পর্ব-২: দুর্নীতি ঢাকতে মনিরের স্বজনপ্রীতির কূটকৌশল
মাউশির প্রধান কার্যালয়ে থাকাকালেই ঘুষ লেনদেনের লবিং শুরু
- আপলোড টাইম : ০৮:৪৯:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
- / ৭১ বার পড়া হয়েছে
দুর্নীতি ঢাকতে মনিরের কৌশলের শেষ নেই। তদন্তে ভিন্ন ব্যাখা দিতে মনির নিয়েছেন নানা রকম কৌশল। সরোজগঞ্জে বাড়ি, দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় থাকেন বিদেশে। সেই টাকা আসে মনিরের একাউন্টে। নির্ধারিত দিনে আত্মীয়ের বাড়ির লোকজন টাকা তুলে নেন। আর মনির নিজেকে তদন্তে দেখান স্বজনের রেমিট্যান্সের আয়। অবৈধ আয় লুকাতে মনিরের একটি নয়, কৌশলের শেষ নেই। বহু প্রতিভার অধিকারী এই ঘুষতন্ত্রের গুটলে মনির নিজের স্বজন তো বটেই, স্ত্রীর স্বজনদের নামেও কিনেছেন সম্পদ-সম্পত্তি। গোপনে একাধিক ব্যবসা করছেন ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে।
যেখানে গেছেন, সেখানেই তৈরি করেছেন নিজস্ব বলয়। বর্তমানে এই মনিরুজ্জামান মনির বাগেরহাট জেলা শিক্ষা অফিসে হিসাবরক্ষক কাম ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার দুপুরেই বের হয়ে যান অফিস থেকে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে আসেন চুয়াডাঙ্গা শহরে। এরপর তার লেনদেনের দেখা সাক্ষাৎ। রাত ৯টার পর বাগান বাড়িতে বসে মদের আসর। একা নন, ঘুষে সহযোগিতাকারীরাও থাকেন এই ফুর্তিতে।
বাগেরহাটে যাওয়ার আগে মনির ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে। মনিরের পদ উচ্চমান সহকারী হলেও ক্যাশিয়ারগিরি তার দারুণ পছন্দ! সেই যোগসূত্রে সেখানেও তিনি ছিলেন ক্যাশিয়ার। কর্মস্থলে তিনি ছিলেন রীতিমতো ‘ঘুষযন্ত্র’। বা হাতে টাকা উঠলে তার ডান হাত নিমেষেই কাজ করে। ক্যাশিয়ার আর ঘুষের রসায়নে চুয়াডাঙ্গার ছেলে মনির টাকার পাহাড়ের চূড়ায়।
২০০৫ সালে দর্শনা সরকারি কলেজে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের (তৃতীয় শ্রেণি) চাকরি হয় মনিরের। পরবর্তীতে তিনি চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে বদলি হয়ে আসেন। এক/এগারোর সময়ে সারাদেশে সরকারি চাকরিজীবী সংস্কার হলে তখন তিনি ঢাকা শিক্ষা ভবনের মাউশির প্রধান কার্যালয়ে স্কুল শাখায় বদলি হন। সেখান থেকেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নির্ভরযোগ্য সিন্ডিকেট। এরপর থেকে শুধুই তার বরকতময় জীবন।
মনির ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজধানীর শিক্ষা ভবনে মাউশির প্রধান কার্যালয়ে স্কুল শাখায় চাকরি করেছেন। তখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষা ভবন থেকেই হতো। ২০১৪ সালে তা বিকেন্দ্রীকরণ করে মাউশির ৯টি অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া হয়। মনির সে সময় তার নিজের বিভাগ খুলনা আঞ্চলিক অফিসে পদায়ন নেন। প্রথমে কুষ্টিয়া তারপর খুলনা উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে বদলি হন মনির। খুলনা উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে থাকাকালে মনির আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার শিক্ষকদের তদবিরি আস্থার নাম মনির। মনির খুলনায় থাকাকালে নিয়মিতভাবেই এমপিওভুক্তি, বদলি ও গ্রেড পাইয়ে দেওয়ার কাজ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
খুলনায় চাকরিকালে সপ্তাহের ছুটির দিন মনির বের হতেন ঘুষ কালেকশনে। বিভিন্ন জেলায় নিজের গাড়িতে করে ঘুষ সংগ্রহ করে বেড়াতেন মনির। বিভিন্ন জেলার শিক্ষকদের বিভিন্ন কাজ কৌশলে আটকে রেখে তিনি ঘুষ দাবি করতেন। সে সময় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী শিক্ষক মনিরের বিরুদ্ধে মাউশি ও দুদকে অভিযোগও করেছিলেন।
এই খুলনা অফিসে থাকাকালেই মনিরের বিরুদ্ধে হয়েছিল মাউশির তদন্ত। ২০২২ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে মনিরের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের পর মাউশি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তখন মনির মাউশির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ক্যাশিয়ার। ওই বছরের ২১ ও ২২ আগস্ট মাউশির তদন্ত কমিটি মনিরের বিরুদ্ধে তদন্ত করে খুলনা গিয়ে। মাউশির তৎকালীন পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কমিটিতে ছিলেন মাউশির উপ-পরিচালক (বেসরকারি কলেজ) এনামুল হক হাওলাদার ও সহকারী পরিচালক (এইচআরএম) আশেকুল হক। তবে অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের মাধ্যমে সেই অভিযোগটিও খালাস করতে চেয়েছিলেন। তবে সেখানে মনিরে ঘাটা পড়ে। বিষয়টি যায় দুদকের নজরে। দুদক এখনো তদন্ত কার্যক্রম চালু রেখেছে বলেই জানা গেছে।
‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে মনিরের ঘুষকীর্তি, দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মাউশির খুলনা অঞ্চলের তৎকালীন উপ-পরিচালক এস এম আবদুল খালেক বলেন, ‘মনিরের কোথায় কী সম্পদ আছে, তা জানি না। মনির এতই ক্ষমতাবান, খুলনায় থাকাকালে সে আমাকেই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো।’
মনিরের বর্তমান কর্মস্থল বাগেরহাট জেলা শিক্ষা অফিসের প্রধান তথা জেলা শিক্ষা অফিসার এস এম ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমি শুনেছি মনিরের বিরুদ্ধে দুদকে একটি তদন্ত চলছে। তবে সেটার অগ্রগতি বিষয়ে জানি না। আমার এখানে আসার পর আমি নজরে রেখেছি। এখানে কোনো বাজে কাজ করার সুযোগ নেই। তবে সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে দূরে বাড়ি হওয়ায় একটু আগে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।’
এ বিষয়ে মনিরুজ্জামান মনিরের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ জন্য তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে মনিরের দ্বিতীয় স্ত্রী চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সহকারী হিসাবরক্ষক সোনিয়া খাতুন বলেন, ‘আমি মেয়ে মানুষ এতো কিছু জানা যায় না। আর জানার চেষ্টাও করিনি। আমার স্বামীর নামে কোথায় কোথায় সম্পত্তি আছে, আমি জানি না। আপনারা সাংবাদিক, ভালো করে খোঁজ নিয়ে বের করেন।’