৭ বছর পর প্রথম বড় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া
বিএনপির বর্ধিত সভায় নির্বাচনের প্রস্তুতির বার্তা
চুয়াডাঙ্গা জেলা-উপজেলা ও পৌর বিএনপির সভাপতি-সেক্রেটারিদের অংশগ্রহণ
- আপলোড টাইম : ০৮:১০:৩৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ২৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির এবারের বর্ধিত সভা বিশেষ অর্থ বহন করছে বলে মনে করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। প্রায় ৭ বছর পর বর্ধিত সভার আয়োজন করেছে দলটি। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সভার স্থানটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা। জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজন। যেখানে সারা দেশ থেকে ৪ হাজারের বেশি প্রতিনিধি সমবেত হন। নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বিএনপি যে সংসদীয় রাজনীতির দল এবং তাদের ভাবনায় যে নির্বাচনমুখী রাজনীতি, সেই বার্তা দেয়া হলো সংসদভবন এলাকায় সভা করে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে শুরু হয় বিএনপির বর্ধিত সভা।
এদিকে, অনুষ্ঠিত এই বর্ধিত সভায় চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। বর্ধিত সভায় চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির উপ-কোষাধ্যক্ষ মাহামুদ হাসান খান বাবু, চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান লিপ্টন, চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মনি, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক পল্টু, আলমডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আক্তার হোসেন জোয়ার্দ্দার, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রোকন, আলমডাঙ্গা পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজুর রহমান পিণ্টু, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ওল্টু, জীবননগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন খান খোকন, সাধারণ শাহাজাহান আলী, জীবননগর পৌর বিএনপির সভাপতি শাহজাহান কবীর, সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান ডাবলু, দামুড়হুদা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল হাসান তনু, দর্শনা থানা বিএনপির সভাপতি খাজা আবুল হাসনাত ও সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ আলী।
বিএনপির বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর মধ্যদিয়ে ৭ বছর পর বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বক্তব্য দিলেন তিনি। খালেদা জিয়া বর্তমানে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তিনি দ্রুত নির্বাচনের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি দলকে ঐকবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য নেতা-কর্মীদের তাগিদ দেন। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আশ্বাস পাওয়ার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশব্যাপী সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে বিএনপি। বর্ধিত সভায় শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূল প্রতিনিধিদের বক্তব্যের মূল সুর ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক।
এছাড়া, এক সময়ের মিত্র থেকে বর্তমানে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা জামায়াতে ইসলামী, অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীদের দল গঠনসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলার নেতাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন মন্তব্য, পরামর্শ ও প্রশ্ন তুলে ধরেন। সন্ধ্যার পর জেলা পর্যায়ের নেতাদের কথা বলার পর্ব শুরু হয়।
নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনাই মুখ্য:
দীর্ঘদিন পর এই সভা বিএনপি নেতাদের মিলনমেলায় পরিণত হয় বলে দলটির নেতারা বলছেন। স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে থানা, উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি পর্যন্ত ইউনিটগুলোর শীর্ষ দুই পদে থাকা নেতারা যোগ দেন সেখানে। তারা বলছেন, এই বর্ধিত সভা থেকে সারা দেশের দলটির নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হবে। তাদের দলের ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি সামনে রেখে দলটি যাত্রা শুরু করবে নির্বাচনের পথে। রংপুর বিভাগের একটি জেলার বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে যে কোনো নির্বাচনের বিপক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট। অন্য কোনো প্রচেষ্টা হলে রুখে দিতে চান তারা। ‘নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে এখন দলের অবস্থান কী, মাঠ পর্যায়ে দলটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত,’ বলছিলেন রাজশাহী বিভাগের একটি জেলার সভাপতি। এছাড়া, একদিন পরই যাত্রা শুরু করতে যাওয়া নতুন দলের ব্যাপারেও জিজ্ঞাসা আছে অনেকের। তবে সব তৎপরতাকে নির্বাচন অভিমুখে রেখেই কর্মকাণ্ড সাজানোর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বারবার, বলছিলেন নেতারা।
শীর্ষ নেতারা যা বলছেন:
গতকাল বেলা ১১টায় বিএনপি’র বর্ধিত সভা শুরু হলে এতে স্বাগত বক্তব্য দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের সুনাম ক্ষুণ্ন করে এমন কিছু না করতে নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানান তিনি। উদ্বোধনী বক্তব্যে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষতাই হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতিমধ্যেই জনমনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।’ নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তিনি অন্তবর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে সেটি সারা দেশে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তারেক রহমান বলেন, ‘স্থানীয় নিবাচন হলে সেটি হবে সারা দেশের পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া যা গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাবিরোধী। তাদেরকে পুনর্বাসনের এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না।’ অন্তর্বতী সরকারকে স্থানীয় নির্বাচন থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণার কথা বলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য জনমনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করলেও কোনো কোনো উপদেষ্টার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য মানুষের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তার মতে, সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচন এসব ইস্যু নিয়ে জনগণের সামনে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে।
তারেক রহমান আরোও বলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ আজ এক ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ভুলে বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকে একযোগে দেশ ও জাতির স্বার্থে আমাদের কাজ করতে হবে।’ তিনি বলেন, দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষতাই হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতিমধ্যেই জনমনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আরও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সভায় তারেক রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য জনমনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করলেও এ নিয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য-মন্তব্য স্বাধীনতাপ্রিয়, গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য হতাশার কারণ হয়ে উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত সমর্থন থাকলেও সরকার এখনো নিজেদের কর্মপরিকল্পনার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারছে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সারা দেশে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি বেড়েই চলেছে। বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকার যেখানে দেশের বাজার পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার পরিচয় দিতে পারছে না, সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে কেন দেশের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করতে চাইছে, এটি জনগণের কাছে বোধগম্য নয়।
তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্রকামী জনগণ মনে করে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হলে তা হবে পলাতক-স্বৈরাচারের দোসরদের সারা দেশে পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া, যা হবে গণ-অঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাবিরোধী। গণহত্যাকারী, টাকা পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ, মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না। বিএনপি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল জনরায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে গণহত্যাকারী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সারা দেশে গণহত্যাকারীদের দোসর, মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসনের স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা থেকে সরে আসুন। অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আগামী দিনের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে কথা বলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, মাফিয়াপ্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর এখন পর্যন্ত ১৬-১৭টি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সব নতুন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে স্বাগত জানায়। তবে দলগুলোকে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণ কিংবা বর্জনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে জনগণ। সুতরাং প্রতিটি দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সবার আগে নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
সাত বছরে প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খালেদা জিয়া যা বললেন:
বিএনপি’র সর্বশেষ বর্ধিত সভাটি হয়েছিল ২০১৮ সালে চৌঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি হোটেলে। তাতে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার চার দিনের মাথায় আটই ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে। তারপর এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখলেন তিনি। বক্তব্যে খালেদা জিয়া, সরকারকে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘দেশ আজ এক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা রাষ্ট্র মেরামতের নূন্যতম সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা।’ আগামী নির্বাচনে সাফল্যের জন্য দলের নেতাকর্মীদের ঐকবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আপনাদের এত দিনের সংগ্রাম- আত্মত্যাগ বিফলে যায়।’