জেলার বিভিন্নস্থানে পলিথিনের স্তূপ জমে দুর্গন্ধ সৃষ্টি : নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি ও দূষিত হচ্ছে পরিবেশ
- আপলোড টাইম : ০৯:৪৩:৩০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অগাস্ট ২০১৮
- / ৫৫৮ বার পড়া হয়েছে
চুয়াডাঙ্গায় নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ছড়াছড়ি : নেই আইনের প্রয়োগ
সোহেল রানা ডালিম/অঙ্কন মল্লিক: এক যুগেরও বেশী সময় আগে পলিথিন নিষিদ্ধ হয়েছে। অথচ চুয়াডাঙ্গা শহরসহ জেলাজুড়ে নিষিদ্ধ এই ব্যাগের ব্যবহার আবারও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। মার্কেট, মাছ-মাংস, কাঁচা বাজার, বইয়ের দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সর্বত্র পলিথিন ব্যাগের আধিপত্য। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। পাশাপাশি ব্যবহূত পলিথিনের স্তূপ জমে দুর্গন্ধ ও পানি নিষ্কাশনের প্রতিবন্ধকতাও জেলার অনেকস্থানে সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। এ ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে ব্যাপকভাবে বাড়ছে জলাবদ্ধতা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের নজরদারির অভাব ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা শহর ও গ্রামগঞ্জে পলিথিন উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণে তৎপর রয়েছে। ফলে নির্মূল হয়নি পলিথিনের ব্যবহার।
এদিকে, সরকার পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করাসহ এর উৎপাদন আমদানি ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে এর প্রয়োগ চোখে পড়ছে না গত কয়েক বছর। এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়া হবে না। স্থানীয় প্রশাসন পরিবেশ দূষণের দায়ে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করলেও পরিবেশের জন্য মহাবিপর্যয় সৃষ্টিকারী পলিথিন ব্যাগ বন্ধে উল্লেখযোগ্য কোন কার্যক্রম করেনি গত প্রায় এক বছর ধরে। যার ফলে চুয়াডাঙ্গা শহরসহ আশপাশ এলাকাতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম উপাদান পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার পুনরায় ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ফসলের মাঠ নদী-নালা থেকে শুরু করে সর্বত্র এই পলিথিন ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের সামনেও স্তূপাকারে রাখা হয়েছে ব্যবহৃত এ সকল পলিথিন।
চুয়াডাঙ্গা শহরসহ নিচের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটা দোকানে দেদারছে ব্যবহার করছে পলিথিন। এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও এই নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে করে প্রয়োজনীও দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করছেন। চাল-ডাল, তেল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি পণ্যবহনের জন্য দোকান থেকে দেওয়া হচ্ছে এসকল পলিথিন ব্যাগ। ইদানিংকালে ছোট ছোট বেকারী ফেক্টরীগুলো পাল্লা দিয়ে ব্যবহার করছে নিষিদ্ধ পলিথিন। চকলেট, চুইংগামের মোড়ক, বিস্কুট, চিপস, পাউরুটি ছাড়াও ছোট ছোট অনেক কোম্পানি তাদের পণ্যগুলো হরদম পলিথিনে মুড়িয়ে বাজারজাত করছেন, যা পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরসহ আশপাশ এলাকায় অর্ধশতাধিক পাইকারি পলিথিনের দোকান রয়েছে। এসকল দোকানে নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। অনেকে আবার ঢাকার চক বাজার, কুষ্টিয়াসহ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত থেকেও অবৈধ পথে দেশে এনে বিক্রি করছেন পলিথিন। অবৈধভাবে আনা ভারতীয় পলিথিন অনেকটা প্রকাশ্যে বিক্রি করা হলেও প্রশাসনের নজরে আসছে না এ সকল ব্যবসায়ী।
এদিকে, পলিথিন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা জানে এ সকল পলিথিন বিক্রি করা বেআইনী। তারপরও বাধ্য হয়ে পলিথিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। কেননা পলিথিনের বিকল্প কিছুই বাজারে নেই। কাগজের তৈরি প্যাকেট ব্যবহারে কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন, ছোট দোকানীরা তাদের কাছে এই পলিথিন প্যাকেটই চাই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারীর বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেন, গত এক বছরের অধিক সময় ধরে কড়াকড়ি না থাকায় এখন পলিথিন বিক্রি হচ্ছে। বাজারে কয়েকটি মুদি দোকানির কাছে পলিথিনের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, কাগজের প্যাকেট ওজনে বেশি হয়। এতে ক্রেতার লোকসান হয়। তাছাড়া এমন অনেক দ্রব্যসামগ্রী আছে যেগুলি পলিথিন ছাড়া বিক্রি করার কোন উপায় নাই। এসময় তারা আরো বলেন, সরকার পলিথিনের বিকল্প কিছু তৈরি করলে, তারা পলিথিন ব্যবহার ছেড়ে দেবেন।
সরকার গত ২০০২ সালে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। সে সময় এ আইনটি বাস্তবায়নের লক্ষে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬ (ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২(দুই) লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। এছাড়া পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দন্ড হতে পারে। আবার বিক্রি বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশে পরিবহনসহ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ১ বছরের কারা দন্ড বা উভয় দন্ড হতে পারে।
যার ফলে সে সময়ের পর স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের প্রতিটা এলাকায় পলিথিনের ব্যবহার কমতে শুরু করে বহুগুণে। কিন্তুু বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারী বা আইনের প্রয়োগ কম থাকায় এর ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে যার পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এদিকে সন্ধ্যার পর চুয়াডাঙ্গা শহরসহ আশপাশের বাজারগুলো পরিদর্শন করলে এর বাস্তব চিত্র চোখে ভেসে ওঠে। হাজার হাজার ব্যবহৃত পলিথিন স্তুপাকারে রাখা হয়েছে। এই সকল পলিথিন ড্রেন বা নদীনালা খাল বা চাষাযোগ্য জমিতে পড়ে নষ্ট করছে এর স্বাভাবিক পরিবেশ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র আহবায়ক চুয়াডাঙ্গা সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পলিথিন পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর সে সম্পর্কে এসকল ব্যবসায়ীদের কোন ধারণা নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে পলিথিন মাটির সাথে মিশে যেতে সাড়ে ৪শ’ বছর সময় লাগে। এ পলিথিন প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা ছাড়াও ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে নানারকম রোগ ব্যাধি। বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে বাড়িতে পলিথিন ব্যাগে ছেয়ে গেছে। বাজার করার কাজ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন। ফলে মাঠ ঘাট, পুকুর, জলাশয়, সর্বত্র মহামারী আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে কৃষকের গলার কাটা হয়ে উঠেছে এ পলিথিন। এখনি কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই নষ্ট হবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। এসময় তিনি আরো বলেন, শুধু জনসচেতনাতার মাধ্যমেই এর ব্যাবহার রোধ করা যাবে না। এর পাশাপশি স্থানীয় পর্যায়ে আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগসহ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার সিনিয়র কেমিস্ট মিজানুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, সরকার পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী পলিথিনকে বিদায় জানানোর জন্য কঠোর আইন করেছেন। সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যবসায়ীদের প্রতি আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। লোকবল সংকটের কারণে আমাদের অভিযান একটু ঢিলেঢালাভাবে চলছে। তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এসকল পলিথিন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এবিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টিকারি নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।