ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

টালমাটাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:০৮:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
  • / ১৮ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পরিস্থিতি যখন ধীরে ধীরে উন্নতির পথে। দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভাণ্ডার ভারী করে তুলেছেন ঠিক তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক-পাল্টা শুল্ক আরোপ খেলা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য বাংলাদেশসহ ৭৫টিরও বেশি দেশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে পূর্বের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন। তবে চীনের বিষয়ে অনঢ় অবস্থানে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এদিকে, ভারত ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দিয়ে আসছিল। এতে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর ও কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। হঠাৎ করে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) গত বুধবার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের আদেশ জারি করে। এতে আঞ্চলিক বাণিজ্যে নয়া শঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভারতীয় বিশ্লেষকরা। ৯ এপ্রিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে এমন শঙ্কার কথা জানানো হয়।
তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। এদিকে, বাংলাদেশের জন্য নতুন খবর হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে বাণ্যিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ফের শুরু হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে দেশটি পররাষ্ট্র সচিব আসছেন ঢাকায়, তার সফরের পরপরই দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ জুনের এক আদেশ, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বা ক্লোজ-বডি ট্রাক ভারতীয় স্থল কাস্টম স্টেশন ব্যবহার করে সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের পথে পাঠানো যেত, সেটি এখন বাতিল করা হয়েছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ভারতের গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রধান এবং সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ভারত গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জন্য একতরফাভাবে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের লালমনিরহাটে চীনের সহায়তায় একটি বিমানঘাঁটি পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা এবং চিকেন নেক করিডোরের কাছে একটি কৌশলগত ঘাঁটি তৈরির প্রচেষ্টা এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত ভারতের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলতে পারে। ডব্লিউটিওর গ্যাট ১৯৯৪-এর ধারা ৫ অনুযায়ী, সব সদস্য দেশকে স্থলবেষ্টিত দেশের পণ্যের মুক্ত ট্রানজিট সুবিধা দিতে হয়। ট্রানজিটে দেরি করা, অপ্রয়োজনীয় বাধা সৃষ্টি করা কিংবা অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা নিষিদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক স্থগিত ইইউর:
শুল্কনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আকস্মিক অবস্থান পরিবর্তনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। গতকাল ইইউ ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পরিকল্পিত পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করছে। গত মাস থেকে ইউরোপের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করে ট্রাম্প প্রশাসন। এর জবাবেই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর একই হারে শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করে ইইউ। তবে নতুন শুল্কের আওতা থেকে বাদ রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বোরবন হুইস্কিকে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন বলেন, আমাদের সদস্য দেশগুলোর দৃঢ় সমর্থনের ভিত্তিতে ইইউ যে পাল্টা শুল্ক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা আমরা এখন ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখছি। আলোচনার জন্য আমরা এই সময়টুকু দিচ্ছি। তিনি আরও জানান, যদি আলোচনার ফল সন্তোষজনক না হয়, তবে আমাদের পাল্টা পদক্ষেপ কার্যকর করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইইউয়ের এই সিদ্ধান্ত কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর একটি কৌশল হতে পারে, তবে তারা নিজেদের অবস্থান থেকেও সরছে না। এই শুল্ক ইস্যু নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলোর কিছু পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিলে ইইউও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়। আর তাতেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করে। বাণিজ্য যুদ্ধ ও পাল্টা শুল্কের কারণে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এমন উত্তেজনার ফলে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলেও স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি:
ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে কোনো প্রভাব পড়েনি দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায়। অন্য দিনের মতো গতকাল বৃহস্পতিবারও এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। গতকাল বিকালে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গতকাল নেপাল ও ভুটান থেকে অন্যদিনের মতোই এসেছে বোল্ডার পাথর, সুগার মোলাসিস, অর্গানিক রংসহ অন্যান্য পণ্য। ৪৩টি পণ্যবাহী ট্রাকে এক হাজার ২৪০ টন পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল, আলু, টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য পণ্যের ২২টি ট্রাকে ৪৮৩ টন পণ্য যায় নেপালে।
শুল্ক স্থগিত, চীনের ব্যাপারে অনঢ় ট্রাম্প:
সম্প্রতি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ওপর পালটা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে চীনকে বাদ রেখে বাকি সব দেশের ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন তিনি। সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প নমনীয় হলেও চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক ১০৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্থানীয় সময় গত বুধবার ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, বিশ্বের সব দেশের ওপর শুল্ক কার্যকর করার সিদ্ধান্তে ৯০ দিনের বিরতি থাকবে। শুধু চীনের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ট্রাম্পের দাবি, ৭৫টিরও বেশি দেশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আলোচনায় বসেছে। তাই ৯০ দিনের এই বিরতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সময়ে একটি হ্রাসকৃত অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিশোধমূলক ট্যারিফ চালু থাকবে। তবে চীনের বিষয়ে ট্রাম্প জানান, সর্বশেষ ১০৪ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করে ১২৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘বিশ্ববাজারের প্রতি চীনের অসম্মানজনক আচরণের জবাবে আমরা এই পদক্ষেপ নিচ্ছি’।
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘চীন চুক্তি করতে চায়। কিন্তু ঠিক কোন পথে তা করতে হবে, তা তারা জানে না… তবে তারা এটা বুঝে নেবে। আশা করি খুব শীঘ্রই চীন বুঝবে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে ঠকিয়ে চলা আর টেকসই নয় এবং এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়’। ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ট্রাম্প অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সমস্ত দেশকে জানিয়েছিলাম, পাল্টা ব্যবস্থা না নিলে তোমরা পুরস্কৃত হবে। সুতরাং, যারা আলোচনায় আসতে চায়, আমরা তাদের কথা শুনতে প্রস্তুত।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আসছেন, আসবেন মন্ত্রীও:
প্রায় দেড় দশক পর বাংলাদেশের সঙ্গে স্থবির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে পাকিস্তান। ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংযুক্তিকে বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচের ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করেছেন। তার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার পর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পাঁচ দিনের মাথায় ঢাকায় আসবেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যে। সূত্রে জানা গেছে, আমনা বেলোচের এ সফর মূলত দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক পরামর্শ বা ফরেন সেক্রেটারি লেভেল কনসালটেশনের অংশ হিসেবে হচ্ছে। এ সফর দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় ও বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।
অপরদিকে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, আগামী ১৭ এপ্রিল ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচের সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। প্রায় ১৫ বছরের বিরতিতে অনুষ্ঠেয় এই বৈঠকে দুই দেশের সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সম্পর্কের নানা বিষয় আলোচনার সময় ঐতিহাসিক অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোও আলোচনায় আসবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার চলতি মাসেই ঢাকা সফরে আসছেন। তিনি বলেন, তাদের সফর নিশ্চিত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তার সফরের তারিখ জানাবেন। পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সব দিক নিয়েই আলোচনা করব। ইসহাক দারের এই ঢাকা সফর হবে ২০১২ সালের পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

টালমাটাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

আপলোড টাইম : ০৯:০৮:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পরিস্থিতি যখন ধীরে ধীরে উন্নতির পথে। দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভাণ্ডার ভারী করে তুলেছেন ঠিক তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক-পাল্টা শুল্ক আরোপ খেলা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য বাংলাদেশসহ ৭৫টিরও বেশি দেশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে পূর্বের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন। তবে চীনের বিষয়ে অনঢ় অবস্থানে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এদিকে, ভারত ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দিয়ে আসছিল। এতে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর ও কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। হঠাৎ করে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) গত বুধবার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের আদেশ জারি করে। এতে আঞ্চলিক বাণিজ্যে নয়া শঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভারতীয় বিশ্লেষকরা। ৯ এপ্রিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে এমন শঙ্কার কথা জানানো হয়।
তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। এদিকে, বাংলাদেশের জন্য নতুন খবর হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে বাণ্যিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ফের শুরু হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে দেশটি পররাষ্ট্র সচিব আসছেন ঢাকায়, তার সফরের পরপরই দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ জুনের এক আদেশ, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বা ক্লোজ-বডি ট্রাক ভারতীয় স্থল কাস্টম স্টেশন ব্যবহার করে সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের পথে পাঠানো যেত, সেটি এখন বাতিল করা হয়েছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ভারতের গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রধান এবং সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ভারত গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জন্য একতরফাভাবে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের লালমনিরহাটে চীনের সহায়তায় একটি বিমানঘাঁটি পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা এবং চিকেন নেক করিডোরের কাছে একটি কৌশলগত ঘাঁটি তৈরির প্রচেষ্টা এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত ভারতের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলতে পারে। ডব্লিউটিওর গ্যাট ১৯৯৪-এর ধারা ৫ অনুযায়ী, সব সদস্য দেশকে স্থলবেষ্টিত দেশের পণ্যের মুক্ত ট্রানজিট সুবিধা দিতে হয়। ট্রানজিটে দেরি করা, অপ্রয়োজনীয় বাধা সৃষ্টি করা কিংবা অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা নিষিদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক স্থগিত ইইউর:
শুল্কনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আকস্মিক অবস্থান পরিবর্তনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। গতকাল ইইউ ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পরিকল্পিত পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করছে। গত মাস থেকে ইউরোপের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করে ট্রাম্প প্রশাসন। এর জবাবেই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর একই হারে শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করে ইইউ। তবে নতুন শুল্কের আওতা থেকে বাদ রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বোরবন হুইস্কিকে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন বলেন, আমাদের সদস্য দেশগুলোর দৃঢ় সমর্থনের ভিত্তিতে ইইউ যে পাল্টা শুল্ক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা আমরা এখন ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখছি। আলোচনার জন্য আমরা এই সময়টুকু দিচ্ছি। তিনি আরও জানান, যদি আলোচনার ফল সন্তোষজনক না হয়, তবে আমাদের পাল্টা পদক্ষেপ কার্যকর করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইইউয়ের এই সিদ্ধান্ত কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর একটি কৌশল হতে পারে, তবে তারা নিজেদের অবস্থান থেকেও সরছে না। এই শুল্ক ইস্যু নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলোর কিছু পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিলে ইইউও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়। আর তাতেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করে। বাণিজ্য যুদ্ধ ও পাল্টা শুল্কের কারণে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এমন উত্তেজনার ফলে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলেও স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি:
ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে কোনো প্রভাব পড়েনি দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায়। অন্য দিনের মতো গতকাল বৃহস্পতিবারও এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। গতকাল বিকালে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গতকাল নেপাল ও ভুটান থেকে অন্যদিনের মতোই এসেছে বোল্ডার পাথর, সুগার মোলাসিস, অর্গানিক রংসহ অন্যান্য পণ্য। ৪৩টি পণ্যবাহী ট্রাকে এক হাজার ২৪০ টন পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল, আলু, টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য পণ্যের ২২টি ট্রাকে ৪৮৩ টন পণ্য যায় নেপালে।
শুল্ক স্থগিত, চীনের ব্যাপারে অনঢ় ট্রাম্প:
সম্প্রতি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ওপর পালটা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে চীনকে বাদ রেখে বাকি সব দেশের ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন তিনি। সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প নমনীয় হলেও চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক ১০৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্থানীয় সময় গত বুধবার ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, বিশ্বের সব দেশের ওপর শুল্ক কার্যকর করার সিদ্ধান্তে ৯০ দিনের বিরতি থাকবে। শুধু চীনের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ট্রাম্পের দাবি, ৭৫টিরও বেশি দেশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আলোচনায় বসেছে। তাই ৯০ দিনের এই বিরতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সময়ে একটি হ্রাসকৃত অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিশোধমূলক ট্যারিফ চালু থাকবে। তবে চীনের বিষয়ে ট্রাম্প জানান, সর্বশেষ ১০৪ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করে ১২৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘বিশ্ববাজারের প্রতি চীনের অসম্মানজনক আচরণের জবাবে আমরা এই পদক্ষেপ নিচ্ছি’।
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘চীন চুক্তি করতে চায়। কিন্তু ঠিক কোন পথে তা করতে হবে, তা তারা জানে না… তবে তারা এটা বুঝে নেবে। আশা করি খুব শীঘ্রই চীন বুঝবে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে ঠকিয়ে চলা আর টেকসই নয় এবং এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়’। ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ট্রাম্প অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সমস্ত দেশকে জানিয়েছিলাম, পাল্টা ব্যবস্থা না নিলে তোমরা পুরস্কৃত হবে। সুতরাং, যারা আলোচনায় আসতে চায়, আমরা তাদের কথা শুনতে প্রস্তুত।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আসছেন, আসবেন মন্ত্রীও:
প্রায় দেড় দশক পর বাংলাদেশের সঙ্গে স্থবির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে পাকিস্তান। ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংযুক্তিকে বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচের ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করেছেন। তার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার পর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পাঁচ দিনের মাথায় ঢাকায় আসবেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যে। সূত্রে জানা গেছে, আমনা বেলোচের এ সফর মূলত দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক পরামর্শ বা ফরেন সেক্রেটারি লেভেল কনসালটেশনের অংশ হিসেবে হচ্ছে। এ সফর দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় ও বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।
অপরদিকে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, আগামী ১৭ এপ্রিল ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচের সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। প্রায় ১৫ বছরের বিরতিতে অনুষ্ঠেয় এই বৈঠকে দুই দেশের সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সম্পর্কের নানা বিষয় আলোচনার সময় ঐতিহাসিক অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোও আলোচনায় আসবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার চলতি মাসেই ঢাকা সফরে আসছেন। তিনি বলেন, তাদের সফর নিশ্চিত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তার সফরের তারিখ জানাবেন। পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সব দিক নিয়েই আলোচনা করব। ইসহাক দারের এই ঢাকা সফর হবে ২০১২ সালের পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।