ইতিহাস কথা কয় (১ম পর্ব)-কাজল মাহমুদ
- আপলোড টাইম : ০৮:২৩:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫
- / ৯৪ বার পড়া হয়েছে
একদা নদীয়া জেলার একজন হিসেবে এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে আমার যেমন গর্ববোধ আছে, দেশ বিভাগের পর তারই অংশ হিসেবে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার একজন অধিবাসী হিসেবেও আমি গর্বিত এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড পরিচালিত সফল ‘কুষ্টিয়া যুদ্ধ’ আমার গৌরবের অংশ। একদা কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম মহকুমা মেহেরপুর নিয়েও আমার সবিশেষ ভালোলাগা আছে এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে। নীলবিদ্রোহ, রাখাল রাজা গোয়াল চৌধুরী, অন্নদামঙ্গলের ঈশ্বরী পাটনী, মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরকে ধারণ করার ইতিহাস আমাকেও গর্বিত করে বৈকি!
এসব অর্জনের মাঝে ‘মুজিবনগর সরকার’ স্বীকৃতি পেলেও আজো স্বাধীন বাংলার প্রথম অস্থায়ী রাজধানী (ভিডিয়ো লিংক : https://fb.watch/cmtLfuS-PA/) হিসেবে চুয়াডাঙ্গাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হলো না। চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম তৈরির ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেয়া হলো না। এ আক্ষেপ আমার, আমার মতো একদা বৃহত্তর কুষ্টিয়ার অন্যতম মহকুমা চুয়াডাঙ্গা তথা বর্তমানে জেলা চুয়াডাঙ্গার মহান মুক্তিযুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের গৌরবান্বিত সকল অধিবাসীর। চুয়াডাঙ্গা থেকে আনোয়ার হোসেনের সম্পাদনায় একদা প্রকাশিত ‘দৈনিক অস্থায়ী রাজধানী’ (ডিএফপি অনুমোদিত), চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ‘ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি’সহ মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনায় স্থাপনাসহ নিচে উল্লেখিত আরও তথ্য-উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও এই স্বীকৃতি অর্জন প্রয়োজন শুধুমাত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার গৌরবময় ইতিহাসকে চিরন্তন করে রাখার জন্য। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও আমাদের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?
মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস অনেক বিশাল। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে চুয়াডাঙ্গার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ও ইতিহাস আজ আমরা বিস্মৃত হতে চলেছি। মুক্তিযুদ্ধে উত্তাল মার্চ মাসের প্রতিটি দিনই ছিল চুয়াডাঙ্গার স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির অবিনশ্বর আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত। ২৫ মার্চে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর দেশের অনেক স্থান পাকবাহিনীর পদানত হলেও চুয়াডাঙ্গা তখনও মুক্তাঞ্চল হিসেবে ছিল এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার মুক্তিকামী জনতার অদম্য প্রতিরোধের কারণেই। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক ও বেসামরিক রাজনীতিবিদদের নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় গঠিত হয় ‘দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড।’ এর উপদেষ্টাদের সবাই ছিলেন বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব। যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবেই চুয়াডাঙ্গায় প্রথম গঠিত হয় বৈদেশিক যোগাযোগ (টেলিফোন ও ট্রাঙ্ককল), ডাকব্যবস্থা (ফিল্ড ডাকঘরসহ), প্রথম রেডক্রস ইউনিট, প্রথম রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম ইত্যাদি। ২৯ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা থেকেই শুরু হয় সফল ‘কুষ্টিয়া যুদ্ধ’। বলাবাহুল্য, চুয়াডাঙ্গা তখন ছিল কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম মহকুমা। চুয়াডাঙ্গা থেকে নিয়ন্ত্রিত এই যুদ্ধের মাধ্যমেই কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। ইতোমধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী বিওপিসমূহ বাঙালি ইপিআর বাহিনীর অধীনে আসে। খণ্ড খণ্ড এরকম নানা প্রতিরোধ সংগ্রাম ও যুদ্ধের কারণেই চুয়াডাঙ্গা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গর্বের ইতিহাস। বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে ৩১ মার্চ তাজউদ্দিন আহমেদ সতীর্থ ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলামের সাথে চুয়াডাঙ্গায় আসেন। তিনি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা লক্ষ করে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় নবনির্মিত সদর হাসপাতাল ভবনকে সচিবালয় হিসেবে গণ্য করে চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে মত দেন।
অনেকে শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তিই আজ এসব তথ্য-উপাত্ত (অডিও-ভিডিওসহ) থাকা সত্ত্বেও বিতর্কে না গিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়ে মূলত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবমূল্যায়নে চুয়াডাঙ্গার ভূমিকাকে অপসৃত করেন। এ বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত কয়েক বছরে ১০ এপ্রিল ‘অস্থায়ী রাজধানী দিবস’ পালনের ক্ষেত্রে। তৎকালীন সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের ভয় ছিল এই যে, এই দিবস পালনের ভেতর দিয়ে না জানি মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব ও নান্দীপাঠ বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা তাজউদ্দিন আহমেদকে ঘিরে আবর্তিত হয়। মূলত তাদের জন্যই ‘প্রথম অস্থায়ী রাজধানী’র সপক্ষে নিচের ইতিহাস আলেখ্য (তথ্য-উপাত্ত ও ভিডিও লিংকসহ) চুয়াডাঙ্গা সরেজমিন ঘুরে কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার প্রবীণ সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ ‘চুয়াডাঙ্গায় বোমা, তবু মনোবল অটুট’ শিরোনামের দীর্ঘ রিপোর্টে একাংশে লিখেছেন: “চুয়াডাঙ্গা (বাংলাদেশ) ৩ এপ্রিল। আজ দুপুরের দিকে পাকফৌজ জেট বিমান থেকে এখানে এই প্রথম বোমা ফেলে। … আমি চুয়াডাঙ্গা পৌঁছুই শুক্রবার দুপুরে। সেখানে পৌঁছতেই মুক্তিফৌজের দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের মুখ্য উপদেষ্টা ডা. আসহাব-উল হক বললেন, ‘বাংলাদেশে’র অস্থায়ী রাজধানীতে স্বাগত জানাই।…”
চুয়াডাঙ্গা সরেজমিন ঘুরে সাংবাদিক মার্টিন উলাকাট লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় যে দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন, তার অনুবাদের কিয়দংশ : “…. ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২০ মাইল পূর্বে চুয়াডাঙ্গা অবস্থিত। বাংলাদেশের এটি একটি ছোট্ট শহর। লোকেরা একে এখন বাংলাদেশের রাজধানী বলছে। এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় বস্তু হলেন লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ। ইনি পশ্চিম পকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বাসিন্দা। গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা যখন চুয়াডাঙ্গা থেকে আরও ২০ মাইল পূর্বে অবস্থিত কুষ্টিয়া শহরে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর হামলা করে, তখন তিনি ধরা পড়েন। ….চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের রাজধানী হতেও পারে, নাও হতে পারে। এ সম্পর্কে কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে না। তবে রাস্তার দুধারে সারি সারি বৃক্ষশোভিত এই ছোট্ট শহরটিতে বেসামরিক শাসন চালু রয়েছে।…”
১৪ এপ্রিল নয়াদিল্লি থেকে ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া (UPI) পরিবেশিত খবরে বলা হয় : “The proclamation, broadcast by the rebel Free Bangladesh Radio and monitored here said the capital of Bangladesh (Bengali Nation) government would be Chuadanga, a small town 10 miles from the border with India. [সূত্র : Bangladesh Genocide and World Press (Dhaka, 1974), page-45]” এই সূত্র থেকে তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরেও চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের রাজধানী উল্লেখ করা হয়। ১৬ এপ্রিল নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত দৈনিক The Hindu পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম Mujib’s Men Abandon Chuadanga, Set up new Headquarters লেখা হয় : Chuadanga (East Pakistan), April 16 : Bangla Desh forces today abandoned their headquarters at Chuadanga where, according to earlier reports the Bangla Desh Provisional Government was to have been established. An Awami League spokesman said that the liberation forces had moved to a new secret headquarters.”
তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ (হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত) পঞ্চদশ খণ্ডের পৃষ্ঠা-১৮ তে সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম বলেছেন : “… মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্যে ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনী সেখানে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। …” মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী ‘আজকের কাগজ’ (১৭ এপ্রিল ১৯৯৮) পত্রিকায় লিখেছেন : “… চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীন বাংলা মন্ত্রী পরিষদকে চুয়াডাঙ্গায় শপথ করানো হবে বলেও প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। …”
আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত ‘চুয়াডাঙ্গায় বোমাবর্ষণ’ শিরোনামে বলা হয় : “চুয়াডাঙ্গা থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, পাকফৌজ এখন তার সমস্ত শক্তি নিয়ে চুয়াডাঙ্গাকে চুরমার করে দেবার চেষ্টা করছে। শুক্রবার পাক বিমান দু’বার এসে চুয়াডাঙ্গায় প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করে। বোমায় নয়জন নিহত। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে চুয়াডাঙ্গা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। …” বাংলা একাডেমির সাবেক উপ-পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক ড. সুকুমার বিশ্বাস ‘মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী’ (মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯। পৃ.- ১৭১) গ্রন্থে লিখেছেন : “… ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘোষণা করা হয় বলে আকাশবাণীর খবরে জানা যায়। এই ঘোষণার পরপরই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো চুয়াডাঙ্গার ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালাতে থাকে।…”
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসবিদ, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মোহিত রায় (নদীয়া কাহিনী গ্রন্থের লেখক) রাজিব আহমেদ সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা দলিলপত্র’ (চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ, ১৯৯৮) ‘অবিস্মরণীয় চুয়াডাঙ্গা’য় লিখেছেন : “… চুয়াডাঙ্গার দেশপ্রাণ তরুণদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ফলেই ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা মুক্ত স্বাধীন ছিল, পেয়েছিল অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদা।…” সাপ্তাহিক বিচিত্রা-য় (৩ বৈশাখ, ১৩৮৩। পৃ.- ২৮) ইতিহাস গবেষক শ. ম. শওকত আলী লিখেছেন : “… চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাজধানী করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। …” ইতিহাস গবেষক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ‘মেহেরপুরের ইতিহাস’ (১৪০০ বঙ্গাব্দ। পৃ.- ৭২) গ্রন্থে লিখেছেন : “… ১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।” মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক, সাংবাদিক ফজলুল বারী ‘একাত্তরের আগরতলা’ (নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৯৫। পৃ.- ৩৩) গ্রন্থে লিখেছেন : “… আগরতলার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় চুয়াডাঙ্গা হবে স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দপ্তর। ….”
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গবেষক আসাদুজ্জামান আসাদ ‘একাত্তরের সন্ধানে’ গ্রন্থের চুয়াডাঙ্গা জেলা অংশে (পৃ.-৭৭Ñ৮১) লেখেন : “… এর আগে চুয়াডাঙ্গায় ‘বাংলাদেশ রেডক্রস’ ও ‘জয়বাংলা টেলিফোন’ চালু করা হয়। ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়। …” প্রোব বার্তা সংস্থার ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১ : কলকাতার স্মৃতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (ভোরের কাগজ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৪) বলা হয় : “… চুয়াডাঙ্গায় এই মন্ত্রিসভার (অস্থায়ী সরকারের) শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করার চিন্তা ছিল। কিন্তু গোপনীয়তার অভাবে পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে যায়। …” ‘স্বাধীন বাংলার প্রথম অস্থায়ী রাজধানী’ শিরোনামের এক নিবন্ধে অ্যাড. ইউনুছ আলী বলেন : “… ২রা এপ্রিল তারিখে তাজউদ্দিন আহমেদ চুয়াডাঙ্গায় উপস্থিত ছিলেন। সব আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তাকে জীবননগরের মেদিনীপুর ফাঁড়ি দিয়ে ভারতে পাঠানো হল। …”
এই দীর্ঘ লেখার আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন : “… দর্শনা থেকে গেদে পর্যন্ত রেললাইন বসিয়ে বিদেশের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন করা হয় ৮ই এপ্রিল। ঐ দিনই আমাকে কলকাতায় পাঠানো হয় বাণিজ্য আলোচনার জন্য। সঙ্গে চুয়াডাঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ ফুলে হোসেন, আমদানী ব্যবসায়ী দোস্ত মোহাম্মদ আনসারীকে সদস্য হিসেবে দেয়া হল। সেখানে আলোচনাকালে আমরা বেশ কিছু এমএনএ এবং এমপিএ একত্র মিলিত হয়ে ১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা মন্ত্রীসভা গঠন করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। স্থির হয় ১৪ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সারাবিশ্বের কাছে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া হবে এবং সাহায্য জানানো হবে। সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে ভাষণ প্রচার করা হবে।
প্রস্তুতিলগ্নে বিদেশী সাংবাদিকদের আসা-যাওয়ার মধ্যে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং অস্থায়ী রাজধানী উল্লেখে বিদেশী বেতারে সংবাদ প্রচার হবার ফলে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার কারণে অনুষ্ঠান তিন দিন পিছিয়ে ১৭ই এপ্রিল স্থির হয় এবং এখানকার সমুদয় আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা উঠিয়ে মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়ায় নেয়া হয়। অতি সন্তর্পণে ১৪ তারিখেই চুয়াডাঙ্গা থেকে সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। …” গত ১৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বয়ান থেকে : “… আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল চুয়াডাঙ্গায় গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ১৪ এপ্রিল প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করবেন। সেখানেই (চুয়াডাঙ্গাতেই) রাজধানী স্থাপন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম পরিচালনা করা হবে। আমি ঠিক করলাম, এ রাজধানীর নাম হবে ‘মুজিবনগর’।
কিন্তু একজন সহকর্মীর অসাবধানতার জন্য সেই সিদ্ধান্ত সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গার সেই নির্দিষ্ট স্থানে প্রবল বোমাবর্ষণ করে। পরে আবার খুব গোপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় চুয়াডাঙ্গা’র পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। …” চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী করার সিদ্ধান্তের কথা তাজউদ্দিন আহমেদ গোপনে ডা. আসহাব-উল হককে জানান। যুদ্ধের আগেই চুয়াডাঙ্গায় নতুন হাসপাতাল তৈরি শেষ হয়েছিল। ডা. আসহাব-উল হক সেখানে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সে খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে গেলে চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বিমান হামলার পর ফ্রান্সের টিভি চ্যানেলের ফরাসি সাংবাদিক ফিলিপ আলফঁনসি গণমাধ্যমে প্রচারিত রিপোর্টে শুরুর দিকে উল্লেখ করেন : “… শেখ মুজিবের সমর্থকরা চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে। …” (ভিডিও লিংক : https://fb.watch/cipRGLfnOY)
(দ্রষ্টব্য : আরো তথ্য-উপাত্ত প্রামাণ্য সংযোজনের মাধ্যমে লেখাটি চলমান)