প্রতিশোধের হাতিয়ার ‘মব’
- আপলোড টাইম : ০৯:০১:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫
- / ৬২ বার পড়া হয়েছে
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ‘মব’ ও ‘মব জাস্টিস’ শব্দগুলো নতুন করে আলোচনায়। দেশে বেশকিছু মব জাস্টিসের ঘটনা এরই মধ্যে ঘটেছে। মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছে নারী-শিশু, ছাত্র, পুলিশ, শিক্ষক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মব জাস্টিস থেকে রক্ষা পায়নি বিদেশিরাও। বিভিন্ন সময়ে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি, সংঘবদ্ধভাবে হামলা; এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে।
তবে মব জাস্টিস ও মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মব’ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ফ্যাসিবাদদের পরিকল্পিত উসকানি। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় কিছু ব্যক্তির ইন্ধন, কখনো কখনো পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও কোনো পদক্ষেপ নিতে অনীহার কারণেই সংঘবদ্ধ পিটুনির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুত মব জাস্টিস বন্ধ করা না গেলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। চলতি বছর দেশে মব জাস্টিসের নামে বেশকিছু সংঘবদ্ধ পিটুনির ঘটনা ঘটে। এতে মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন মানুষ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দলবদ্ধ পিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় বেড়েছে। আর দলবদ্ধ পিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে রাজধানী ঢাকায়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংঘবদ্ধ পিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৬ জন। এ মাসে সংঘবদ্ধ পিটুনিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৭টি। আসকের তথ্যানুযায়ী ২০২৪ সালে সারা দেশে মারা যায় ১৪৬ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন এবং ২০২০ সালে মারা যায় ৩৫ জন। অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন’র তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি মাসে দলবদ্ধ পিটুনিতে নিহত হয় ২১ জন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মব জাস্টিসের নামে হত্যার ঘটনার কোনো তথ্য এসব সংগঠনের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে মবের শিকার হয়ে মৃত্যু হয় সাতজনের। মার্চের প্রথম ৪ দিনে মব জাস্টিসের নামে মারা যান দুজন।
শুধু দেশের নাগরিক কিংবা আওয়ামী সরকারের দোসররা মবের শিকার হয়েছেন তা নয়, বাদ যায়নি বিদেশি নাগরিকও। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিয়মিত সংঘটিত হচ্ছে মব সৃষ্টির মতো অপরাধ। অনেকটা নিরাপত্তাহীনতা ও উদ্বেগে দিন কাটছে দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদেরও। গত মঙ্গলবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ইরানের নাগরিক মোহাম্মদ আহমদ (৭৪) ও তার নাতি মো. মেহেদীকে (১৮) ‘মব’ তৈরি করে মারধরের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ দুই বিদেশি নাগরিককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে জানা যায়, দুপুরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিদেশি মুদ্রা বদলে বাংলাদেশি টাকা নিতে একটি প্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন ইরানের ওই দুই নাগরিক। ওইসময় সেখানে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের মুদ্রা বিনিময় নিয়ে তর্ক হয়। এর জেরে ইরানের দুই নাগরিককে ছিনতাইকারী বলে পরিকল্পিতভাবে ‘মব’ সৃষ্টি করা হয়।
দেশে পরিকল্পিতভাবে মব সৃষ্টির পেছনে পতিত ফ্যাসিবাদের ইন্ধন রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গত সোমবার রাত ১০টায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় ডাকাতির গুজব ছড়িয়ে দুই জামায়াত কর্মী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে গুলি ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই ঘটনায় গুলিতে আরও পাঁচজন আহত হয়েছেন। মসজিদে মাইকিং করে ডাকাত সন্দেহে দুই জামায়াত কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নজরুল ইসলাম মানিককে দায়ী করেছেন স্থানীয়রা। মূলত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশজুড়ে বড় আকারে ‘মব জাস্টিস’ শুরু হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই ছাত্রহত্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি জড়িত থাকায় সরকার পতনে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে তারা। এ সুযোগে হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। এতে প্রাথমিক অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে মব জাস্টিস আমজনতার আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাংলাদেশে এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। সেটা কথিত চোর-ডাকাতকে পিটুনি দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার বিদেশি নাগরিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা, কোথাও কোথাও পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যখন ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখনই জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চায়- সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা প্রয়োজন। তা না হলে এ দুর্বল পুলিশি ব্যবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এর আগেই তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে জননিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ঢাকা মহানগর এলাকায় পুলিশি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ডিএমপিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত চেকপোস্ট ও টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাড়াতে মহানগরীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ডিএমপির ৬৬৭টি টহল টিম ও ৭১টি চেকপোস্ট পরিচালনা করেছে। ডিএমপির টহল টিমের পাশাপাশি মহানগরীর বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ স্থানে দুই পালায় সিটিটিসির ১৪টি, তিন পালায় অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) ১২টি এবং ডিএমপির সঙ্গে রাতে র্যাবের ১০টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া ডিএমপির সঙ্গে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট এপিবিএন ২০টি চেকপোস্ট পরিচালনা করে।
অন্যদিকে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে মানুষ বেপরোয়া হয়ে গেছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্য থেকে পুলিশের ভয় কেটে গেছে। পুলিশ টহলে গেলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে দ্বিধা করছে না। এতে পুলিশ ম্যারাথন টহলে ভয় পাচ্ছে। যাদের টহলে পাঠানো হচ্ছে, তারা টহল না দিয়ে সড়কের এক পাশে বসে থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) ফয়সল হাসান জানান, মবের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে সরকার বদ্ধপরিকর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ মর্মে সবাইকে সতর্ক করছে যে- কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়।
মব সৃষ্টির পর তা জনগণ রুখে না দেওয়ার কারণ কী- এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেন, এখন একটি ঘটনা ঘটলে ৫ মিনিটের মধ্যে সেটি ভাইরাল হয়ে যায়। আগে একটি ঘটনা ঘটলে ১০ জন মানুষ এগিয়ে আসত, প্রতিরোধের চেষ্টা করত। কিন্তু এখন মোবাইলে ভিডিও করায় ব্যস্ত থাকে। তাই সবাইকে অনুরোধ করি, আসেন সবাই প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং একটি মানুষ বিপদে পড়লে এগিয়ে যাই। সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখার জন্য সবাইকেই কাজ করতে হবে। ছিনতাইকারী সন্দেহে কাউকে আটক করা হলেও আইন হাতে তুলে নেবেন না। প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি অপরাধীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেবেন।
‘মব জাস্টিসের’ প্রবণতা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এটা (মব জাস্টিস) বন্ধে ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অতীতে দলীয় সরকারের সময়ও মব জাস্টিস ও মোরাল পুলিশিংয়ের ঘটনা ঘটত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন পূর্ণ উদ্যমে নেমে যাবে, তখন এ সমস্যাটার মাত্রা কমে আসবে। কেউ মব জাস্টিসের মুখোমুখি হলে সরকার তার পাশে দাঁড়াবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণে আসবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার উত্তরণে আরেকটু সময় লেগে যাচ্ছে। কোন ঘটনা কোন কারণে ঘটছে, সেটার ব্যাখ্যা অনেক রকমের থাকে। কিন্তু যে ঘটনার সত্যতা পাচ্ছে, সেটা সরকার তুলে ধরছে।