চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে ইটভাটা মালিকদের মানববন্ধন ও স্মারকলিপি পেশ
দাবি না মানলে বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা
- আপলোড টাইম : ১০:০৪:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫
- / ৬০ বার পড়া হয়েছে
চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে প্রশাসনের অভিযানে ইটভাটা বন্ধের প্রতিবাদে এবং ইটভাটা চালু রাখার দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে ইটভাটা মালিক সমিতিগুলো। গতকাল মঙ্গলবার জেলা দুটির সকল উপজেলায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। ইটভাটা মালিকরা দাবি করছেন, ইটভাটা শিল্প দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বর্তমান আইন ও প্রশাসনিক অভিযানের কারণে অনেক বৈধ ইটভাটা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা হাজারো শ্রমিকের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে। তারা ইটভাটাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা, দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন, পরিবেশ আইন সংশোধন এবং সরকারি অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি জানিয়েছেন। বক্তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া না হয়, তাহলে তারা আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হবেন।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ইটভাটা বন্ধের প্রতিবাদ ও ২০১৩ সালের ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দাবিতে আলমডাঙ্গায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান করেছে ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা। গতকাল বেলা ১১টায় উপজেলা মঞ্চের সামনে থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন আলমডাঙ্গা ইটভাটা মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ হেলাল মিয়া, সহিদুদ্যোজা ক্যাবল, পাপন মিয়া, সেলিম ব্রিকসের ম্যানেজারসহ আরও অনেকে। তারা ইউএনও’র মাধ্যমে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নিকট স্মারকলিপি পাঠান।
বক্তারা বলেন, ‘আমরা গত ৩৫-৪০ বছর ধরে প্রতিকূলতার মধ্যেও ইটভাটা ব্যবসা পরিচালনা করছি এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবদান রাখছি। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব ‘জিগজ্যাগ’ প্রযুক্তির ভাটা স্থাপন করেছি, যা জ্বালানি সাশ্রয়ী ও দূষণ কমিয়ে আনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ইটভাটা থেকে বর্তমানে মাত্র ৫-১০% বায়ুদূষণ হয়, যেখানে যানবাহনের কালো ধোঁয়া ৫০% এবং জৈব বস্তু পোড়ানোর কারণে ৪০% দূষণ সৃষ্টি হয়।’
তারা আরও জানান, এই শিল্পে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করে, যা ২ কোটি মানুষের জীবিকা নির্বাহের সাথে সরাসরি জড়িত। এছাড়া প্রতিটি ইটভাটার বিপরীতে প্রায় ১ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ইটভাটা বন্ধ হলে এসব ঋণ অনাদায়ী থেকে যাবে এবং হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে সরকার।
তারা দাবি করেন, ‘আমরা ক্ষতিকারক চিমনি প্রযুক্তির ভাটা (ড্রাম চিমনি, ফিক্সড চিমনি, কাঠ পোড়ানো ইটভাটা) বন্ধের বিষয়ে একমত। তবে বৈধভাবে পরিচালিত জিগজ্যাগ ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যা অনৈতিক। সরকারকে বিভ্রান্ত করে একটি মহল ইট শিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। আমরা জিগজ্যাগ ইটভাটা পরিচালনায় স্পষ্ট নীতিমালা ও অনুদানের ব্যবস্থা চাই।’
তাদের দাবি: ১. ২০১৩ ও ২০১৯ সালের ইটভাটা আইন সংশোধন করে জিগজ্যাগ ভাটার অনুমোদনের জটিলতা দূর করতে হবে। ২. জিগজ্যাগ ভাটায় হয়রানি বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যাবে না, অন্যথায় ভ্যাট ও ট্যাক্স পরিশোধ বন্ধ করা হবে। ৩. সরকার যদি কোনো ইটভাটা বন্ধ করে, তবে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৪. মাটি কাটার জন্য জেলা প্রশাসকের প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার বিধান বাতিল করতে হবে। ৫. ইটভাটাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
এদিকে, দামুড়হুদায়ও একই দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির পূর্বঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা সাড়ে ১১টায় জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়। বিক্ষোভ শেষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মমতাজ মহলের মাধ্যমে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে সাত দফা দাবি উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল-জিগজ্যাগ ইটভাটার অনুমোদন জটিলতা দূর করা, হয়রানি বন্ধ করা, ক্ষতিপূরণ ছাড়া কোনো ভাটা বন্ধ না করা, মাটি কাটার অনুমতির বিধান বাতিল এবং ইটভাটাকে শিল্প ঘোষণা করা।
সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দীন শান্তি, সহসভাপতি ইকবাল হোসেন টিটু, সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন মিয়া, নির্বাহী সদস্য আব্দুল মালেক, হাজি আব্দুল কাদিরসহ আরও অনেকে। সমাবেশে জানানো হয়, বর্তমানে দামুড়হুদার ২৯টি ইটভাটার মধ্যে ২৭টি চালু রয়েছে, যার বেশিরভাগই অবৈধ বলে জানা গেছে। তবে যুগের পর যুগ এসব ভাটা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও, সরকার এখন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অন্যদিকে, জীবননগর উপজেলায়ও ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিল শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পিয়াস ব্রিকসের মালিক আকুল হোসেন, খান ব্রিকসের মালিক আজিম খান, মা-বাবা ব্রিকসের মালিক শাহজাহান আলী, এনবিএম ব্রিকসের মালিক নেসার উদ্দিন টুটুল, অনিক ব্রিকসের মালিক হায়দার আলীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
তারা দাবি করেন, ‘সরকার ইটভাটা শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে নীতিমালা সহজ করবে এবং লাইসেন্স পেতে জটিলতা দূর করবে। অন্যথায় ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।’
এদিকে, মেহেরপুরের তিন উপজেলায় প্রশাসনের অভিযানের ফলে ইটভাটা বন্ধের প্রতিবাদে ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন। মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। ইটভাটা মালিকরা দাবি করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত এসব ভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের ফলে মালিক ও শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। তারা সরকারের কাছে ইটভাটাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা, দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন এবং নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে ইটভাটা পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার দাবি জানান।
মেহেরপুর সদর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতি প্রশাসনের অভিযানের প্রতিবাদ এবং ইটভাটা চালু রাখার দাবিতে গতকাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাইরুল ইসলামের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। সমিতির পক্ষ থেকে ৭টি দাবি উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জিগজ্যাগ ইটভাটার লাইসেন্স প্রদান ও দূরত্ব সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করা। ইটভাটায় প্রশাসনিক হয়রানি ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বন্ধ করা। ইটভাটা বন্ধ করলে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মাটি কাটার জন্য ডিসির অনুমতির বিধান বাতিল করা। ইটভাটাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করা। স্মারকলিপি প্রদানকালে সমিতির সভাপতি এম এ নাঈম, সাধারণ সম্পাদক মিলন খান, রাশেদুল ইসলাম ইরানী, জাহাঙ্গীরসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও, মুজিবনগর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতি একই দাবিতে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পলাশ মণ্ডলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করে। মানববন্ধনে দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা বলেন, ইটভাটা শিল্প দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কিন্তু এখনো এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা নেই। তারা সরকারের কাছে ইটভাটাকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি এবং ইনভাটা বন্ধের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান। সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাসমিউল ইসলাম সজলসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে, গাংনীতে প্রশাসনের অভিযানের প্রতিবাদে এবং ইটভাটা চালু রাখার দাবিতে ইটভাটা মালিক সমিতি বিক্ষোভ মিছিল করে এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। গাংনীতে ৫৫টি ইটভাটা রয়েছে, যেখানে হাজারো শ্রমিক কাজ করেন। বক্তারা বলেন, ভাটাগুলো দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বিভিন্ন খাতে কর ও রাজস্ব প্রদান করলেও, ২০১৩ সালের পরিবেশ আইনের কারণে এবার অধিকাংশ ভাটাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মালিকরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন এবং শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাবেন।
সমিতির সভাপতি এনামুল হক, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক, সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো, বামন্দী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়াল বিশ্বাসসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।