জ্বালানি দুর্ভিক্ষের পথে দেশ
- আপলোড টাইম : ০৮:০৫:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ৩০ বার পড়া হয়েছে
শিল্প খাতে গ্যাসের দাম দেড়গুণ বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। এখন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে বিনিয়োগ কমবে, চাপে পড়বেন উদ্যোক্তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশ ধীরে ধীরে জ্বালানি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। তারা বলেন, জ্বালানি সংকটে গেল ২ বছরে । ৪০ শতাংশ কারখানায় জেনারেটর নির্ভরতা। বেড়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে উৎপাদনের। দেশের অর্থনীতি ধরে রাখতে হলে গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে কমানো প্রয়োজন। গতকাল রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘জ্বালানি সহজলভ্যতায় নীতি এবং শিল্প প্রতিযোগিতায় প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ব্যবসায়ীরা অভিযাগ করে বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিল্প খাতকে টিকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টা দৃশ্যমান নয়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ বলেন, এখনকার চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একইসঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে। আমদানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি লাগবে। তিনি আরও বলেন, আবার গ্যাসের দাম বাড়লে অনেক শিল্প বন্ধ হবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেছেন, গত ১৫ বছরের নতুন কূপ খননের জন্য তেমন কিছুই খরচ হয়নি, তৈরি হয়নি নতুন কোনো নীতিমালাও। যা দেশের গ্যাস সংকটের অন্যতম কারণ। এলএনজি আমদানির চেয়ে কম খরচে দেশে অনুসন্ধান করা সম্ভব ছিল। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ১১ টাকা ৫৮ পয়সার গ্যাস বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ওই সময় শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পর থেকেই গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আরও খারাপ হয়। পরবর্তী সময়ে যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের আগে যে শিল্প ইউনিটে গ্যাসের বিল ২ কোটি ১০ টাকা ছিল, দাম বাড়ানোর পর সেটি ৫ কোটি ২৫ লাখ হয়। প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর হলে সেটি বেড়ে হবে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার মতো দেশের কোনো পরিস্থিতি নেই। তাই তিনি সরকারকে এ বিষয়ে আরও সময় চাওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, শুধু রাজনীতিবিদ ও আমলারা প্রস্তুত বললেও বাংলাদেশ উত্তরণের পর্যায়ে নেই।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্পকারখানা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি; এনবিআরেরও অন্য সমস্যা আছে। আরেকদিকে গ্যাসের দাম বাড়তি তারপরও চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছে না সরকার। আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, সরকার গ্যাসের দাম নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ; আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতি ধরে রাখতে হলে গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে কমানো দরকার।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের বর্তমান দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ায় জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল বিগত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনো কমিশন খাচ্ছে। দাম কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না। মূলত আমরা ফেঁসে গেছি। তিনি বলেন, কিছু ব্যাংককে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে টাকা দেওয়া হলেও শিল্প টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ নেই। ব্যাংকঋণের সুদ হার ১৮ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি মূলধন অর্ধেক কমে গেছে। বিটিএমএ আরো বলেন, দেশে এত চিনিকল থাকতে পাকিস্তান থেকে চিনি আমদানি হচ্ছে, এটা লজ্জাজনক; এই আমদানির কারণে কিন্তু কর্মসংস্থান হবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে বিপদ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোথায় বিনিয়োগ করবেন সেটি তারাই নির্ধারণ করবেন। বাংলাদেশে আসার জন্য কেউ বসে নেই। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনা সেটা দেখলে মনে হয় অর্থনীতি ও শিল্পকে কীভাবে মারা যায় তার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গ্যাস নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ কখনোই জ্বালানি সংকটের বাইরে ছিল না। তবে বর্তমানে এটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ বছরের দিকে দেশে ২ হাজার ৮০০ এমএফসিএফ গ্যাস উৎপাদন হলেও বর্তমানে তা এক হাজার ৯০০ এমএফসিএফে নেমে এসেছে। এতে যারা বেশি সমস্যায় পড়বে, তাদের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে বড় পরিসরে পরিকল্পনা দরকার।
ইউরোচেমের সভাপতি নুরিয়া লোপেজ বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি বৈষম্যমূলক। এটি হলে কেউ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে না। তাতে এলডিসি থেকে উত্তরণ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এনার্জি বাজার উন্মুক্ত করে দেন। ইউরোপীয় কোম্পানি বিনিয়োগ করতে এখানে আগ্রহী। প্রসঙ্গত, গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে পুরোনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথাও বলা হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আমলে নিয়ে বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) শুনানি ডেকেছে বিইআরসি।