মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের আহ্বান আরাফাত ময়দানে আল্লাহর করুণা প্রার্থণা
- আপলোড টাইম : ১১:৪৩:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬
- / ৮৩৭ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ ডেস্ক: পাপমুক্তি আর আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনায় পবিত্র মক্কা নগরীর অদূরে ‘উকুফে আরাফা’ অবস্থানের মধ্য দিয়ে গতকাল পবিত্র হজ পালন করেছেন গোটা দুনিয়া থেকে আগত লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আরাফাতের পাহাড়ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত হতে থাকে আবেগাপ্লুত বেশুমার কণ্ঠের ‘লাব্বাইক/ আল্লাহুম্মা লাব্বাইক/ লা-শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নে’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লাশারিকা লাক’— তালবিয়ায়। ‘জাবালে রাহমত’ সাদা আর সাদায় একাকার। আদিগন্ত মরুপ্রান্তর এক অলৌকিক পুণ্যময়তা অধিকার করে রাখে। এক অপার্থিব আবহ রচিত হয় পুরো ময়দানে। সবার পরনে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। নেই আশরাফ-আতরাফ বিভেদের অচলায়তন। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ জানান সমবেত মুসলমানরা। একে অপরের সাথে পরিচিত হন, কুশল বিনিময় করেন। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যের অবতারণা হয় গতকাল সেই ময়দানে। বিশ্ব মুসলমানের মহাসম্মিলনের দিন। গতকাল দুপুরে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর মসজিদ নামিরা থেকে খুতবা প্রদান করেন সৌদি আরবের মুফতি। হজের খুতবা শুনে ইমামের পিছনে পর পর জোহর ও আছরের নামাজ জোহরের ওয়াক্তে আদায়ের পর সৌদি আরবে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন হাজিরা। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবের সময় ব্যবধান তিন ঘণ্টা। সুর্যাস্তের পর আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করে মুজদালিফার উদ্দেশে রওয়ানা হন হাজিরা। মুলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। খুতবায় মুফতি মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। মুফতি বলেন, মুসলমান হওয়ার পর ঈমান আনার পর সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ হচ্ছে নেক আমল, নামাজ, রোজা, তসবিহ, তাহলিল। এ সব কিছুই হচ্ছে নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। নেক আমলের গুরুত্ব অপরিসীম। যারা ঈমান আনবে তাদের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে নেক আমল করা। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাবেশ এবারের হজে ২০ লাখের বেশি মুসলমান অংশ নিচ্ছেন। আল্লাহ রাব্বুাল আলামিনের মেহমানরা গতকাল সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে কেউ গাড়িতে, কেউ পায়ে হেঁটে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওনা হন। সৌদি কর্তৃপক্ষ হাজিদের আরাফাত ময়দানে আনার জন্য বিপুলসংখ্যক গাড়ির ব্যবস্থা করেন। ইহরাম পরা মুসলিমদের এই স্রোত যতই আরাফাতের নিকটবর্তী হতে থাকে, ততই তাঁরা ভাবাবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের মানস চোখে ভেসে ওঠে সেই আরাফাত ময়দানের ছবি, যেখানে ১৪০০ বছর আগে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বিদায় ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর কাছে সর্বশেষ ওহি নাজিল করেছিলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (ইসলাম) পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।’ (সূরা আল মায়িদা, আয়াত-৩) বিদায় হজ থেকে ফেরার তিন মাসের মাথায় ইসলামের কাণ্ডারি রাহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন। আরাফাতের ময়দান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০ মিটার উঁচুতে। চারপাশে পাহাড়ঘেরা একটি সমতল ভূমি। হাজিদের কেউ কেউ সেখানে তাঁবু টানিয়ে, কেউবা খোলা আকাশের নীচে মাথায় ছাতা ধরে অবস্থান করেন। অনেকে আগের রাতেই সোজা উঠে যান আরাফাত ময়দান সংলগ্ন ৭০ মিটার উঁচু ‘জাবালে রহমত’ তথা রহমতের পাহাড়ে। রহমতের পাহাড়ে উঠে সেখানেই তাঁরা দিনভর মহান আল্লাহর করুণা ও মাগফিরাত কামনা করেন। বিশ্বের সর্ববৃহত্ মসজিদ ‘মসজিদে নামিরাহ’ থেকে জুমার নামাজের আগে বয়ান ও খুতবা পাঠ করেন সৌদি আরবের মুফতি। এই মসজিদকে একদিনের মসজিদ বলা হয়। আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ‘ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয়। আরাফাতের পাহাড়ে একটি বড় উঁচু পিলার আছে। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলে থাকেন। উঁচু পিলারের কাছে যাওয়ার জন্য পাহাড়ে সিঁড়ি করা আছে, যাতে এটি বেয়ে খুব সহজে চূড়ায় চলে যাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) দীর্ঘদিন কান্নাকাটির পর এখানেই এসে মিলিত হয়েছিলেন। হাজিরা আরাফাত ময়দানে অবস্থান শেষে তাদের গন্তব্য মুজদালিফা। মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশা’র নামাজ এশা’র ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন। মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশে রওনা হবেন। ১০ জিলহজ মিনায় পৌঁছার পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে মিনাকে ডান দিকে রেখে হাজিরা দাঁড়িয়ে শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ করবেন। দ্বিতীয় কাজ আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি করা। অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় পর্বে মাথা ন্যাড়া করা। চতুর্থ কাজ তাওয়াফে জিয়ারত। হাজিরা মক্কায় ফিরে কাবা শরীফ ‘তাওয়াফ’ ও ‘সাঈ’ (কাবার চারদিকে সাতবার ঘোরা ও সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ানো) করে আবার মিনায় ফিরে যাবেন। জিলহজের ১১ তারিখ মিনায় রাত যাপন করে দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হাজিরা বড়, মধ্যম ও ছোট শয়তানের উপর সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন। পরদিন ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে পুনরায় একইভাবে হাজিরা তিনটি শয়তানের উপর পাথর নিক্ষেপ করবেন। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে অনেকে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। আর মক্কায় পৌঁছার পর হাজিদের একটি কাজ অবশিষ্ট থাকে। সেটি হচ্ছে কাবা শরীফ তাওয়াফ করা। একে বলে বিদায়ী তাওয়াফ। স্থানীয়রা ছাড়া বিদায়ী তাওয়াফ অর্থাত্ কাবা শরীফে পুনরায় সাতবার চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে হাজিরা সম্পন্ন করবেন পবিত্র হজব্রত পালন।