ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

গাংনীর চিৎলা পাটবীজ খামারে নানা অনিয়মের অভিযোগ

যুগ্ম পরিচালকের স্বজনপ্রীতি ও টেন্ডার বাণিজ্য

প্রতিবেদক, গাংনী:
  • আপলোড টাইম : ১১:১৩:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
  • / ৫৫ বার পড়া হয়েছে

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চিৎলা ভিত্তি পাটবীজ খামারের যুগ্ম পরিচালক মোর্শেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খামারের ফলকর বাগান, পাটখড়ি ও ননসিড ধানের টেন্ডার নিয়ে এলাকায় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও স্থানীয়দের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খামারের যুগ্ম পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম টেন্ডার নীতিমালা উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতো নিয়ম তৈরি করে পছন্দের লোকজনকে টেন্ডার পাইয়ে দিচ্ছেন। এতে ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার নূর ইসলাম, নাজমুল হোসাইন ও ইমনসহ কয়েকজন জানান, চিৎলা পাটবীজ খামারে মঙ্গলবার টেন্ডার ছিল। এতে এলাকার ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা অংশগ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, দুপুর ১২টার মধ্যে শিডিউল ড্রপ করতে হবে। আমরা সেই অনুযায়ী শিডিউল ড্রপ করি। নিয়ম ছিল শিডিউল ড্রপের পর সবার উপস্থিতিতে দুপুর সাড়ে ১২টায় শিডিউল খোলা হবে। কিন্তু খামার কর্তৃপক্ষ হঠাৎ একটি নোটিশ টানিয়ে দেয় এবং জানায়, আজ আর শিডিউল খোলা হবে না, আগামীকাল (বুধবার) খোলা হবে।

নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায় কোনো শিডিউল ড্রপ হয়নি। কিন্তু জেডি মোর্শেদুল আজ শিডিউল খোলেননি, বরং চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে নিজের লোকজন দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরেও অনৈতিকভাবে শিডিউল ড্রপ করান। এরপর ফোন করে জানান, চুয়াডাঙ্গায় একটি শিডিউল ড্রপ হয়েছে। ইতিপূর্বেও তিনি এভাবে নিজের লোক দিয়ে সর্বোচ্চ দর দেখিয়ে টেন্ডার পাইয়ে দিয়েছেন, পরে শিডিউল কাটাছেঁড়া করে দাম কমিয়ে নতুন শিডিউল তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খামারের শ্রমিকদের উপদেষ্টা শফিউর রহমান ট্রমা বলেন, খামারের বর্তমান যুগ্ম পরিচালক সবসময় শেখ হাসিনার ও চুয়াডাঙ্গার এক ব্যক্তির পরিচয় দিতেন। এর আড়ালে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যান। এই খামারের বড় বড় গাছ কেটে বাড়ির ফার্নিচার তৈরির জন্য চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে গেছেন। সেখানে গরুর খামার করেছেন। গরুর খাবার হিসেবে এই খামারের ধান কাটার পর বিচালি খামারের গাড়ি ব্যবহার করে কোনো টেন্ডার ছাড়াই নিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, চুয়াডাঙ্গা থেকে নিজের আত্মীয়ের সারের দোকান থেকে নিম্নমানের সার ও কীটনাশক আনা হয়। তিনি মনে করেন, এই খামার তার পৈত্রিক সম্পত্তি। কেউ কিছু বললে তাকে চাকরি থেকে ছাটাই করা হয়। তার যোগদানের পর শ্রমিকদের কাজ কমে গেছে। শ্রমিকদের কাজে না লাগিয়ে নিম্নমানের কীটনাশক প্রয়োগ করে ফসল নষ্ট করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মোর্শেদুল ইসলাম যোগদানের পর থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ফসলের বীজ বিক্রি, টেন্ডার ছাড়া গাছ বিক্রি, গোপনে খামারের পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি, শ্রমিকদের ভুয়া-বিল তৈরি এবং টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

জানা গেছে, যুগ্ম পরিচালকের জন্য সরকার মাসিক বাসাভাড়া দিলেও তিনি সেটি ব্যবহার না করে খামারের অতিথি ভবন (রেস্ট হাউস) অবৈধভাবে বাসা হিসেবে ব্যবহার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করলে সরকারকে নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করতে হয়, কিন্তু তিনি কোনো টাকা জমা দেননি। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া সরকারকে বাবুর্চি, নিরাপত্তারক্ষী, বিদ্যুৎ ও এসি বিল বাবদ লাখ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। সরকারি গাড়িও তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মোর্শেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার অপসারণের দাবিতে খামারের আশপাশের চিৎলা, জুগিন্দা, নিত্যানন্দপুর ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামের মানুষ ইতিপূর্বে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কথা বলবেই, এটা স্বাভাবিক।’
গাছ কাটা, বিচালি নেওয়া, আত্মীয়ের দোকান থেকে নিম্নমানের সার ও কীটনাশক আনা এবং শ্রমিকদের ভুয়া বিল তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মন্তব্য করা অপ্রয়োজনীয়।’ শিডিউল ড্রপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিডিউল ড্রপ করা হলে সেখানে কিছু করার নেই, সে যদি আমার আত্মীয়ও হয়। আর সময় পার হয়ে গেলে চুয়াডাঙ্গার কর্মকর্তারা কেন শিডিউল ড্রপ করতে দিল, সেটার দায় তাদের।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

গাংনীর চিৎলা পাটবীজ খামারে নানা অনিয়মের অভিযোগ

যুগ্ম পরিচালকের স্বজনপ্রীতি ও টেন্ডার বাণিজ্য

আপলোড টাইম : ১১:১৩:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চিৎলা ভিত্তি পাটবীজ খামারের যুগ্ম পরিচালক মোর্শেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খামারের ফলকর বাগান, পাটখড়ি ও ননসিড ধানের টেন্ডার নিয়ে এলাকায় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও স্থানীয়দের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খামারের যুগ্ম পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম টেন্ডার নীতিমালা উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতো নিয়ম তৈরি করে পছন্দের লোকজনকে টেন্ডার পাইয়ে দিচ্ছেন। এতে ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার নূর ইসলাম, নাজমুল হোসাইন ও ইমনসহ কয়েকজন জানান, চিৎলা পাটবীজ খামারে মঙ্গলবার টেন্ডার ছিল। এতে এলাকার ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা অংশগ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, দুপুর ১২টার মধ্যে শিডিউল ড্রপ করতে হবে। আমরা সেই অনুযায়ী শিডিউল ড্রপ করি। নিয়ম ছিল শিডিউল ড্রপের পর সবার উপস্থিতিতে দুপুর সাড়ে ১২টায় শিডিউল খোলা হবে। কিন্তু খামার কর্তৃপক্ষ হঠাৎ একটি নোটিশ টানিয়ে দেয় এবং জানায়, আজ আর শিডিউল খোলা হবে না, আগামীকাল (বুধবার) খোলা হবে।

নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায় কোনো শিডিউল ড্রপ হয়নি। কিন্তু জেডি মোর্শেদুল আজ শিডিউল খোলেননি, বরং চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে নিজের লোকজন দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরেও অনৈতিকভাবে শিডিউল ড্রপ করান। এরপর ফোন করে জানান, চুয়াডাঙ্গায় একটি শিডিউল ড্রপ হয়েছে। ইতিপূর্বেও তিনি এভাবে নিজের লোক দিয়ে সর্বোচ্চ দর দেখিয়ে টেন্ডার পাইয়ে দিয়েছেন, পরে শিডিউল কাটাছেঁড়া করে দাম কমিয়ে নতুন শিডিউল তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খামারের শ্রমিকদের উপদেষ্টা শফিউর রহমান ট্রমা বলেন, খামারের বর্তমান যুগ্ম পরিচালক সবসময় শেখ হাসিনার ও চুয়াডাঙ্গার এক ব্যক্তির পরিচয় দিতেন। এর আড়ালে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যান। এই খামারের বড় বড় গাছ কেটে বাড়ির ফার্নিচার তৈরির জন্য চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে গেছেন। সেখানে গরুর খামার করেছেন। গরুর খাবার হিসেবে এই খামারের ধান কাটার পর বিচালি খামারের গাড়ি ব্যবহার করে কোনো টেন্ডার ছাড়াই নিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, চুয়াডাঙ্গা থেকে নিজের আত্মীয়ের সারের দোকান থেকে নিম্নমানের সার ও কীটনাশক আনা হয়। তিনি মনে করেন, এই খামার তার পৈত্রিক সম্পত্তি। কেউ কিছু বললে তাকে চাকরি থেকে ছাটাই করা হয়। তার যোগদানের পর শ্রমিকদের কাজ কমে গেছে। শ্রমিকদের কাজে না লাগিয়ে নিম্নমানের কীটনাশক প্রয়োগ করে ফসল নষ্ট করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মোর্শেদুল ইসলাম যোগদানের পর থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ফসলের বীজ বিক্রি, টেন্ডার ছাড়া গাছ বিক্রি, গোপনে খামারের পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি, শ্রমিকদের ভুয়া-বিল তৈরি এবং টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

জানা গেছে, যুগ্ম পরিচালকের জন্য সরকার মাসিক বাসাভাড়া দিলেও তিনি সেটি ব্যবহার না করে খামারের অতিথি ভবন (রেস্ট হাউস) অবৈধভাবে বাসা হিসেবে ব্যবহার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করলে সরকারকে নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করতে হয়, কিন্তু তিনি কোনো টাকা জমা দেননি। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া সরকারকে বাবুর্চি, নিরাপত্তারক্ষী, বিদ্যুৎ ও এসি বিল বাবদ লাখ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। সরকারি গাড়িও তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মোর্শেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার অপসারণের দাবিতে খামারের আশপাশের চিৎলা, জুগিন্দা, নিত্যানন্দপুর ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামের মানুষ ইতিপূর্বে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কথা বলবেই, এটা স্বাভাবিক।’
গাছ কাটা, বিচালি নেওয়া, আত্মীয়ের দোকান থেকে নিম্নমানের সার ও কীটনাশক আনা এবং শ্রমিকদের ভুয়া বিল তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মন্তব্য করা অপ্রয়োজনীয়।’ শিডিউল ড্রপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিডিউল ড্রপ করা হলে সেখানে কিছু করার নেই, সে যদি আমার আত্মীয়ও হয়। আর সময় পার হয়ে গেলে চুয়াডাঙ্গার কর্মকর্তারা কেন শিডিউল ড্রপ করতে দিল, সেটার দায় তাদের।’