ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বিপন্ন মানবতা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৪৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই ২০১৮
  • / ৫৮৬ বার পড়া হয়েছে

মানবসভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। একটা সময় ছিল যখন হাটবাজারে মানুষ কেনাবেচা হতো। মানুষ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করত। মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা বলে কিছুই ছিল না। নবী করিম (সা.) জন্মগ্রহণের আগে আরবের সেই অন্ধকার যুগ অর্থাৎ আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা স্মরণ করতে পারি। তখন নারীর কোনো সম্মান ছিল না। তাদেরকে পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হতো। আবার ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর বহু শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের কিনে আমেরিকায় নিয়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে বর্ণ বৈষম্যের ইতিহাস, তার মূলেও আছে এই দাসপ্রথা। আমরা জানি, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার মাটি থেকে দাস প্রথা বিলোপে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশ্বে বৈষম্যহীন একটি সমাজ বিনির্মাণে দাস প্রথার বিলোপ একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। সামাজিক স্তর বিন্যাসের একটি অন্যতম ধরন হচ্ছে এই দাস প্রথা। চরম অবস্থায় দাস হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে অধিকারবিহীন ব্যক্তি। অতএব, দাস ব্যবস্থানির্ভর সমাজ বলতে এমন এক সমাজ বোঝায় যেখানে কিছু লোক সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে অধিকারবিহীন। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্ব কি প্রকৃত অর্থে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে? পৃথিবীর শাসনব্যবস্থায় বৈষম্যহীন একটি সমাজব্যবস্থা কি বিনির্মিত হয়েছে? আসলে তা হয়নি। গত ১৯ জুলাই প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স ২০১৮’-তে এরকম তথ্যই উঠে এসেছে। সংস্থাটি মানুষের এই দুর্দশাকে বর্ণনা করেছে ‘ছদ্ম দাসত্ব’ হিসেবে। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের চার কোটির বেশি মানুষ এ আধুনিক দাসত্বের শিকার। আর বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা চার লাখের বেশি। মহাদেশ হিসেবে এশিয়ার সবচেয়ে বেশি মানুষ আধুনিক দাসত্বের কবলে রয়েছে। দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি উত্তর কোরিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই দাস প্রথার শিকার। ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ নম্বরে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩ দশমিক ৬৭ জন মানুষ কোনো না কোনোভাবে ছদ্ম দাসত্বের শিকার। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এ ধরনের দুর্দশায় পড়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। এখানে প্রথমে আসে রাষ্ট্রের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গ। যেমন দেখা যায়, বাংলাদেশের অনেক নারী আর্থিক সচ্ছলতার আশায় দালালের খপ্পরে পড়ে (অনেক ক্ষেত্রে স্বামী, সন্তান ফেলে) সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানতে পারছি অধিকাংশের বাস্তব অবস্থা কী। যে প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে তারা বিদেশে পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, বিদেশে গিয়ে দেখা গেল তাদের সব আশায় গুড়ে বালি। মালিকপক্ষ পাসপোর্ট আটকে রেখে তাদের ইচ্ছামতো চলতে-ফিরতে বাধ্য করছে। যৌন হয়রানিসহ শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এই নারীরা একরকম জিম্মি হয়ে পড়ছে। কখনও বা নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরছে। বিষয়টিকে আধুনিক দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে, সর্বোপরি সচেতন হতে হবে। সবার প্রাপ্য অধিকারের কথা সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বিপন্ন মানবতা

আপলোড টাইম : ০৮:৪৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই ২০১৮

মানবসভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। একটা সময় ছিল যখন হাটবাজারে মানুষ কেনাবেচা হতো। মানুষ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করত। মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা বলে কিছুই ছিল না। নবী করিম (সা.) জন্মগ্রহণের আগে আরবের সেই অন্ধকার যুগ অর্থাৎ আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা স্মরণ করতে পারি। তখন নারীর কোনো সম্মান ছিল না। তাদেরকে পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হতো। আবার ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর বহু শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের কিনে আমেরিকায় নিয়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে বর্ণ বৈষম্যের ইতিহাস, তার মূলেও আছে এই দাসপ্রথা। আমরা জানি, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার মাটি থেকে দাস প্রথা বিলোপে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশ্বে বৈষম্যহীন একটি সমাজ বিনির্মাণে দাস প্রথার বিলোপ একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। সামাজিক স্তর বিন্যাসের একটি অন্যতম ধরন হচ্ছে এই দাস প্রথা। চরম অবস্থায় দাস হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে অধিকারবিহীন ব্যক্তি। অতএব, দাস ব্যবস্থানির্ভর সমাজ বলতে এমন এক সমাজ বোঝায় যেখানে কিছু লোক সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে অধিকারবিহীন। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্ব কি প্রকৃত অর্থে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে? পৃথিবীর শাসনব্যবস্থায় বৈষম্যহীন একটি সমাজব্যবস্থা কি বিনির্মিত হয়েছে? আসলে তা হয়নি। গত ১৯ জুলাই প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স ২০১৮’-তে এরকম তথ্যই উঠে এসেছে। সংস্থাটি মানুষের এই দুর্দশাকে বর্ণনা করেছে ‘ছদ্ম দাসত্ব’ হিসেবে। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের চার কোটির বেশি মানুষ এ আধুনিক দাসত্বের শিকার। আর বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা চার লাখের বেশি। মহাদেশ হিসেবে এশিয়ার সবচেয়ে বেশি মানুষ আধুনিক দাসত্বের কবলে রয়েছে। দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি উত্তর কোরিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই দাস প্রথার শিকার। ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ নম্বরে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩ দশমিক ৬৭ জন মানুষ কোনো না কোনোভাবে ছদ্ম দাসত্বের শিকার। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এ ধরনের দুর্দশায় পড়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। এখানে প্রথমে আসে রাষ্ট্রের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গ। যেমন দেখা যায়, বাংলাদেশের অনেক নারী আর্থিক সচ্ছলতার আশায় দালালের খপ্পরে পড়ে (অনেক ক্ষেত্রে স্বামী, সন্তান ফেলে) সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানতে পারছি অধিকাংশের বাস্তব অবস্থা কী। যে প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে তারা বিদেশে পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, বিদেশে গিয়ে দেখা গেল তাদের সব আশায় গুড়ে বালি। মালিকপক্ষ পাসপোর্ট আটকে রেখে তাদের ইচ্ছামতো চলতে-ফিরতে বাধ্য করছে। যৌন হয়রানিসহ শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এই নারীরা একরকম জিম্মি হয়ে পড়ছে। কখনও বা নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরছে। বিষয়টিকে আধুনিক দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে, সর্বোপরি সচেতন হতে হবে। সবার প্রাপ্য অধিকারের কথা সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।