প্রতিবছর বিশ্বে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে; চুয়াডাঙ্গায় গত ৬ মাসে ৬৮ জনের আত্মহত্যা
- আপলোড টাইম : ০৯:১৮:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অগাস্ট ২০১৮
- / ৫২৮ বার পড়া হয়েছে
কিশোর-কিশোরীদের মাঝে বাড়ছে হতাশা ও বিষন্নতা : আত্মহত্যার ঝুঁকি
ফেরদৌস ওয়াহিদ/অঙ্কন মল্লিক: আত্মহত্যা অথবা আত্মহনন যে নামেই বলি এটি অমূল্য জীবনের অপচয়। আত্মহত্যা সম্পন্ন হয়ে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না। এ জন্য আত্মহত্যা প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর উপায়। সাম্প্রতিক সময় তরুণদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডঐঙ) এর তথ্যানুসারে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে সমগ্র পৃথিবীতে একজন আত্মহত্যা করছে! আরো যোগ করা প্রয়োজন, প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে প্রায় ২০ বারের প্রচেষ্টা! খুব বেশী দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, যারা আত্মহননের চেষ্টা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর কিশোর-কিশোরীরা। আর গবেষকরা আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন একাকিত্ব, হতাশা, বিষন্নতাকে। আর এই হতাশা ও বিষন্নতার পেছনে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবক। চুয়াডাঙ্গায় গত ৬ মাসে ৬৮জন আত্মহত্যা করেছে। আর আত্মহত্যার অপচেষ্টা করেছে ৫৬ জন। আত্মহত্যাকারীদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজ পড়–য়া কিশোর-কিশোরী।
গত এক দশক ধরে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। প্যাডিয়াটিক্সের গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ২০১৭ সালে ১১.২ শতাংশে ৩ শতাংশ তেরো জনকে রিপোর্ট করা হয়েছে, যা গতবছর একটি বড় বিষন্নতার ঘটনা ছিল। কিশোর-কিশোরীরা বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত বছরের চেয়ে ১৩ বছরের বৃদ্ধির হার ১.৩% থেকে বেড়ে ২৭%। ছেলেদের মধ্যে হতাশার মাত্রা ৪. ৫% থেকে বেড়ে ২৫.৫% দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বস্ব্যাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন (প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন)। আমাদের দেশে আত্মহত্যার জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন স্থানীয় গবেষণায় দেখা যায়, এ হার প্রতি লাখে ১০ জন। এটি উন্নত দেশের কাছাকাছি। প্রতিটি আত্মহত্যার আগে গড়ে ২৫ বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর এ অসংখ্য জীবনহানি প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা, দ্রুত ও সময়মতো আত্মহত্যার প্রবণতা নির্ণয় এবং তার প্রতিকার। আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যে মানসিক রোগ তার নাম বিষন্নতা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সবকিছু (নিজের, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে। সবসময় মনে করে যে এ অবস্থা থেকে তার পরিত্রাণ নেই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায় আমাদের দেশে বিষন্নতার হার ৪ দশমিক ৬ ভাগ।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বখাটেদের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত হওয়া, ধর্ষণের শিকার হওয়া, প্রেমে প্রতারিত ও ব্যর্থ হওয়া, অভিভাবকদের বকাঝকা, পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা আশানুরূপ ফল না হওয়া কিশোরীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। আর গৃহবধূরা পারিবারিক সমস্যা-সহিংসতা, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক, একাধিক কন্যাসন্তান প্রসব করা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে বেশি আত্মহত্যা করেন।
এবিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষন্নতার অন্যতম কারণ আত্মহত্যা। সঠিক সময়ে বিষন্নতা নির্ণয় ও চিকিৎসা করা সম্ভব হলে অন্তত আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যেত। তিনি আরও বলেন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিষন্নতাসহ সব ধরনের মানসিক রোগের চিকিৎসা আছে।
প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের পৃথিবীটাকে ছোট করে দিয়েছে আর যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলো রূপকথার বাস্তব রূপ পেয়েছে। সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক জাদুর কাঠির মতো যেন পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকা বন্ধুর সাথে মুহূর্তেই যোগাযোগ করিয়ে দেয় এই মাধ্যমটি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো মানুষের নিত্যদিনের ভালো সময় কাটানোর একটি প্লাটফর্ম এটি। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের এ যোগাযোগ মাধ্যমটি যেমন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে তেমনি রেখে যাচ্ছে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও। গবেষকরা মনে করছেন, অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ফেসবুকে প্রচুর সময় ব্যয় করছে এবং মানুষের হতাশায় ভোগার পরিমান বাড়ছে।
সমাজ বিজ্ঞানী এবং গবেষকগণ বলেছেন, ফেইসবুক মানুষের জন্য কল্যাণকর ভূমিকা রাখলেও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষের হতাশা হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই হতাশার পরিমাণ যুবক যুবতীদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। কেউ সারাদিন খুব ব্যস্ত সময় কাটিয়ে বাসায় এসে ফেসবুকে ঢুকে তার ওয়াল এ দেখতে পেলেন কাছের বন্ধুরা কোথাও থেকে হয়তো ঘুরে এসেছে অথবা কোনো এক পার্টিতে খুব মজা করেছে। সেখানে হয়তো তার থাকবার কথা ছিল কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে তিনি থাকতে পারেননি। আবার কেই একজন ফেসবুকে একজনের সাথে চ্যাটিং করে ভালো বন্ধুত্ব তৈরী করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সে হারিয়ে গেলো। চাইলেও তার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এর থেকেও অনেকে হতাশায় ভুগে থাকেন।
ওহিও স্টেট ইউনির্ভাসিটির অধ্যাপক ও গবেষক সিলভিয়া নবলক বলেছেন, যখন মানুষের মন ভালো থাকে তখন তারা বিখ্যাত ব্যক্তিদের ফলো করতে ভালোবাসে। কিন্তু মন ভালো থাকলে সাধারণ মানুষদের জীবন যাপনেও উৎসাহী হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকের প্রতি যারা আসক্ত তারা খানিকটা খিটখিটে হয়ে পরে। তার কারণ হলো- বন্ধুদের কাছে থেকে নিয়মিত সাফল্যের খবর পেতে পেতে একটা সময়ে নিজেকে ব্যর্থ এবং পিছিয়ে পড়া মনে হতে শুরু হয়। তাই সোশ্যাল মিডিয়াকে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যখন মন খারাপ থাকে তখন মানুষ ওই সমস্ত মানুষদের প্রোফাইল বেশি ভিজিট করে যারা তার থেকেও পিছিয়ে পড়া। ফেসবুকের হতাশা বাড়ানোর ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। তার একটি গবেষণায় বলা হয়, আমাদের সাধারণ ধারণা হলো বয়স হয়ে গেলে মানুষ একাকী হয়ে যায়। কিন্তু কম বয়সী ছেলে মেয়েরাও ফেসবুকের প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণে একা হয়ে পড়ছে।
মনোবিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেছেন, এই ঘটনাগুলো বেড়েই চলেছে। ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তির কারণে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা অন্যদের থেকে একাকী জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছে। আর এই একাকিত্ব তাদের মনে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। আর দীর্ঘদিনের হতাশা মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকতে সাহায্য করে। গবেষকরা জানিয়েছেন, একাকীত্বতা যেমন মানুষিক বোরো ক্ষতির কারণ তেমনি এটি শারীরিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে থাকে। একাকী মানুষ ধীরে ধীরে সবার কাছে থেকে দূরে সরে যায় এবং এটা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর গবেষকরা বলছেন, একাকিত্বের কারণে মানুষের মস্তিষ্কের সাদা রক্ত কোষ উৎপাদন ব্যাহত হয় যা শারীরিক অসুস্থতা ডেকে আনে।
তবে এসব মতামতের বিরোধিতাও করেছেন অনেকে। কিছু গবেষক বলেছেন, মানুষের একাকিত্ব বা হতাশা হয়ে যাওয়ার জন্য ফেইসবুক দায়ী নয়। মানুষ আগের তুলনায় অধিক মাত্রায় আয়মুখী ও ভোগবাদী মানুষিকতার হয়ে পড়ছে। যা অধিকাংশ সময়ে অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। এর জন্য মানুষের নৈতিক শিক্ষার খুব প্রয়োজন।