা হৃদয়বিদারক, তা কথায় বোঝানো যাবে না। তিনি লিখেছেন, যতজন মানুষ এই ঘটনায় প্রভাবিত, তাদর প্রত্যেকের কথাই আমার ভাবনা জুড়ে আছে এই দুঃসময়ে। যেসব মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা বিপদে পড়া মানুষদের সহায়তা করছেন, তাদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখছি। এছাড়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনাকে ‘অত্যন্ত মর্মান্তিক’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি গতকাল তার সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের জন্য আমাদের আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। শোক প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার। তিনি বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে ভয়াবহ দৃশ্য হিসাবে উল্লেখ করে লেখেন, বিমানটিতে অনেক ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। বিবিসি ও আনন্দবাজার পত্রিকা