ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

পর্ব-১: শিক্ষা অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী চুয়াডাঙ্গার মনির পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ

ঘুষের টাকায় রাজকীয় জীবন, নামে বেনামে সম্পদের পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপলোড টাইম : ০৫:৪৫:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
  • / ১০৬ বার পড়া হয়েছে


শিক্ষা অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তবে তার বিলাসী জীবন কোনো অংশে কোটিপতি ব্যবসায়ীর থেকে কম নয়। দুই বউয়ের দুটি বাড়ি। ফ্লাট-গাড়ি, বাগান বাড়ি আর পছন্দের নারী কী নেই তার। চলাফেরা করেন বিমানে। ঘুষতন্ত্রে তার যোগাযোগ অনেক উপরে। এমপিওভুক্তি, বদলি, গ্রেড পাইয়ে দেওয়া, সব কাজ এক মনিরেই সমাধান! নীচ থেকে ওপরে বিভিন্ন মহলে তার যোগাযোগ অমায়িক। খর্বকায়, তাই কেউ কেউ মিচকি হেসে কখনো ‘পিচ্চি মনির’ কখনো ‘গুটলে মনির’ নামে ডাকে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এই নামেই মনিরুজ্জামান মনিরকে চেনেন। বর্তমানে বাগেরহাটে চাকরি করলেও তার যোগাযোগ খুলনা বিভাগের ১০ জেলায়। দীর্ঘদিন মাউশির প্রধান কার্যালয়ের স্কুল শাখায় চাকরি করায় তৈরি করেছেন বড় লবিং। নামে-বেনামে, দুই স্ত্রী-স্বজনের নামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পুলিশের এমএলএসএস নুরুল ইসলামের ছেলে মনিরুজ্জামান মনিরের ঘুষের টাকায় রাজকীয় জীবনের বিচিত্র দিক। দুই স্ত্রী, দুইজনের জন্য দুটি পৃথক বাড়ি করেছেন। রাজধানী ঢাকায় মনিরের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন স্ত্রী রিমা। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের পাশে ১ হাজার ৭৮০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের দাম কোটি টাকা ছাড়াবে। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংকে রিমার নামে রয়েছে লাখ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর।

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার মুসলিমপাড়ায় হোমিওপ্যাথি কলেজের পাশে ১৬ কাঠা জমির ওপর মনিরের রয়েছে নিজস্ব একটি বাগানবাড়ি। এই বাগান বাড়িতে রাখা আছে একজন কেয়ারটেকার। স্থানীয়রা জানান, জমিসহ এ বাড়ির আনুমানিক দাম ৮০ লাখ টাকা। ওই জমির ১০ কাঠার মালিকানা করে রেখেছেন প্রথম স্ত্রীর বাবার নামে। বাকি ৬ কাঠা মনিরের নিজের নামে আছে। এ বাগানবাড়ির দক্ষিণ পাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আছে আরও দুটি প্লট। তার দামও অর্ধকোটির ওপরে। এই বাগান বাড়ির পূর্ব পাশে খানিকটা দূরে আছে আরেকটি বাড়িসহ আরেকটি প্লট। এই বাড়িসহ জমিরও আনুমানিক মূল্য হবে প্রায় ৪০ লাখ টাকার উপরে। আশেপাশের বাসিন্দারা জানান, মনিরের এই বাড়ি ছাড়াও আরও অনেক সম্পত্তি আছে।

মনিরের আরেক স্ত্রী সোনিয়া চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত। চুয়াডাঙ্গা শহরের জোলের ধারে চারতলার বাড়িতে তিনি বসবাস করেন। প্রায় ৭০ লাখ টাকা দামের ওই চারতলা বাড়িটি সোনিয়ার নামে। এই বাড়িটির পশ্চিম পাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রায় ১০ কাঠার একটি প্লট আছে। সেখানে তিনি সবজি চাষ করেন। শহরের বেলগাছি মুসলিম পাড়ায় ৫ কাঠার একটি বাগান। এই বাগানে কাঠ ও ফলের গাছ আছে। মুসলিমপাড়া মাজারের পাশেই আছে আরেকটি বাগান। শহরের নীলার মোড়েও রয়েছে ৫০ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের জমি। এছাড়াও নীলার মোড়ের পাশেই আরেকটি প্লট দুটি দোকানসহ জমি আছে। সুমিরদিয়া মাঠে রাস্তার পাশেই রয়েছে ১০ কাঠার একটি বাগান।

মনির চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় স্ত্রীর স্বজনদের নামেও একাধিক ব্যাংক হিসাব খুলেছেন বলে জানা গেছে। তবে ‘গভীর জলের মাছ’ মনির অধিকাংশ সম্পদই গড়েছেন স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে। কিন্তু সেই সব সম্পদের আশেপাশে খোঁজ নিলে সবাই বলছে গুটলে মনিরের সম্পদ। স্বজনদের নামে কিনলেও তিনি নিজেই সেসব সম্পদের প্রায়ই তদারকি করেন। এছাড়াও ১০ লাখ টাকা দিয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সোনিয়ার নামে চুয়াডাঙ্গা সমবায় নিউ মার্কেটের সামনে একটি কফি শপের ডিড করেছেন। তবে সেই কফি শপ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। এক ব্যক্তি ওই কফি শপটি চালালেও ডিড নিয়ে আছে জটিলতা। প্রথমে মনিরের নিজের নামে, পরে তার স্ত্রী ও গুঞ্জন আছে ওই ব্যক্তির নামেও ডিডটিতে অংশীদারী থাকতে পারে।

ঢাকার কালসীতে বহুতল ভবন করছেন মনিরুজ্জামান মনির। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাউশির সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে একত্রে এই বাড়িতে ইনভেস্ট করেছেন মনির। নিজেই করছেন সবকিছুর তদারকি। নিজের লোক রেখেছেন কেয়ারটেকার হিসেবে। বাড়িটির অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে কেয়ারটেকারের সাথে ইন্টোরিয়র ডিজাইনের ছদ্মবেশে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি মনিরের বিষয়টি স্বীকার করেন। আব্বাস নামের ওই কেয়ারটেকার বলেন, ‘এখানে কাজের বিষয়ে মনির স্যার আমাদের কিছু বলেননি। আপনি আগে তাকে দিয়ে ফোন করান। কাজ করতে হলে মনির স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।’ মনির স্যারের সাথে কথা হয়েছে, এমন জানালে আব্বাস বলেন, ‘আমি কথা বলে আপনাকে জানাবো।’ পরে তিনি আর কোনো যোগাযোগ করেননি।

দর্শনার পুরাতন বাজার পাড়ায় ৫ কাঠা জমির উপরে দুই ইউনিটের একটি বাড়ি আছে। সেই বাড়ির আনুমানিক বাজার মূল্যও প্রায় অর্ধকোটি টাকার ওপরে। সেটি বর্তমানে ভাড়া দেয়া আছে। প্রতিবেশীরা মনিরের মালিকানায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া দর্শনা পৌরসভায় ওই বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর মনিরুজ্জামান মনিরের নামে আছে। গুঞ্জন আছে ছোট স্ত্রী সোনিয়া খাতুনের বোনের মেয়ে রাবু নামে এক নারীর নামে ঢাকার বারিধারা ডিএইচএস এ একটি বিলাশবহুল ফ্লাট কিনেছেন মনিরুজ্জামান মনির। (আগামীকাল দেখুন ২য় পর্ব)

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

পর্ব-১: শিক্ষা অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী চুয়াডাঙ্গার মনির পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ

ঘুষের টাকায় রাজকীয় জীবন, নামে বেনামে সম্পদের পাহাড়

আপলোড টাইম : ০৫:৪৫:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫


শিক্ষা অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তবে তার বিলাসী জীবন কোনো অংশে কোটিপতি ব্যবসায়ীর থেকে কম নয়। দুই বউয়ের দুটি বাড়ি। ফ্লাট-গাড়ি, বাগান বাড়ি আর পছন্দের নারী কী নেই তার। চলাফেরা করেন বিমানে। ঘুষতন্ত্রে তার যোগাযোগ অনেক উপরে। এমপিওভুক্তি, বদলি, গ্রেড পাইয়ে দেওয়া, সব কাজ এক মনিরেই সমাধান! নীচ থেকে ওপরে বিভিন্ন মহলে তার যোগাযোগ অমায়িক। খর্বকায়, তাই কেউ কেউ মিচকি হেসে কখনো ‘পিচ্চি মনির’ কখনো ‘গুটলে মনির’ নামে ডাকে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এই নামেই মনিরুজ্জামান মনিরকে চেনেন। বর্তমানে বাগেরহাটে চাকরি করলেও তার যোগাযোগ খুলনা বিভাগের ১০ জেলায়। দীর্ঘদিন মাউশির প্রধান কার্যালয়ের স্কুল শাখায় চাকরি করায় তৈরি করেছেন বড় লবিং। নামে-বেনামে, দুই স্ত্রী-স্বজনের নামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পুলিশের এমএলএসএস নুরুল ইসলামের ছেলে মনিরুজ্জামান মনিরের ঘুষের টাকায় রাজকীয় জীবনের বিচিত্র দিক। দুই স্ত্রী, দুইজনের জন্য দুটি পৃথক বাড়ি করেছেন। রাজধানী ঢাকায় মনিরের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন স্ত্রী রিমা। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের পাশে ১ হাজার ৭৮০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের দাম কোটি টাকা ছাড়াবে। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংকে রিমার নামে রয়েছে লাখ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর।

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার মুসলিমপাড়ায় হোমিওপ্যাথি কলেজের পাশে ১৬ কাঠা জমির ওপর মনিরের রয়েছে নিজস্ব একটি বাগানবাড়ি। এই বাগান বাড়িতে রাখা আছে একজন কেয়ারটেকার। স্থানীয়রা জানান, জমিসহ এ বাড়ির আনুমানিক দাম ৮০ লাখ টাকা। ওই জমির ১০ কাঠার মালিকানা করে রেখেছেন প্রথম স্ত্রীর বাবার নামে। বাকি ৬ কাঠা মনিরের নিজের নামে আছে। এ বাগানবাড়ির দক্ষিণ পাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আছে আরও দুটি প্লট। তার দামও অর্ধকোটির ওপরে। এই বাগান বাড়ির পূর্ব পাশে খানিকটা দূরে আছে আরেকটি বাড়িসহ আরেকটি প্লট। এই বাড়িসহ জমিরও আনুমানিক মূল্য হবে প্রায় ৪০ লাখ টাকার উপরে। আশেপাশের বাসিন্দারা জানান, মনিরের এই বাড়ি ছাড়াও আরও অনেক সম্পত্তি আছে।

মনিরের আরেক স্ত্রী সোনিয়া চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত। চুয়াডাঙ্গা শহরের জোলের ধারে চারতলার বাড়িতে তিনি বসবাস করেন। প্রায় ৭০ লাখ টাকা দামের ওই চারতলা বাড়িটি সোনিয়ার নামে। এই বাড়িটির পশ্চিম পাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রায় ১০ কাঠার একটি প্লট আছে। সেখানে তিনি সবজি চাষ করেন। শহরের বেলগাছি মুসলিম পাড়ায় ৫ কাঠার একটি বাগান। এই বাগানে কাঠ ও ফলের গাছ আছে। মুসলিমপাড়া মাজারের পাশেই আছে আরেকটি বাগান। শহরের নীলার মোড়েও রয়েছে ৫০ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের জমি। এছাড়াও নীলার মোড়ের পাশেই আরেকটি প্লট দুটি দোকানসহ জমি আছে। সুমিরদিয়া মাঠে রাস্তার পাশেই রয়েছে ১০ কাঠার একটি বাগান।

মনির চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় স্ত্রীর স্বজনদের নামেও একাধিক ব্যাংক হিসাব খুলেছেন বলে জানা গেছে। তবে ‘গভীর জলের মাছ’ মনির অধিকাংশ সম্পদই গড়েছেন স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে। কিন্তু সেই সব সম্পদের আশেপাশে খোঁজ নিলে সবাই বলছে গুটলে মনিরের সম্পদ। স্বজনদের নামে কিনলেও তিনি নিজেই সেসব সম্পদের প্রায়ই তদারকি করেন। এছাড়াও ১০ লাখ টাকা দিয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সোনিয়ার নামে চুয়াডাঙ্গা সমবায় নিউ মার্কেটের সামনে একটি কফি শপের ডিড করেছেন। তবে সেই কফি শপ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। এক ব্যক্তি ওই কফি শপটি চালালেও ডিড নিয়ে আছে জটিলতা। প্রথমে মনিরের নিজের নামে, পরে তার স্ত্রী ও গুঞ্জন আছে ওই ব্যক্তির নামেও ডিডটিতে অংশীদারী থাকতে পারে।

ঢাকার কালসীতে বহুতল ভবন করছেন মনিরুজ্জামান মনির। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাউশির সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে একত্রে এই বাড়িতে ইনভেস্ট করেছেন মনির। নিজেই করছেন সবকিছুর তদারকি। নিজের লোক রেখেছেন কেয়ারটেকার হিসেবে। বাড়িটির অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে কেয়ারটেকারের সাথে ইন্টোরিয়র ডিজাইনের ছদ্মবেশে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি মনিরের বিষয়টি স্বীকার করেন। আব্বাস নামের ওই কেয়ারটেকার বলেন, ‘এখানে কাজের বিষয়ে মনির স্যার আমাদের কিছু বলেননি। আপনি আগে তাকে দিয়ে ফোন করান। কাজ করতে হলে মনির স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।’ মনির স্যারের সাথে কথা হয়েছে, এমন জানালে আব্বাস বলেন, ‘আমি কথা বলে আপনাকে জানাবো।’ পরে তিনি আর কোনো যোগাযোগ করেননি।

দর্শনার পুরাতন বাজার পাড়ায় ৫ কাঠা জমির উপরে দুই ইউনিটের একটি বাড়ি আছে। সেই বাড়ির আনুমানিক বাজার মূল্যও প্রায় অর্ধকোটি টাকার ওপরে। সেটি বর্তমানে ভাড়া দেয়া আছে। প্রতিবেশীরা মনিরের মালিকানায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া দর্শনা পৌরসভায় ওই বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর মনিরুজ্জামান মনিরের নামে আছে। গুঞ্জন আছে ছোট স্ত্রী সোনিয়া খাতুনের বোনের মেয়ে রাবু নামে এক নারীর নামে ঢাকার বারিধারা ডিএইচএস এ একটি বিলাশবহুল ফ্লাট কিনেছেন মনিরুজ্জামান মনির। (আগামীকাল দেখুন ২য় পর্ব)