জাতিকে লজ্জায় ফেলে চলে গেল শিশু আছিয়া
শোকে স্তব্ধ দেশ, বিচার দাবি
- আপলোড টাইম : ১০:৩৬:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫
- / ১৮ বার পড়া হয়েছে
চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে মাগুরায় ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার শিশু আছিয়া। গতকাল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে বিষয়টি জানানো হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে। মৃত্যুর পর শিশু আছিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি মাগুরায়। সেখানে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরে গতকাল সন্ধ্যায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতারা। এছাড়াও সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে শিশু আছিয়ার জানাজায়।
আছিয়ার মৃত্যুর খবর জানিয়ে সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া পোস্টে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে যে, মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটি গতকাল (১৩ মার্চ ২০২৫ দুপুর ১টায়) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির গতকাল সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃৎস্পন্দন ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে এবং যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে।’
মাগুরায় শোকের মাতম :
ধর্ষণ ও নির্যাতনে গুরুতর আহত ৮ বছরের শিশু আছিয়ার মরদেহ গতকাল সন্ধ্যায় মাগুরায় পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। তার মরদেহ নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। মাগুরায় মরদেহ পৌঁছানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে আছিয়ার মরদেহ শহরের নোমানী ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মানুষের ঢল নামে। বাদ এশা আছিয়ার বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সোনাইকুন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সোনাকুন্ডী সম্মিলিত ঈদগাহ ও গোরস্থান ময়দানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে শিশু আছিয়ার মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দুপুরে আছিয়ার মৃত্যুর খবর তার বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের জারিয়া গ্রামে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ এলাকাবাসী। মাগুরার বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসে আছিয়াদের বাড়িতে। পুরো এলাকায় চলছে শোকের মাতম। শিশু, কিশোর-কিশোর, নারী-পুরুষসহ নানা বয়সি মানুষের একটাই দাবি— ধর্ষকের ফাঁসি চাই, ফাঁসি।
আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার:
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, শিশুটি গতকাল দুপুর ১টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
আমাদের লজ্জা দিয়ে বিদায় নিল শিশুটি : মির্জা ফখরুল
মাগুরায় নরপশুদের নিপীড়নের শিকার শিশুটির মৃত্যুর খবরে শোক জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দুপুরে শিশুটির মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক শোক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা ওই শিশুটির ওপর দিয়ে গিয়েছিল। ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে শিশুটি জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের কতটা লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’ বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খানের পাঠানো বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, আমি তার বিদেহী রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে তিনি অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।
দেশকে কাঁদিয়ে চলে গেল শিশুটি : জামায়াত আমির
শিশুটির বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করে এবং ধর্ষকের বিচার দাবি করে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, শিশুটি ইতিহাসের করুণ সাক্ষী হয়ে দুপুর ১টার দিকে দুনিয়া ছেড়ে সারা বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে চলে গেল। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে একান্ত প্রিয় হিসেবে কবুল করুন। জান্নাতে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা মেহেরবানী করে দান করুন। শিশুটির মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার দাবি করে জামায়াত আমির বলেন, মানুষ নামের যে পশুরা তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে গিয়ে মা’সুম শিশুটির জীবনের আলো নিভিয়ে দিলো, এ পশুদের কঠিনতম ও সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। সর্বোচ্চ ৯০ দিনের ভিতরে (৯০ কর্ম দিবস নয়) এদের শাস্তি কার্যকর করতে হবে। পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিধ্বস্ত পরিবারকে কোন ভাষায় সান্ত্বনা দিব সে ভাষাটিই হারিয়ে ফেলেছি। মহান রবের দরবারে দো’য়া করি, তিনি যেন তার পিতা-মাতাসহ আপনজনদেরকে নির্বিশেষে, বিবেকবান দেশবাসীকে এ শোক সহ্য করার তাওফিক দান করেন। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন, মানুষ নামের এ প্রজাতির পশুদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। ধর্ষকদেরকে ঘৃণা করি ও বয়কট করি।
৭ দিনের মধ্যে বিচার শুরুর ঘোষণা আইন উপদেষ্টার:
মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার আগামী ৭ দিনের মধ্যে শুরু হবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা এ কথা জানান। আইন উপদেষ্টা বলেন, আছিয়া গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে সিএমএইচে মারা গেছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা শোক জানিয়েছেন। আমরা সবাই শোকার্ত, এর মধ্যে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আজকেই পোস্টমর্টেম প্রতিবেদন নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আছিয়ার মরদেহ দাফনের জন্য মাগুরায় নিয়ে যাওয়া হবে হেলিকপ্টার যোগে। আছিয়ার মরদেহ এবং তার পরিবারের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার উপস্থিত থাকবেন। তিনি সেখানে দাফন পর্যন্ত থাকবেন। ডিএনএ স্যাম্পল কালেকশন করা হয়ে গেছে, আশা করি আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাবো। এরই মধ্যে ১২-১৩ জনের ১৬১ ধারায় (দণ্ডবিধি) স্টেটমেন্ট নেয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী ৭ দিনের মধ্যে বিচার কাজ শুরু হবে। আসিফ নজরুল বলেন, আপনারা জানেন অতীতে ধর্ষণ মামলায় অব্যাহত শুনানির মাধ্যমে (বিচার শুরু হওয়ার) সাত-আট দিনের মধ্যে বিচার কাজ শেষ হওয়ার নজির আছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা যদি ৭ দিনের মধ্যে বিচার কাজ শুরু করতে পারি, আমাদের বিচারকরা সর্বোচ্চ দ্রুততার সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার করতে পারবেন। কারণ এখানে পারিপার্শ্বিক এত সাক্ষ্য রয়েছে, ডিএনএ টেস্ট পাওয়া যাবে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে, ফলে আমরা আশা করছি খুব দ্রুত সময়ে এই মামলার বিচার হবে। ইনশাআল্লাহ দোষী সাব্যস্ত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। তিনি বলেন, তবে এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে যারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়, আপনারা তাদের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে কোনো নৈরাজ্য আমরা বরদাস্ত করব না। আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন। অবশ্যই আমরা সেই ভুলত্রুটির রেসপন্স করব। জবাবদিহি নিশ্চিত করব। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, আমাদের এ বিষয়ে এখন কোনো ভুল নেই। চেষ্টা করব ভবিষ্যতেও কোনো ভুল হলে সেটি সংশোধন করার জন্য।
পুরো বাংলাদেশ লজ্জিত : হাসনাত-সারজিস
শিশুটির মৃত্যুর সংবাদে দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মৃত্যুর সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে সোশ্যাল মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিশুটির মৃত্যুর সংবাদে নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। তারা উভয়েই একই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তারা স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমাদের বোন আর নেই। তার ধর্ষণের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্ষকদের শাস্তির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক। বিচারহীনতা, বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে যে ধ্বংসাবশেষ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, শিশুটির ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মাধ্যমে সেই বিচার ব্যবস্থা আবার জেগে উঠুক। পুরো বাংলাদেশ বোনটির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত। গত ৫ মার্চ শিশুটি মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। ওই ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন শিশুটির মা।