ইপেপার । আজ সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫

বিপরীতমুখী অবস্থানে বিএনপি-জামায়াত

নির্বাচন ইস্যুতে বিরোধ বাড়ছে

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৩৮:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • / ৩০ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:

বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না। অন্যদিকে জামায়াতের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। দলটি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চায় না। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে চায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন। জামায়াতের সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিরও পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে বিএনপি। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত ডিসেম্বরে নির্বাচনের আশ্বাসে ভরসা বা বিশ্বাস রাখতে চায় না বিএনপি। সে কারণে নির্বাচনের চাপ অব্যাহত রাখতে তারা মাঠের কর্মসূচি নিয়েছেন। দলটির নেতারা ধারণা করছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যে নতুন দল গঠন করছে, এর পেছনে সরকারের একটা অংশের সমর্থন রয়েছে। আর সে কারণে তারা মনে করেন, সরকারের ভিতরে কারও কারও নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা থাকতে পারে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের সময় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না বিএনপি।

এদিকে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের মিত্র থেকে বিপরীত দুই মেরুতে পৌঁছেছে বিএনপি ও জামায়াত । নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে দুটি দলের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। এই মুহূর্তে অন্যতম দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাড়তে পারে জটিলতা। আবার বিএনপি নেতাদের শঙ্কা; দেশে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ও সংস্কার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারের আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার ওপর। অতীতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করা দুই রাজনৈতিক মিত্র নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও বিরোধে নেমেছে। বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চায়। দলটি বলছে, নির্বাচিত সরকার এসে সংস্কার করবে। অন্যদিকে জামায়াত নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার চায় এবং সংস্কার বাস্তবায়নে নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চায়। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, দেশে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে ‘টালবাহানা’ শুরু হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে নেতারা দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছেন । হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করছেন বিএনপির অনেক নেতা।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ যেখানে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা (নির্বাচন কমিশনকে) পরিষ্কার বলেছি ‘নো ইলেকশন উইদাউট রিফর্মস (সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়)।’ সংস্কারের জন্য জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সময় দিতে প্রস্তুত জানিয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ করার জন্য যে সংস্কার ন্যূনতম প্রয়োজন, তার জন্য যতটা যৌক্তিক সময় প্রয়োজন হবে, জামায়াতে ইসলামী সেই সময়টা দিতে প্রস্তুত। জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা বলেন; মাস আমাদের কাছে কোনো ফ্যাক্টর নয়, সংস্কারটা পূর্ণ করে নির্বাচন ফেয়ার করার জন্য যে কয়েক মাসই লাগুক, আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলিনি। তা করতে গেলে অনেক সময় লাগবে। অন্তত নির্বাচনের সঙ্গে রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেগুলোর সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে এই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না, অবাধ হবে না।’

একই দিন বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক বিফ্রিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যত দ্রুত নির্বাচন হবে ততই রাজনীতি সহজ হবে। বাংলাদেশ স্থিতিশীল হয়ে আসবে।’ দ্রুত জাতীয় নির্বাচন কেন জরুরি- সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচনটা হওয়া দরকার, এর প্রধান দুটি কারণ আছে, একটি হলো স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, আরেকটি হলো গভর্ন্যান্স (সুশাসন) চালু করা। এখন তো গভর্ন্যান্সে খুব সমস্যা হচ্ছে, এটি কার্যকর করলেই তখন দেখবেন অর্থনীতি ভালো হয়ে আসছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। নির্বাচিত সরকার না হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়- জানিয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছিলেন, ‘জনগণের আকাক্সক্ষাই হলো- স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক । আমরা জনগণের এই আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন এবং সম্মান করি। জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াতের স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটাতেও আমরা একেবারেই একমত নই। এটা দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনকে জামায়াত সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেছিলেন, আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে ৬০টিরও বেশি দেশে এ ব্যবস্থা রয়েছে। জামায়াতের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির অবস্থান বিষয়ে বলেন, এটাতে আমরা পুরোপুরি বিরোধী। জোরালোভাবে বিরোধী। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থাকে আমরা সমর্থন করব না। কারণ এখানকার মানুষ এতে অভ্যস্ত নয়। এরকম ভোটের প্রশ্নই উঠতে পারে না। বিএনপির সঙ্গে ভিন্ন অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নানা ইস্যুতে ভিন্নমত থাকতেই পারে। এ নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। আমরা একটা মত দিয়েছি, অন্য দলের ভিন্নমত থাকতেই পারে। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সবশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আশা করি খুব দ্রুততম সময় সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, আগে জাতীয় নির্বাচন, তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে।
একই দিন ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা বলেছি যে সংস্কার প্রয়োজন। সেই সংস্কারে আমরা ঐকমত্য হই, তারপর শিগগিরই সম্ভব নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে ওনারা করবেন। আমরা সেটা দেখছি। ‘যত দ্রুত নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে, বাংলাদেশ স্থিতিশীল হয়ে আসবে’; মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ বক্তব্য ছাড়াও দ্রুত নির্বাচন নিয়ে নিয়মিত কথা বলছেন দলের অন্য শীর্ষ নেতারা।

কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, এই সরকারকে বলতে চাই, আপনারা ডিসেম্বরের ঘোষণা দিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিন। আমরা সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিছু রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে অভিযোগ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আরে ভাই, আপনাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ২০০৮ সালে বিএনপি এবং আমাদের জোট নির্বাচনে গিয়েছিল, ফলে বাংলাদেশের অনেক নামিদামি, অনেক বিখ্যাত প্রখ্যাত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে ফাঁসির কাষ্ঠে। ওই রকম ভুল আর করবেন না দয়া করে। একটি ভুল লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে কোনো টালবাহানা করবেন না।

সবশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ‘রোড টু ইলেকশন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘প্রথম হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যে নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সরকারের পরিবর্তন হয়। সেই মূল কাজটা বাদ দিয়ে আমরা যদি সাবসিডিয়ারি কাজ শুরু করে দিই, তাহলে এটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা হতে পারে না।’ শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি ১৬ বছর হাসিনার কাছে মাথানত করেনি। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হলেও আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথানত করব না। এখন নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছে। কেউ মনে হয় একটু যেন গোলমাল করে ফেলছে। কোথায় যেন একটা কীসের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কোন দল কতটা চাপ দিচ্ছে, এ বিবেচনায় যদি অন্তর্র্বতী সরকার কোনো নির্দিষ্ট দলকে প্রাধান্য না দেয়, তাহলে নির্বাচন ও সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। আর রাজনৈতিক মাঠে যেহেতু বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া তৃতীয় আর কোনো বড় শক্তি নেই, সেহেতু তাদের মধ্যে বিরোধ হবে, এটাই রাজনীতির ধর্ম। এক্ষেত্রে দল দুটি যদি গঠনমূলক রাজনৈতিক চর্চা করে, তবেই তা দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে।

দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার বিরোধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সবসময় মিত্রতা থাকে না। তাহলে রাজনীতি হয় না। একটা রাজনৈতিক দলের একটা স্বতন্ত্র রাজনীতি থাকবে, রাজনৈতিক পরিচয় থাকবে। সে তার প্রয়োজন মতো রাজনীতি করবে। প্রয়োজনে অন্য দলের সঙ্গে সে মিত্রতা করবে। সেটা হয়, সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। কোয়ালিশন রাজনীতি হয়, অ্যালায়েন্স পলিটিক্স হয়।

আবার সেই অ্যালায়েন্স ভেঙেও যায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে; বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেই দল (বিএনপি) হয়তো কোনো হিন্টস (ইঙ্গিত) পেয়েছে (নির্বাচন) পিছিয়ে যাওয়ার। নির্বাচন পেছানোর ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাব্বির আহমেদ বলেন, এটা কোনো প্রভাব ফেলবে না। সিদ্ধান্ত নেবে তো সরকার। কোন তারিখে নির্বাচন হবে, সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সেখানে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। এটি সরকারকে চাপে রাখার কৌশলও হতে পারে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

বিপরীতমুখী অবস্থানে বিএনপি-জামায়াত

নির্বাচন ইস্যুতে বিরোধ বাড়ছে

আপলোড টাইম : ০৯:৩৮:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না। অন্যদিকে জামায়াতের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। দলটি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চায় না। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে চায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন। জামায়াতের সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিরও পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে বিএনপি। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত ডিসেম্বরে নির্বাচনের আশ্বাসে ভরসা বা বিশ্বাস রাখতে চায় না বিএনপি। সে কারণে নির্বাচনের চাপ অব্যাহত রাখতে তারা মাঠের কর্মসূচি নিয়েছেন। দলটির নেতারা ধারণা করছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যে নতুন দল গঠন করছে, এর পেছনে সরকারের একটা অংশের সমর্থন রয়েছে। আর সে কারণে তারা মনে করেন, সরকারের ভিতরে কারও কারও নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা থাকতে পারে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের সময় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না বিএনপি।

এদিকে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের মিত্র থেকে বিপরীত দুই মেরুতে পৌঁছেছে বিএনপি ও জামায়াত । নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে দুটি দলের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। এই মুহূর্তে অন্যতম দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাড়তে পারে জটিলতা। আবার বিএনপি নেতাদের শঙ্কা; দেশে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ও সংস্কার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারের আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার ওপর। অতীতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করা দুই রাজনৈতিক মিত্র নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও বিরোধে নেমেছে। বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চায়। দলটি বলছে, নির্বাচিত সরকার এসে সংস্কার করবে। অন্যদিকে জামায়াত নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার চায় এবং সংস্কার বাস্তবায়নে নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চায়। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, দেশে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে ‘টালবাহানা’ শুরু হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে নেতারা দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছেন । হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করছেন বিএনপির অনেক নেতা।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ যেখানে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা (নির্বাচন কমিশনকে) পরিষ্কার বলেছি ‘নো ইলেকশন উইদাউট রিফর্মস (সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়)।’ সংস্কারের জন্য জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সময় দিতে প্রস্তুত জানিয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ করার জন্য যে সংস্কার ন্যূনতম প্রয়োজন, তার জন্য যতটা যৌক্তিক সময় প্রয়োজন হবে, জামায়াতে ইসলামী সেই সময়টা দিতে প্রস্তুত। জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা বলেন; মাস আমাদের কাছে কোনো ফ্যাক্টর নয়, সংস্কারটা পূর্ণ করে নির্বাচন ফেয়ার করার জন্য যে কয়েক মাসই লাগুক, আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলিনি। তা করতে গেলে অনেক সময় লাগবে। অন্তত নির্বাচনের সঙ্গে রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেগুলোর সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে এই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না, অবাধ হবে না।’

একই দিন বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক বিফ্রিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যত দ্রুত নির্বাচন হবে ততই রাজনীতি সহজ হবে। বাংলাদেশ স্থিতিশীল হয়ে আসবে।’ দ্রুত জাতীয় নির্বাচন কেন জরুরি- সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচনটা হওয়া দরকার, এর প্রধান দুটি কারণ আছে, একটি হলো স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, আরেকটি হলো গভর্ন্যান্স (সুশাসন) চালু করা। এখন তো গভর্ন্যান্সে খুব সমস্যা হচ্ছে, এটি কার্যকর করলেই তখন দেখবেন অর্থনীতি ভালো হয়ে আসছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। নির্বাচিত সরকার না হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়- জানিয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছিলেন, ‘জনগণের আকাক্সক্ষাই হলো- স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক । আমরা জনগণের এই আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন এবং সম্মান করি। জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াতের স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটাতেও আমরা একেবারেই একমত নই। এটা দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনকে জামায়াত সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেছিলেন, আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে ৬০টিরও বেশি দেশে এ ব্যবস্থা রয়েছে। জামায়াতের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির অবস্থান বিষয়ে বলেন, এটাতে আমরা পুরোপুরি বিরোধী। জোরালোভাবে বিরোধী। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থাকে আমরা সমর্থন করব না। কারণ এখানকার মানুষ এতে অভ্যস্ত নয়। এরকম ভোটের প্রশ্নই উঠতে পারে না। বিএনপির সঙ্গে ভিন্ন অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নানা ইস্যুতে ভিন্নমত থাকতেই পারে। এ নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। আমরা একটা মত দিয়েছি, অন্য দলের ভিন্নমত থাকতেই পারে। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সবশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আশা করি খুব দ্রুততম সময় সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, আগে জাতীয় নির্বাচন, তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে।
একই দিন ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা বলেছি যে সংস্কার প্রয়োজন। সেই সংস্কারে আমরা ঐকমত্য হই, তারপর শিগগিরই সম্ভব নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে ওনারা করবেন। আমরা সেটা দেখছি। ‘যত দ্রুত নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে, বাংলাদেশ স্থিতিশীল হয়ে আসবে’; মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ বক্তব্য ছাড়াও দ্রুত নির্বাচন নিয়ে নিয়মিত কথা বলছেন দলের অন্য শীর্ষ নেতারা।

কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, এই সরকারকে বলতে চাই, আপনারা ডিসেম্বরের ঘোষণা দিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিন। আমরা সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিছু রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে অভিযোগ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আরে ভাই, আপনাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ২০০৮ সালে বিএনপি এবং আমাদের জোট নির্বাচনে গিয়েছিল, ফলে বাংলাদেশের অনেক নামিদামি, অনেক বিখ্যাত প্রখ্যাত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে ফাঁসির কাষ্ঠে। ওই রকম ভুল আর করবেন না দয়া করে। একটি ভুল লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে কোনো টালবাহানা করবেন না।

সবশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ‘রোড টু ইলেকশন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘প্রথম হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যে নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সরকারের পরিবর্তন হয়। সেই মূল কাজটা বাদ দিয়ে আমরা যদি সাবসিডিয়ারি কাজ শুরু করে দিই, তাহলে এটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা হতে পারে না।’ শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি ১৬ বছর হাসিনার কাছে মাথানত করেনি। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হলেও আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথানত করব না। এখন নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছে। কেউ মনে হয় একটু যেন গোলমাল করে ফেলছে। কোথায় যেন একটা কীসের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কোন দল কতটা চাপ দিচ্ছে, এ বিবেচনায় যদি অন্তর্র্বতী সরকার কোনো নির্দিষ্ট দলকে প্রাধান্য না দেয়, তাহলে নির্বাচন ও সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। আর রাজনৈতিক মাঠে যেহেতু বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া তৃতীয় আর কোনো বড় শক্তি নেই, সেহেতু তাদের মধ্যে বিরোধ হবে, এটাই রাজনীতির ধর্ম। এক্ষেত্রে দল দুটি যদি গঠনমূলক রাজনৈতিক চর্চা করে, তবেই তা দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে।

দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার বিরোধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সবসময় মিত্রতা থাকে না। তাহলে রাজনীতি হয় না। একটা রাজনৈতিক দলের একটা স্বতন্ত্র রাজনীতি থাকবে, রাজনৈতিক পরিচয় থাকবে। সে তার প্রয়োজন মতো রাজনীতি করবে। প্রয়োজনে অন্য দলের সঙ্গে সে মিত্রতা করবে। সেটা হয়, সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। কোয়ালিশন রাজনীতি হয়, অ্যালায়েন্স পলিটিক্স হয়।

আবার সেই অ্যালায়েন্স ভেঙেও যায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে; বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেই দল (বিএনপি) হয়তো কোনো হিন্টস (ইঙ্গিত) পেয়েছে (নির্বাচন) পিছিয়ে যাওয়ার। নির্বাচন পেছানোর ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাব্বির আহমেদ বলেন, এটা কোনো প্রভাব ফেলবে না। সিদ্ধান্ত নেবে তো সরকার। কোন তারিখে নির্বাচন হবে, সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সেখানে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। এটি সরকারকে চাপে রাখার কৌশলও হতে পারে।