যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর
- আপলোড টাইম : ০১:২৯:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
- / ৫৩২ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ ডেস্ক: চট্টগ্রামের জল্লাদখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার দণ্ড কার্যকর হয় বলে কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এটি ফাঁসি কার্যকরের ষষ্ঠ ঘটনা। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত আলবদরের নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার পর নিয়মানুযায়ী ২০ মিনিট তার মৃতদেহ ফাঁসি প্রকোষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ১০টা ৫০ মিনিটে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানোর পর চিকিৎসক তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এর পর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে তার মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে কঠোর পুুলিশ পাহারায় গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে পাঠানো হয়েছে। কারাফটক দিয়ে বের হওয়ার সময় মীর কাসেমের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার সম্পন্ন হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেন। রায় কার্যকর হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরাও সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রায় কার্যকরের খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চেরকর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আনন্দ মিছিল হয়েছে মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, মীর কাসেম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। এরপর আইন অনুযায়ী যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এদিকে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় কার্যকরের ঐতিহাসিক মুহূর্তের খবর জানতে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি বাঙালি সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। সন্ধ্যার পর থেকেই কাশিমপুর কারাগারের আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। কারাগারের বাইরে র্যাব-পুলিশের সদস্যরা কঠোর নিরাপত্তাব্যুহ তৈরি করেন। একই সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র সতর্ক অবস্থান নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর আগে মীর কাসেমের সঙ্গে ‘শেষ দেখা’ করতে শনিবার বেলা ৩টা ৩৮ মিনিটে তার পরিবারের তিন শিশুসহ ৪৭ সদস্য কাশিমপুর কারাগারে যান। তবে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের সদস্যরা সোয়া ৪টায় দেখা করার সুযোগ পান। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২৫ জন এবং দ্বিতীয় দফায় ১৩ জন মোট ৩৮ জনকে দেখা করার জন্য ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় বলে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জেলার নাশির আহমেদ নিশ্চিত করেন। উল্লেখযোগ্য স্বজন ছিলেন মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন, ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমান, পুত্রবধূ সায়েদা তাহমিদা আক্তার ও তাহমিনা আক্তার, মেয়ে তাহেরা তাসমিন, ভাগ্নে রুমান পারভেজ ও আব্দুল্লাহ আল মাহাদী, ভাতিজা কেএম রশিদ উদ্দিন ও শুভ মজুমদার। সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় পরিবারের সদস্যরা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে ৬টি গাড়িতে মীর কাসেমের পরিবারের সদস্যরা ঢাকার মিরপুরের মনিপুরের বাসা থেকে কারাগারের পথে রওনা হন। মীর কাসেমের মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া জানান, শনিবার সকালে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যক্তিগত সহকারীকে টেলিফোন করে বেলা সাড়ে ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে শেষ দেখা করার কথা বলেন। এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে শনিবার সকাল থেকেই ফাঁসি কার্যকরে চূড়ান্ত মহড়া সম্পন্ন করা হয়। দুপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর ফাঁসির মঞ্চে জল্লাদ শাহজাহান, দ্বীন ইসলাম, রিপন ও শাহীন তৃতীয় দফা ও শেষবারের মতো মহড়া সম্পন্ন করেন। এ সময় কারা কর্মকর্তা ও রক্ষীদের একটি দল সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
কারা সূত্রে জানা গেছে, শনিবার বেলা ৪টা ৫০ মিনিটে মীর কাসেমের ফাঁসির নির্বাহী আদেশ গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছে। আর এরপরই মূলত ফাঁসি কার্যকরের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে কারাগারে প্রবেশ করেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। এর আগে বেলা দেড়টার দিকে অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল ইকবাল হাসানকে কাশিমপুর কারাগারে ঢুকতে দেখা যায়। বিকাল ৪টায় কারাগারে যান ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার। কাছাকাছি সময় সেখানে যান গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম, পুলিশ সুপার (এসপি) হারুনুর রশিদ। এছাড়াও ফাঁসির দ- কার্যকরের বিভিন্ন আনুষঙ্গিকতায় অংশ নেয়ার জন্য সেখানে উপস্থিত হন সিভিল সার্জন ডা. হায়দার আলী খান, কাশিমপুর কারাগার-২-এর সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক ও জেলার নাসির আহমেদ। কারা সূত্র জানায়, রাত ১০টার দিকে কারাগারে মীর কাসেমকে শেষ গোসল করানো হয়। এর পর তিনি নামাজ আদায় করেন। পরে কাশিমপুর কারা জামে মসজিদের ইমাম মুফতি হেলাল উদ্দীন তাকে তওবা পড়ান। ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে একাধিকবার চিকিৎসক তার শারীরিক পরীক্ষা করেন। ১১টার আগে জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন জল্লাদ মীর কাসেমকে পিছমোড়া করে দু’হাত বেঁধে যমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। মঞ্চে তোলার পর তার গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হয়। জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটের সংকেত পেয়ে সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক তার হাতে থাকা রুমাল মাটিতে ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদ শাহজাহান ও তার সহযোগীরা লিভার টান দেন। এতে তার পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে যায় ও ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০ মিনিট ঝুলে থাকার পর তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। সিভিল সার্জন ডা. হায়দার আলী খান ১১টা ২০ মিনিটে মীর কাসেমের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের চারপাশে অবস্থান নেন ১০ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। ফাঁসি কার্যকরের অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, কাসেমকে যখন ফাঁসির মঞ্চে নেয়া হয়, তখন তাকে ভাবলেশহীন দেখা গেছে। এ সময় তিনি মৃদুস্বরে দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। এর একপর্যায়ে তিনি কিছুটা উচ্চস্বরে কলেমা পড়তে শুরু করেন। দোয়া পড়তে পড়তে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর জল্লাদ ও সরকারি প্রতিনিধিরা ফাঁসির সাক্ষী হিসেবে বইয়ে আলাদা সই করেন। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর কারাগারের ভেতরে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এরপর গোসল করানো হয়। কাফন পরিয়ে লাশ কফিনে ভরে গাড়িতে তোলা হয়। মৃতদেহ কারাগার থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন কারা তত্ত্বাবধায়ক। এরপরই লাশবাহী গাড়ি কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে ঢাকায় ও গাজীপুরে মোট ১০ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মুহম্মদ মুহসিন রেজা বলেন, ঢাকায় নিয়মিত সিডিউল মোতাবেক ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় গাজীপুর জেলা প্রশাসকের চাহিদা মোতাবেক ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে এ আদেশ কার্যকর রয়েছে। মধ্য রাতে কারাফটক দিয়ে মীর কাসেমের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে যাওয়ার সময় আগে পেছনে র্যাব-পুলিশের দুটি গাড়ি ছিল। এর মাঝে দুটি অ্যাম্বুলেন্সের একটিতে মীর কাসেমের লাশ নেয়া হয়। পুলিশের গাড়ির অগ্রগামী দলটি ঢাকা থেকে পুরো পথ বিশেষ ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করে। গাজীপুর পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদ জানান, লাশ দাফন পর্যন্ত পুলিশ সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবে। এছাড়া যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলারও প্রস্তুতি নিয়েছে তারা।
গতকাল সকালেই কাশিমপুর কারাগার ঘিরে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সন্ধ্যার দিকে কারাগারে ঢোকার মুখগুলোতে পুলিশ ব্যারিকেড বসায়। সাংবাদিক, পুলিশ, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য এবং দু-একটি সংগঠনের অল্প কিছু সদস্য ছাড়া আর কাউকে ওই এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিকালের পর থেকে একে একে কারাগারের চারপাশের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ১-এর উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মোহাম্মদ শাহজাজান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাশিমপুর কারাগার থেকে হাইওয়ে পর্যন্ত সড়কে সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেবল কারাগারের সামনে কয়েকটি খাবার ও ওষুধের দোকান খোলা রাখা হয়েছে। কারাগারের আশপাশের আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদেরও অন্য পথ ব্যবহার করে ঘুরপথে নিজেদের বাড়িতে যেতে বলা হয়। একমাত্র গণমাধ্যমের গাড়ি এবং গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া এ পথে আর কাউকে চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না বলেও জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।
গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ জানান, শুধু কাশিমপুর এলাকা নয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরো গাজীপুর জেলায় নেয়া হয়েছে। এজন্য টঙ্গী, স্টেশন রোড, বোর্ডবাজার, ভোগড়া বাইপাস মোড়, চান্দনা চৌরাস্তা, গাজীপুর শহর, রাজেন্দ্রপুর, কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে তাকে কবর দেয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয় মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ প্রশাসন। জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পর হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে তার কবর হবে এ নির্দেশনা উপর থেকে পাওয়ার পর সব ধরনের প্রস্তুতির পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়। স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জে মীর কাসেমের কবর দিতে বাধা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় সেখানে গোলযোগের আশঙ্কায় পুলিশ এসব প্রস্তুতি নিয়েছে।বিষয়টি স্বীকার করে হরিরামপুর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আবুল বাশার সবুজ বলেন, কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীর কবর হরিরামপুরে ঠেকাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ তিন শতাধিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ শনিবার দুপুর থেকেই চালা বাজারে অবস্থান নিয়েছেন। মানিকগঞ্জে তাকে দাফন করার চেষ্টা করা হলে তারা তা কঠোরভাবে প্রতিহত করবে।
দাফন হবে মানিকগঞ্জে : মীর কাসেম আলীকে মানিকগঞ্জে দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবার। শনিবার সন্ধ্যায় মীর কাসেমের সঙ্গে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এ কথা জানিয়েছেন তার স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন। তিনি বলেন, ‘তিনি (মীর কাসেম) আমাকে বলেছেন, তাকে ফাঁসির কথা জানানো হয়েছে।’ মীর কাসেম শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে আয়েশা খাতুন বলেন, শেষ মুহূর্তেও ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন তিনি। পরিবারের দাবি, মীর কাসেমের ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। মীর কাসেমের স্ত্রী জানান, মীর কাসেমের ভাই মানিকগঞ্জে একটি জমি কিনে রেখেছিলেন। সেখানেই তাকে দাফন করা হবে। আয়েশা খাতুন বলেন, পরিবার ও নিকট আত্মীয়সহ ২২ জন দেখা করতে যান। ছোট ছোট দলে ধাপে ধাপে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়। সব শেষে দেখা করেন স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছেলের বউসহ আটজন।
তারা জয়ী হবে না : একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতির মধ্যে মীর কাসেম আলীর সঙ্গে দেখা করে তার স্ত্রী বলেছেন, তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য ‘দায়ীরা’ জয়ী হবে না। প্রায় তিন ঘণ্টা শেষ সাক্ষাতের পর কারাগারের বাইরে এসে কাসেমপতœী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা ফাঁসি দিচ্ছে তারা জয়ী হবে না। এই মৃত্যু ইসলামের জন্য মৃত্যু। এই মৃত্যু শহীদের শামিল।’
কাসেমের দুই মেয়ের স্ট্যাটাস: বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করতে যাওয়ার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন মীর কাসেমের দুই মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ও তাহেরা তাসনিম।
সুমাইয়া রাবেয়া লিখেছেন: ‘আমার আব্বু নরম মনের মানুষ। প্রতি বার বক্তব্য দিতে উঠলে কেঁদে ফেলতেন। এটা সবাই জানেন। এর আগে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম তখন আব্বুর চেহারায় বিন্দুমাত্র বিচলতা দেখিনি, বরং সবার সঙ্গে হাসি-খুশি ছিলেন। তখন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আব্বু, আমাদের ভাইবোনের জন্য আল্লাহর কাছে জান্নাতের সুপারিশ করবে না? আব্বু একগাল হেসে বললেন, শুধু তোমরা না, আমার নাতি-নাতনি, বউমা, জামাই সবার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করব। আমরা সবাই হেসে দিয়েছিলাম। আজকে আবার আব্বুকে দেখতে যাচ্ছি। শেষবারের মতো। কাল আব্বু থাকবে না এ নিয়ে আমরা দুঃখিত নই। শাহাদাতের মর্যাদা কজনের ভাগ্যে জোটে? এ মৃত্যুর জন্যই তো সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। আল্লাহ আমার আব্বুকে কবুল করে নিন।’
আর এক মেয়ে তাহেরা তাসনিম লিখেছেন: ‘সবাই আমার বাবা মীর কাসেম আলীর জন্য দোয়া করবেন যেন তিনি জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা হতে পারেন! আর আমাদের, তার পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দেন এবং এ দেশ ও জাতিকে তার চলে যাওয়াতে অর্থনীতি ও দেশসেবায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে, তা কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দিন। আমিন। এমকিউ আলী পরিবার!’
মীর কাসেমের যত অপরাধ : তার বিরুদ্ধে অপহরণ, গুম, খুন ও নির্যাতনসহ ১৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচার কার্যক্রম শেষে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। পরে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের রায়ে একটি অভিযোগে ফাঁসি ও পৃথক ছয়টি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার দণ্ড দেয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার আসামির রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত।
যে অভিযোগে ফাঁসি: মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গঠন করা ১১ নাম্বার অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরদিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে আটক করে আলবদর সদস্যরা ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদররা তাকে দিনভর নির্যাতন করে। নির্মম অত্যাচারে জসিম মারা গেলে আরো পাঁচজনের সঙ্গে তাকে কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে মীর কাসেমকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয়, আপিল বিভাগও সর্বসম্মতভাবে তা বহাল রাখে।
যে সব অভিযোগে কারাদণ্ড : ১২ নাম্বার অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের নভেম্বরের কোনো একদিন চট্টগ্রামের হাজারী লেনের বাসা থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে আটক করে মীর কাসেমের নেতৃত্বাধীন আলবদর সদস্যরা। পরে জাহাঙ্গীরকে আলবদররা ছেড়ে দিলেও রঞ্জিত ও টুন্টুকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন ও পরে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য মীর কাসেমকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদ- দিলেও অপর সদস্য খালাস দেন। আপিল বিভাগও সর্বসম্মতভাবে এ অভিযোগ থেকে মীর কাসেমকে খালাস দেয়।
এছাড়া আরো ছয়টি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। দ্বিতীয় অভিযোগে লুৎফর রহমান ও সিরাজকে নির্যাতনের দায়ে ২০ বছর, তৃতীয় অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে নির্যাতনের দায়ে ৭ বছর, সপ্তম অভিযোগে সানাউল্লাহ চৌধুরী ও হাবিবুর রহমানকে নির্যাতনের দায়ে ৭ বছর, নবম অভিযোগে সৈয়দ মো. জামালউদ্দিনসহ ছয়জনকে নির্যাতনের দায়ে ৭ বছর, দশম অভিযোগে জাকারিয়া, সালাউদ্দিন, ইস্কান্দারসহ কয়েকজনকে নির্যাতনের দায়ে ৭ বছর এবং ১৪তম অভিযোগে নাসিরউদ্দিনকে নির্যাতনের দায়ে ১০ বছরের কারাদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল। এসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা হুবহু বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
এক নজরে অভিযোগ: ১. মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমরুল ইসলাম চৌধুরীকে চাকতাইঘাট থেকে অপহরণ করে। এরপর তাকে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেল, পাঁচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ২. আসামির নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়। ৩. ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর আসামির নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলার বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। ৪. ডবলমুরিং থানার সালাহউদ্দিন খানকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আলবদর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন। ৫. ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আবদুল জব্বারকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীর সামনে হাজির করা হয়। এরপর তাকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়া হয়। ৬. চট্টগ্রাম শহরের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুন-উর রশিদ নামে একজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা হয়। ৭. মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ৭-৮ জন যুবক ডবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরীসহ দুজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। ৮. ২৯ নভেম্বর রাতে নুরুল কুদ্দুসসহ চারজনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন। ৯. ২৯ নভেম্বর সৈয়দ মো. এমরানসহ ৬ জনকে অপহরণ ও নির্যাতন। ১০. আসামির নির্দেশে মো. জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরণ ও নির্যাতন। ১১. শহীদ জসিম উদ্দিনসহ ৬ জনকে অপহরণের পর নির্যাতন করা হয়। এতে জসিমসহ পাঁচজন নিহত হন এবং পরে লাশ গুম করা হয়। ১২. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ তিনজনকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। এতে দুজন নিহত হন এবং তাদের লাশ গুম করা হয়। ১৩. সুনীল কান্তিকে অপহরণ ও নির্যাতন। ১৪. নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ ও নির্যাতন।