ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা
- আপলোড টাইম : ০১:২৮:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৬
- / ৪৫৯ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ ডেস্ক: প্রায় ২২ ঘণ্টার সফর শেষে ঢাকা ছেড়ে গেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সময়ের হিসেবে সফরটি ‘সংক্ষিপ্ত’ হলেও এটি ছিল নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হাই প্রোফাইল ওই সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মিডিয়ায় চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষ করে ঢাকা, বেইজিং ও দিল্লির সংবাদ মাধ্যমে। দেশের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনেও আছে বিস্তর আলোচনা। ৩০ বছর চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের এটিই ছিল প্রথম সফর। এ সফরে কি পেলো ঢাকা? বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিধর চীনের প্রেসিডেন্টই এ সফরের মধ্য দিয়ে কি অর্জন করলেন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সফরকালে সরকারি-বেসরকারি মিলে অর্ধশত চুক্তি, ঋণ চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সফরে মোট ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। যাকে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ঋণের ‘রেকর্ড’ হিসাবে দেখা হচ্ছে। ওই ঋণের বেশির ভাগই অবকাঠামো খাতে ব্যয় হবে। সফরে দুই দেশের নেতৃত্ব ঢাকা-বেইজিং বিদ্যমান সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। জয়েন্ট স্টেটমেন্ট বা যৌথ ঘোষণায়ও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। ওই ঘোষণার সূচনাতেই সফরটিকে ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করা হয়। সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারা বলছেন, চীন-ই প্রথম দেশ যার সঙ্গে বাংলাদেশ তার বিদ্যমান সহযোগিতামূলক সম্পর্কে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। অবশ্য চীন এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র- যেমন ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অনেক আগেই এমন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বিদায়ের আগেই দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত রূপরেখা সই হয়। ‘এসটাবলিশিং স্ট্যাটেজিক পার্টনারশিপ অন কো-অপারেশন বা সহযোগিতায় কৌলশগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা’ সংক্রান্ত ২৩ দফার ওই যৌথ ঘোষণায় আগামী দিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছেন বাংলাদেশ ও চীনের শীর্ষ নেতৃত্ব। ওই ঘোষণায় সামরিক সহযোগিতা বজায় রাখতেও ঢাকা- বেইজিং একমত হয়েছে বলে স্পষ্ট করা হয়। বিশ্লেষকরা চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকে কেন্দ্র করে দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত উচ্ছ্বাসকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে বর্ণনা করছেন। তবে তারা এ সফরের অর্জনকে ধরে রাখতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের আরও দক্ষতা, কৌশলী এবং পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। তার সম্মানে দেয়া প্রেসিডেন্টের স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট বা রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ নিয়েছেন এবং বাঙালি সংস্কৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশেনা উপভোগ করেছে। বিদায়ের আগে সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেছেন। সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও বিএনপি চেয়ারপারসন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ওই অতিথির সঙ্গে সংসদের বিরোধী নেত্রীর কোন সাক্ষাৎ হয়নি। সফর প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা এজন্য ‘সময়ের তাড়া’র বিষয়টি সামনে আনলেও তারাই বলছেন- প্রেসিডেন্ট শি এ দেশের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভার যাওয়ার করণে ভারতের গোয়ায় ব্রিকস সামিটে তার একটি সূচিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকালে সংঘটিত রাজনৈতিক বৈঠকগুলোরও ‘তাৎপর্য’ খোঁজার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেখানে ভূ-রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়টিও বিবেচনায় আসছে। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় দিল্লি, টোকিও এবং ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া কি হয়, প্রধানমন্ত্রী ও তার কূটনৈতিক উপদেষ্টারা সেটাকে কিভাবে মোকাবিলা করছেন বা করবেন-সেদিকেও নজর রাখছেন অনেকে। সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশকে দেয়া চীনের ঋণ সুবিধা এবং দেশটির অর্থায়নে বস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা মেগা প্রকল্পগুলোর হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছেন। ভারতের এনডিটিভি’র এক প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে সম্পাদিত ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তিকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাওয়া সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে চীনের দেয়া ঋণের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে দেয়া সহজ শর্তে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তির তুলনাও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সেই তুলনায় চীন বাংলাদেশকে ভারতের চেয়েও বেশি ঋণ দিচ্ছে। সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া স্ট্যাডিজের পরিচালক জাও গানচেং বলেন, ‘ভারত ও চীন উভয় দেশই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়, যা অন্য কেউ চায় বা না চায়। এ নিয়ে দেশ দু’টির মধ্যেকার কোনো প্রতিযোগিতা থাকার কথাও মানতে নারাজ ওই বিশ্লেষক। তার মতে, বাংলাদেশ চীন ও ভারতের বিনিয়োগকে সব সময় স্বাগত জানায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও গতকাল বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চীনকে যেমন লাগবে ভারতকেও লাগবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সফরের আগেই এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, চীনের সফরে দিল্লি তো নয়ই অন্য কোনো দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না। অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান চীনের ঋণে বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন- চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চায়। যার মধ্যে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে তাদের আগ্রহ বেশি। এমএ মান্নান রয়টার্সকে বলেছেন, ‘কম সুদে রেকর্ড পরিমাণ (২৪ বিলিয়ন ডলার) ঋণ চুক্তি সই করায় শি জিনপিংয়ের সফর একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ এবং তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন অন্যতম। অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের অবকাঠামো সমপ্রসারণ করা প্রয়োজন। এজন্য আমাদের সহজ শর্তে অনেক ঋণ দরকার। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেণকরা। এটাকে ‘অসম’ বলেই মনে করেন তারা। প্রেসিডেন্টের সফরে চীনের বাজারে কোটা ফ্রি এবং ডিউটি ফ্রি রপ্তানির সুবিধা চেয়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। চীনে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের নিচে রপ্তানি করে। আর বিপরীতে চীন করে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে সমতা আনতে হলে শুধু রপ্তানি বাড়ালেই হবে না। চীন যেসব শিল্প বন্ধ করে দিচ্ছে তা বাংলাদেশে আনা যায় কি-না তা নিয়ে ভাবতে হবে। ওই অর্থনীতিবিদ মনে করেন প্রেসিডেন্ট শি’র সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি বিশ্ব দরবারে আরেকবার উপস্থাপিত হলো। তবে চীনের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের প্রয়োজন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখার তাগিদ দেন তিনি।